ভারত

ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশানাল এমারজেন্সি কেন জারি করেছিলেন?

রাজেশ রায়:– ভারতবর্ষের ইতিহাস এমন কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছিল যাকে ইতিহাসে কালো অধ্যায় বলা হয়। এমনই এক ঘটনা হল ১৯৭৫ সালে হওয়া ন্যাশনাল এমারজেন্সি। আজকালকার নতুন প্রজন্ম হয়ত এমারজেন্সি সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। যারা সেইসময় এই ঘটনা দেখেছে তারাই জানে কতটা ভয়াবহ ছিল এটা। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এই এমারজেন্সি শুরু করেন যাতে অনেক মানুষ মারা যান, কয়েক হাজার জনকে গ্রেফতার করা হয়। এই ন্যাশানাল এমারজেন্সি কেন করা হয়? এর কী প্রভাব পড়েছিল এবং এটি কেনো তুলে নেওয়া হয়?

১৯৭৫ সালে ভারতে এমারজেন্সি হওয়ার আগে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল এবং এমারজেন্সির কারন সম্পর্কে প্রথমে জানা যাক। ১৯৭১ সালে ভারতে জাতীয় নির্বাচন হয় যাতে উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলি শহর থেকে কংগ্রেসের ইন্দিরা গান্ধী জয়লাভ করে। রায়বেরিলিতে ইন্দিরা গান্ধীর বিপরীতে ছিল রাজ নারায়ন। সেই সময় সবার মনে হয়েছিল রাজ নারায়ন জিতবে কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী বিপুল ভোটে জয়লাভ করে যার জন্য ইন্দিরা গান্ধীর উপর সন্দেহ হয় রাজ নারায়ণের এবং তিনি এলাহাবাদ হাইকোর্টে কেস করেন নির্বাচনে দুর্নীতির ব্যাপারে। এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জগমোহন লাল সিনহা এই ব্যাপারে তদন্ত শুরু করে। ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের বিচার ব্যাবস্থার মধ্যে এই সময় একটু দূরত্ব তৈরি হয়। কারন ইন্দিরা গান্ধীর আগে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ছিল লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। তাসখন্দে রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় ওনার। এই সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি হচ্ছে জয়প্রকাশ নারায়ন।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা নিয়েছিল কিন্তু স্বাধীনতার পর উনি রাজনীতিতে না থেকে বিহারে ফিরে গিয়েছিলেন। জয়প্রকাশ নারায়ন যদি রাজনীতিতে থাকত তাহলে জহরলাল নেহেরু ও বল্লভ ভাই প্যাটেলের মতন বড় রাজনীতি বিদ হত বলে মনে করা হয়। ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধে আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। ফলে যুদ্ধে ভারতের জিতে যাবার পর আমেরিকা ভারতের সাথে বানিজ্য বন্ধ করে দেয়। ফলে ভারতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হয়। ১৯৭৩ সালে ভারতে প্রায় ২০ শতাংশ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৭৪ সালে এটা বেড়ে হয় ২৪ শতাংশ। এই সময় জর্জ ফারনান্ডিজের নেতৃত্বে বিহারে রেলওয়ে আন্দোলন শুরু হয়। তাছাড়া বিহারে ছাত্ররা কাজের দাবিতে বিশাল আন্দোলন শুরু করে যাতে নেতৃত্ব দেয় জয়প্রকাশ নারায়ন। লালুপ্রসাদ যাদব ও নীতিশ কুমারের মত ব্যাক্তি এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে গুজরাটে মোরারজী দেশলাইয়ে নেতৃত্বে নব নির্মান আন্দোলন শুরু হয়। এখানে ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়। ঠিক এই সময়ই ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্ট জানায় ১৯৭১ সালে রায়বেরিলি নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী সরকারি কর্মচারীদের ব্যবহার করে নির্বাচন জিতেছিল। ২৪ জুন ইন্দিরা গান্ধীর বিপক্ষে দিল্লির রামলীলা ময়দানে বিশাল আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৫ জুনই ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশানাল এমারজেন্সি জারি করে দেয়। আসলে ভারতের সংবিধানে এমারজেন্সি জারি করবার জন্য বিশেষ কিছু নীতি আছে। ভারতের সংবিধানে তিন ধরনের এমারজেন্সির কথা বলা হয়েছে। 

১) ন্যাশানাল এমারজেন্সি :– এই ধরনের এমারজেন্সির তখন করা হয় যখন ভারত কারও সাথে যুদ্ধ করে, যদি ভারতের উপর কোন দেশ আক্রমন করে এবং দেশের  আভ্যন্তরীন কোন সংগঠন যদি দেশের মধ্যেই বিদ্রোহ করে। তবে যদি সরকার মনে করে ভারতে কোন আক্রমনের সম্ভবনা তৈরি হতে পারে সেক্ষেত্রেও সরকার চাইলে এমারজেন্সি জারি করতে পারে। ১৯৬২-৬৮ অবধি ভারতের সাথে চীন এবং পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়েছিল, ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ হয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে ন্যাশানাল এমারজেন্সি জারি করা হয়েছিল। সংবিধানের আর্টিকেল ৩৫৪ তে এর কথা বলা হয়েছে। 

২) রাষ্ট্রপতি শাসন বা স্টেট এমারজেন্সি :— যদি ভারতের কোন রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে বিরোধীতা করে বা কেন্দ্রের শাসন না মানতে চায় তখন সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়। যখন গুজরাটে নব নির্মান আন্দোলন চলছিল তখন সেখানে স্টেট এমারজেন্সি জারি করা হয়েছিল। সংবিধানের আর্টিকেল ৩৫২ তে এর কথা বলা হয়েছে। 

৪) অর্থনৈতিক সংকট:– আর্টিকেল ২৬০ এ এর কথা বলা হয়েছে। যখন দেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হয় তখন সরকার চাইলে এমারজেন্সি জারি করতে পারে। 

১৯৭৫ সালের ২৫ জুন ইন্দিরা গান্ধী এমারজেন্সি জারি করেছিল দেশের আভ্যন্তরীন অবস্থা খারাপ বলে। পরে জানা যায় এমন কিছুই হয়নি আসলে ইন্দিরা গান্ধী নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বজায় রাখতে এটা করেছিল বলে মত একাধিক বিশেষজ্ঞদের। ২৫ জুন সকালে অল ইন্ডিয়া রেডিও স্টেশন থেকে ইন্দিরা গান্ধী এই এমারজেন্সির ঘোষনা করেন যাতে তিনি বলেন ভারতের ভিতরে কিছু সংগঠন তৈরি হয়েছে যারা পুলিশ  সেনাবাহিনী কে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাবার চেষ্টা করছে। বেশ কিছু বিশেষজ্ঞদের মতে ইন্দিরা গান্ধী এমারজেন্সির আগেই একটি বড় লম্বা লিস্ট করে রেখেছিলেন যাতে সেইসব রাজনৈতিক নেতাদের নাম ছিল যাদের গ্রেফতার করা হবে। ভারতীয় সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী এমারজেন্সির সময় সরকার যদি কাউকে সন্দেহও করে, তাহলেও তাকে গ্রেফতার করা হবে। এর পূর্ণ সুযোগ নিয়েছিল ইন্দিরা গান্ধী। এমারজেন্সি জারি করবার মাত্র সাত দিনের মধ্যে মোরারজী দেশাই, জয়প্রকাশ নারায়ন সহ প্রায় ১৫০০০ রাজনৈতিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এদের সাথে ব্রিটিশ সরকার কালাপানিতে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাথে যেমন করত, তেমন ব্যবহার করছিল। এদের সাথে পরিবারের কারও দেখা করতে দেওয়া হত না, ঘন্টার পর ঘন্টা না খাইয়ে রেখে দেওয়া হত, আবার একসাথে অনেক খাইয়ে দাড় করিয়ে রেখে দেওয়া হত।

ঘুমোতে দেওয়া হত না, অসুস্থ হলে চিকিৎসা করানো হত না। শুধু ছেলে না মেয়েদের সাথেও এমন করা হয়েছিল। জর্জ ফার্নন্ডিজ যে বিহারে রেল বিদ্রোহের নেতা ছিল তার ভাই লরেন্স কে এত মারে পুলিশে যে কয়েকমাস সোজা হয়ে দাড়াতে পারে নি। রেল বিদ্রোহের সাথে জড়িত রেলের কর্মীদের জেলে ভরে দেওয়া হয় এবং তাদের পরিবারকে রেলের কোয়ার্টার থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়। দিল্লি ডুয়লার নামে একটি বস্তির মানুষদের উপর পুলিশ গুলি চালায় যাতে কিছু মানুষদের মারা যায়, এবং মানুষ গুলো ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল বলে এমন করা হয়েছিল একাধিক বিশেষজ্ঞদের মতে। বিহারে ছাত্র আন্দোলনের সাথে দুজনকে ফাঁসি দিয়ে দেওয়া হয়। এমারজেন্সির সময় প্রায় ১,৪০,০০০ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছিল যাদের বিনা বিচারে এক বছর আট মাস জেলে ভরে রাখা হয়েছিল।

প্রথমেই ইন্দিরা গান্ধী রাজনারায়ন মামলায় এলাহাবাদ হাইকোর্টের আদেশ পরিবর্তন করে যাতে ইন্দিরা গান্ধী কে লোকসভার সদস্য থেকে ইস্তফা দিয়ে ছয় বছর নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছিল। একটা নতুন আইন আনা হয় যাতে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি ও লোকসভার অধ্যক্ষের উপর কোন মামলা করা হবে না কোনওদিন। রাজ্যসভায় এই আইন পাশ করা হয় কিন্তু লোকসভায় এই আইন পাশ করানো হয়নি। এমারজেন্সির প্রথম সপ্তাহেই আর্টকেল ১৪, ২১ ও ২২ কে বাতিল করে দেওয়া হয় যাতে সব মানুষকে সমান অধিকার, সম্পত্তির অধিকার রক্ষা এবং আদালতে বিচারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। আর্টিকেল ১৯ কেও বাতিল করে দেওয়া হয় যাতে সভা, সংগঠন করবার অধিকার কেরে নেওয়া হয়। ইন্দিরা গান্ধী রাসুকা আইন চালু করে যাতে জেলে বন্দী ব্যাক্তিরা কোনওদিন কেন তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তার কারন জানতে পারবে না, তারা কোনওদিন আদালতে আবেদন করতে পারবে না। এমনকী এদের ব্যাপারে আলোচনা করলেও তাকে জেলে ভরে দেওয়া হবে, এমন জাননাো হয়। মানে ধরুন আপনি মোরারজী দেশাইয়ের আত্মীয়, আপনি ওনার ব্যাপারে কাউকে জিজ্ঞেস করলেও আপনাকে জেলে ভরে দেওয় হবে। এমারজেন্সি জারি করবার পরেরদিনই দেশের সমস্ত নিউজ পেপারের কারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। খুব কম সংখ্যক খবর ছাপা হত তাও যেটা ইন্দিরা গান্ধী চাইবে সেটাই ছাপা হত বলে মত বিশেষজ্ঞদের। সরকারের বিরুদ্ধে করা সমস্ত সিনেনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এমাজেন্সিতে সবচেয়ে বেশী বিপদে পড়েছিল শ্রমিকরা কারন এমারজেন্সির আগে শ্রমিকদের বোনাস ছিল ৮.৩৩ শতাংশ কিন্তু এমারজেন্সির পর শ্রমিকদের বোনাস হয় ৪ শতাংশ। এরজন্য শ্রমিকরা আন্দোলন করেছিল কিন্তু পুলিশ তাদের হটিয়ে দিয়েছিল। বাংলায় ১৬০০০ শ্রমিক আন্দোলন করেছিল যাদের জেলে ভরে দেওয়া হয়েছিল।

পুঁজিপাতী ব্যাবসায়ীদের কর কমিয়ে দিয়ে ব্যাপক সুবিধা করে দিয়েছিল ইন্দিরা গান্ধী। এইসময় জনসংখ্যা কমানোর জন্য জোর করে বহু মানুষকে নাসবন্দী করানো হয়েছিল। আসলে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ভারতীয়দের সাথে পুরো ব্রিটিশদের মত অত্যাচার করেছিল বলে একাংশের মত। এই অরাজকতা বন্ধ করতে ভারতের সমস্ত বিপক্ষ দল একসাথে জোট গঠন করেছিল যাকে জনতা পার্টি বলা হয়। ১৯৭৭ সালে নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী হেরে যায় এবং জনতা পার্টি সরকার গঠন করে। মোরারজী দেশাই প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি সাহ কমিশন গঠন করেন যার উদ্দেশ্য ছিল এমারজেন্সির সময় হওয়া এই অত্যাচারের পুরো তদন্ত করা। সাহ কমিশনের রিপোর্টে দেখা যায় ইন্দিরা গান্ধী নিজের স্বার্থে এমারজেন্সি জারি করেছিল৷ এরজন্য ইন্দিরা গান্ধীর উপর মামলা করা হয় কিন্তু ততদিনে মোরারজী দেশাইকে হারিয়ে আবারও ক্ষমতা দখল করে ইন্দিরা গান্ধী এবং তার বিরুদ্ধে থাকা সমস্ত মামলা খারিজ করে দেয়। এজন্য ১৯৭৫ সালের এমারজেন্সিকে ভারতের ইতিহাসে কালো অধ্যায় বলা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.