গোটা এশিয়া জুড়ে বিরাট ভারতবর্ষের বিরাট ক্ষমতা বারবে
রাজেশ রায়:- কখনও যদি মায়ানমার, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ড ভ্রমন করেন দেখবেন এখানকার শিল্প, সংস্কৃত ও সভ্যতায় ভারতীয় প্রভাব রয়েছে। ভাষা এবং ধর্ম গত ভাবেও ভারতের সাথে মিল আছে। প্রাচীন বানিজ্য পথ দিয়ে এসব অঞ্চলের সাথে ভারতের বানিজ্য চলত। কিন্তু যখন ইউরোপীয়ানরা গোটা এশিয়া জুড়ে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে তখন দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটি দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। বিংশ শতাব্দী আসতে আসতে আবার পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। বিশ্বায়ন ও বানিজ্যিক ভাবে আবার এই দুই ভাগের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারতবর্ষের সাথে এসব দেশ গুলির নতুন করে কুটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠ। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর ভারতকে তার বিদেশনীতি পরিবর্তন করতে হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাটেজিক পার্টনার ছিল যার উপর মিলিটারি, অর্থনীতির ব্যাপারে ভারত অনেকটাই নির্ভর ছিল। ইউরোপ ও আমেরিকার সাথে ভারতের সম্পর্ক ভালই ছিল কিন্তু ভারত এসময় আরও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ গুলোর সাথে সম্পর্ক মজবুত করার জন্য নজর দেয় যাতে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসে এবং এনার্জি সাপ্লাইয়ে নিরাপত্তা আসে। ঠিক এইজন্য ভারত তার প্রতিবেশী দক্ষিন পূর্ব এশিয়ান দেশগুলোর সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কাজ শুরু করে। ১৯৯১ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পিভি নরশীমা রাওয়ের সময়ে ভারত লুক ইস্ট নীতি শুরু করে। ২০১৪ সালে এই নীতিকে আপগ্রেড করে অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি লঞ্চ করা হয় যাতে শুধু দক্ষিন পূর্ব এশিয়া নয় বরং অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিন কোরিয়া ও জাপানের সাথেও ভারত দ্বি পাক্ষিক সম্পর্ক মজবুতে জোর দেয়। ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির ক্ষেত্রে দুটি চ্যালেঞ্জ আছে প্রথমত ভারতের অর্থনীতি এবং দ্বিতীয়ত এই এলাকায় চীনের প্রভাব বৃদ্ধি। ভারতের এই অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি কী সত্যিই লুক ইস্ট পলিসির আপগ্রেডড ভার্সন? এই নীতিতে কী কী বাধা আসতে পারে এবং এই পলিসির গুরুত্ব কতখানি। এসব ব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দিকে ভারতের নজর দেবার বেশ কয়েকটি কারন আছে। প্রথমত অতীতে সুসম্পর্কের জন্য এই সব দেশ গুলোতে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব আছে যথেষ্ট। তাই ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ পুনরায় এই সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এশিয়াতে একটি ঐক্য জোট তৈরি করতে চায়। দ্বিতীয়ত ভারত এর মাধ্যমে তার পূর্ব সীমান্তকে পুরোপুরি নিরাপদ করতে চায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকার সময় ভারতের পশ্চিম এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্তে বিশেষ নজর দেওয়া হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি আক্রমনের আশঙ্কায় নেভিকে শক্তিশালী করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে উত্তর পূর্ব সীনান্তকে অবহেলা করা হয় ফলে এখানে ধীরে ধীরে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠন গড়ে ওঠে। এই জন্য অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির মাধ্যমে ভারগ দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার প্রবেশপথ হয়ে উঠেছে। তৃতীয়ত চীনের আগ্রাসি বিদেশনীতির কারনে দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে চীন ক্রমশ নিজের প্রভাব বিস্তারের চেষ্ট করছে। চীনের সাথে ভারতের একটি বিশাল লম্বা সীমান্ত আছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের সাথে চীনের বন্ধুত্ব যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ হয়েছে। সেজন্য দক্ষিন পূর্ব এশিয়া ভারতের জন্য স্ট্রাটেজিক্যালি অন্তত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। এই জন্য ভারত এখানে জোট গঠন করে চীনের প্রভাব কমাবে এখানে। চতুর্থত গল্ফ দেশ গুলোর সাথে এইসময় ভারতের একটু দূরত্ব তৈরি হয়। ওপেক বা অরগানাইজেশান অফ পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং দেশ গুলোতো তেলের দাম নিয়ে ঝামেলা হয় যার কারনে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি। মধ্য প্রাচ্যে ভারতের দুটি প্রধান বাজার ইরাক ও ইরানের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় যার কারনে ভারত বিকল্প একটি অর্থনৈতিক বাজার খুঁজতে শুরু করে। আর এই জন্য ভারত দক্ষিম পূর্ব এশিয়ায় বিনিয়োগ শুরু করে।
আগেই বলা হয়েছে যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, মধ্য প্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, চীনের প্রভাব বৃদ্ধি এসব কারনে ভারত তার বিদেশনীতি পরিবর্তন করে এবং ভারত মধ্য প্রাচ্য ও পশ্চিমা দেশ গুলো থেকে সরে এসে দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে নজর দেয়। এসব এলাকার দেশ গুলির দ্রুত বৃদ্ধি হওয়া অর্থনীতির সাথে যুক্ত হয়ে ভারত তার অর্থনীতি উন্নয়নে জোর দেয়। এই অঞ্চলের জোট আসিয়ান বা অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ ইস্ট এশিয়ান দেশগুলির একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার হয়ে ওঠে ভারত। লুক ইস্ট নীতি যেসময় নেওয়া হয়েছিল তখন আসিয়ানে ছয় জন সদস্য দেশ ছিল সেসময় ভারত থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রধান মনোযোগী ছিল। তখন ভারত ও এই দেশ গুলো বানিজ্য ও নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে আলোচনা করত। এরপর আসিয়ান যখন দশ সদস্যদের সংগঠন হয় তখন ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া ও মায়ানমারের সাথে ভারত সম্পর্ক জোরদার করে। ১৯৯০ এর দশক থেকেই ভারত আসিয়ান দেশ গুলোর সাথে বানিজ্য, নিরাপত্তা, এনার্জি ও বিনিয়োগের ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছিল।
অন্যদিকে আসিয়ান দেশ গুলোর প্রধান রপ্তানি বাজার হয়ে ওঠে ভারত। ১৯৯২ সালে ভারত আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়লগ পার্টনার, ১৯৯৫ সালে ফুল ডায়লগ পার্টনার এবং ১৯৯৬ সালে আসিয়ানের রিজিওনাল ফোরামের বা এআরএফের সদস্য হয় ভারত। এই এআরএফ ইন্দো প্যাসিফিক এলাকায় ভারতের প্রধান পার্টনার। ২০০২ সাল থেকো ভারত আসিয়ান ও আসিয়ান +৩ সাথে সম্মেলন করে আসছে। চীন, জাপান ও দক্ষিন কোরিয়াকে আসিয়ান +৩ বলা হয়। আসিয়ান ও ভারতের মধ্যে তিনটি ফান্ড তৈরি হয়েছে। আসিয়ান ভারত কোঅপারেশন ফান্ড, আসিয়ান ভারত সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট ফান্ড এবং আসিয়ান ভারত গ্রীন ফান্ড। ২০০৩ সাল আসতে আসতে ভারতের লুক ইস্ট নীতিতে জাপান ও দক্ষিন কোরিয়া যুক্ত হয় এবং এদের সাথে ভারতের বানিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। সব মিলিয়ে বলতে গেলে ভারতের লুক ইস্ট নীতির তিনটি লক্ষ ছিল আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট, উত্তর পূর্ব ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশ এবং মজবুত অর্থনীতি। এর জন্য ভারত এসব দেশ গুলোর সাথে ফ্রী ট্রেড এগ্রিমেন্ট করে। ২০০৯ সালে আসিয়ান ভারত ফ্রী ট্রেড এগ্রিমেন্ট হয়। এছাড়া দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে মজবুত অর্থনৈতিক জোটের জন্য অনেকগুলি পদক্ষেপ গঠন করা হয়। যেমন মেকং গঙ্গা কোঅপারেশন বা এমজিসি, বিমস্টেক বা বে অফ বেঙ্গল মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল এন্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন এবং বাংলাদেশ, চীন, মায়ানমার, ভারত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট। এইসব সংগঠন তৈরির উদ্দেশ্য একসাথে বানিজ্য, বিনিয়োগ, শিল্প প্রতিষ্ঠান, টেকনোলজি, মাছ চাষ, পর্যটন, কৃষিকাজ, এনার্জি, ইনফ্রাস্ট্রাকচার, পরিবহন এবং যোগাযোগ সেক্টরে কাজ করা।
এবার দেখা যাক ভারতের লুক ইস্ট পলিসি কতটা সফল। এই নীতি ভারতের অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫-১৬ তে আসিয়ান দেশ গুলোর ভারতের বানিজ্য ছিল প্রায় ৬৫ বিলিয়ন ডলার যা বিশ্ব জুড়ে ভারতের মোট বানিজ্যের ১০.১২ শতাংশ। ২০১৮ আসতে আসতে এই সংখ্যা দাড়ায় ১৪২ বিলিয়ন ডলার। আসিয়ান আজ ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম বানিজ্যিক পার্টনার। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাথে ভাল সম্পর্কের জন্য ভারতকে ২০০৫ সালে ইস্ট এশিয়ান সামিট বা ইএএসে আমন্ত্রন করা হয়েছিল। এই ইএএস ইন্দো প্যাসিফিক এলাকায় ভারতকে স্ট্রাটেজিক সাপোর্ট করে। ইএএসের জন্য ভারত এই এলাকায় চীনের প্রভাবকে কম করতে পেরেছে। তবে একটা কথা ঠিক ভারত বা আসিয়ান দেশ গুলো কেউই সরাসরি চীন বিরোধী জোট গঠনে আগ্রহী নয় কারন চীনের সাথে সবারই বানিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। তবে বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগর এলকায় ভারত ও আসিয়ান দেশ গুলো তাদের নেভিকে মজবুত করছে একসাথে। এই সম্পর্ক আরও মজবুত করতে ভারত তার লুক ইস্ট পলিসি কে অ্যাক্ট ইস্ট পলিসিতে আপগ্রেড করেছে।
২০১৪ সালে ভারতে নতুন কেন্দ্রীয় সরকার গঠন হবার পর বিদেশ নীতিতে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া সহ পশ্চিমা বিশ্ব বাদেও ভারত তার প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দেয়, এরই ফল হচ্ছে অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি যা ২০১৪ সালে ভারত আসিয়ান সামিটে লঞ্চ করা হয়। অ্যাক্ট ইস্ট নীতি লুক ইস্ট নীতির মতো শুধু দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলোতো আবদ্ধ না থেকে এতে ইন্দো প্যাসিফিক এলাকার দেশ গুলোকে যুক্ত করা হয়। তাছাড়া লুক ইস্ট নীতির মতন এতে শুধু বানিজ্যিক সম্পর্ক ও বিনিয়োগের উপর জোর দেওয়া হয়নি বরং স্ট্রাটেজিক সম্পর্কে জোর দেওয়া হয়েছে। এই অ্যাক্ট ইস্ট নীতিতে উত্তর পূর্ব ভারতের উন্নয়নে আগের থেকেও বেশী জোর দেওয়া হয়েছে, যাতে এই এলাকাকে একটি অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক কেন্দ্রে পরিনত করা যায়। ভারত সরকারের বিভিন্ন স্কীম যেমন ডিজিটাল ইন্ডিয়া, স্বচ্ছ ভারত অভিযান, মেক ইন ইন্ডিয়া এবং স্মার্ট সিটির মত প্রজেক্ট গুলোর জন্য প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগ দরকার। যার জন্য দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলোর সহযোগিতা দরকার।
ভারত ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া ও ২০১৬ সালে জাপানের সাথে সিভিল নিউক্লিয়ার চুক্তি করে। ভারত মায়ানমার ও ভিয়েতনামের সাথে নতুন তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের উতস সন্ধানের জন্যও চুক্তি করেছে। চীন এই অঞ্চলে নিজের প্রভাব বাড়াতে চাইছে যার জন্য ভারত মহাসাগর এলাকায় বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করেছে চীন। মায়ানমারের কিয়াককিউ বন্দর, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা এবং পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরের মাধ্যমে এবং বিআরআই প্রজেক্টের ব্যাপারে চীন ভারতকে ঘিরে ফেলবার চেষ্টা করছে, একে চীনের স্ট্রিং অফ পার্লস নীতি বলে। এই জন্য ভারত জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরের মত দেশের সাথে স্ট্রাটেজিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, এই সব দেশের বিভিন্ন বন্দর ও নেভাল বেসে ভারত প্রবেশাধিকার পেয়েছে। এসবই সম্ভব হয়েছে ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির জন্য। ভারতের বিদেশনীতি এতটাই সফল যে ভারত এই অঞ্চলে চীনকে তিন ভাবে কাউন্টার করছে:— ১) এসিয়ান, বিমস্টেক, জাপান, দক্ষিন কোরিয়া ও ভিয়েতনামের সাথে জিও পলিটিক্যাল ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করে। ২) আমেরিকা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মধ্যে কোয়াড গঠন। ৩) উত্তর পূর্ব ভারতে বিপুল ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্টের মাধ্যমে।