পৃথিবীর সবথেকে ভয়ংকর হেলিকপ্টার ভারতবর্ষের বিমানবাহিনীর কাছে। জানুন বিস্তারিত
রাজেশ রায়: কমব্যাট হেলিকপ্টার যেকোন দেশের সেনাবাহিনীর জন্য বড় সম্পদ। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী কে গ্রাউন্ড সাপোর্ট দেবার ক্ষেত্রে বিশেষ করে শত্রুর ট্যাংক ধ্বংস করতে হেলিকপ্টারের জুরি মেলা ভার। শুধু এয়ার সাপোর্টই না উদ্ধার কার্যে, দুর্গম এলাকায় সেনাকে রসদ পৌঁছানো সহ প্রচুর কাজে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়। এই মহূর্তে বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যাটাক হেলিকপ্টার হচ্ছে আমেরিকার বোয়িং এর তৈরি এএইচ -৬৪ অ্যাপাচী। এর সমতুল্য অ্যাডভান্সড ঘাতক হেলিকপ্টার এমনও পর্যন্ত কোন দেশ তৈরি করতে পারে নি। আজ আমরা এই অ্যাপাচি হেলিকপ্টার সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করব।
বোয়িং এএইচ ৬৪ অ্যাপাচি হেলিকপ্টার সার্ভিসে আসে ১৯৮৬ সালে তবে এই প্রজেক্ট প্রথমেই বোয়িং পায় নি। ১৯৭২ সালে লকহিড মার্টিনের তৈরি এএইচ-৫৬ চেনিয়ে প্রজেক্ট ক্যানসেল হয়ে যায় কারন এই হেলিকপ্টারে অনেক টেকনিক্যাল সমস্যা ছিল এবং এটি অনেকবার ক্রাশ করেছিল, তাছাড়া সেই সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা ব্যাস্ত হয়ে পড়ে যার জন্য আমেরিকা তাদের বিমানবাহিনী তে থাকা এ-১০ থান্ডারবোল্ট ২ ও নৌবাহিনীর কাছে থাকা হ্যারিয়ার বিমানের মতন স্থলসেনার জন্য গ্রাউন্ড সাপোর্টের জন্য একটি অ্যাডভান্সড হেলিকপ্টারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। আমেরিকা চাইছিল তাদের বেল এএইচ-১ কোবরা হেলিকপ্টারের থেকেও অ্যাডভান্সড হেলিকপ্টার। যার জন্য ১৯৭২ সালে নভেম্বর মাসে আমেরিকা একটি টেন্ডার জারি করে। আমেরিকার বিখ্যাত সব অ্যাভিয়েশন কোম্পানি লকহিড মার্টিন, বোয়িং, নর্থ্রুপ গ্রুম্যান, বেল, হুগেস, সিকরোস্কাই এতে অংশ নেয়। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে আমেরিকা সমস্ত কোম্পানির মধ্যে থেকে হুগেস ও বেলের ডিজাইন কে সিলেক্ট করে। হুগেসের তৈরি মডেল ৭৭ বা ওয়াইএএইচ -৬৪ এ ১৯৭৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এবং বেলের তৈরি মডেল ৪০৯ বা ওয়াইএএইচ -৬৩ এ প্রোটোটাইপ সেই বছরই ১ অক্টোবর প্রথম ফ্লাইট করে। শেষ পর্যন্ত আমেরিকা হুগেসের তৈরি ওয়াইএএইচ-৬৪ এ মডেল কে সিলেক্ট করে কারন এর ক্ষমতা বেশী ছিল। ১৯৮১ সালে প্রথম হেলিকপ্টারটি আমেরিকান সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয় টেস্টিং এর জন্য।
১৯৮২ সাল থেকে ফুল প্রোডাকশন শুরু হয়। ১৯৮১ সালেই এর নতুন নামকরন হয় অ্যাপাচি, আমেরিকার বিভিন্ন উপজাতির নাম অনুসারে এই নামকরন হয়। ১৯৮২ সালে অ্যারিজোনাতে প্রথম অ্যাপাচি হেলিকপ্টার তৈরি হয়। ১৯৮৪ সালে ম্যাকডোনেল ডগলাস ৪৭০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে এই হুগাস কোম্পানিকে কিনে নেয়। ১৯৯৭ সালে বোয়িং এর সাথে ম্যাকডোনেল ডগলাস যুক্ত হয়ে যায়। তারপর থেকেই সমস্ত অ্যাপাচি হেলিকপ্টার বোয়িং তৈরি করা শুরু করে। ১৯৮৬ সালে এক একটি অ্যাপাচি হেলিকপ্টারের দাম ছিল প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার বা ১০৫ কোটি টাকা। ১৯৮৫ সাল থেকেই অ্যপাচি এএইচ-৬৪ এ ভার্সনের আপগ্রেডেশনের কাজ শুরু হয়, ইন্জিন, সেন্সর, কন্ট্রোল প্যানেল, রোটার ব্লেড সহ ব্যাপক আপগ্রেডেশনের পর এএইচ -৬৪ ডি লংবো অ্যাপচি মডেল তৈরি হয়। ১৯৯২ সালের ১৫ এপ্রিল প্রথম অ্যাপচি ডি মডেলর ফ্লাইট টেস্ট হয় এবং ১৯৯৫ সালের ১৩ অক্টোবর এএইচ-৬৪ ডি এর ফুল প্রোডাকশন শুরু হয় এবং ১৯৯৭ সালের ৩১ মার্চ প্রথম অ্যাপচি ৬৪ ডি আমেরিকান সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই এএইচ -৬৪ ডি অ্যাপাচি পোগ্রামে মোট ১১ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৮২,০০০ কোটি টাকা খরচা হয়েছিল। ২০২০ এর এপ্রিল পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী ২৪০০ + অ্যাপাচি তৈরি করা হয়েছে। বোয়িং এর পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন সংস্থা বোয়িং থেকে টেকনোলজি নিয়ে অ্যাপাচির অনেক পার্টস তৈরি করে যেমন ইটালির আগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড, ভারতের টাটা, দক্ষিন কোটিয়ার কোরিয়ান এরোস্পেস কোম্পানি অ্যাপাচির ফিউসলেজ সহ অনেক অংশ তৈরি করে।
চারটি ব্লেড যুক্ত এএইচ ৬৪ ডি অ্যপাচিতে আমেরিকার জেনারেল ইলেকট্রিকের তৈরি দুটি শক্তিশালী T-700-GE-701D টার্বোস্যাফ্ট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। অ্যাপচি তে বিশেষ প্রাযুক্তিতে তৈরি ফুয়েল ট্যাংক রয়েছে যাতে বাজ পড়লে এমনকী ব্যালেস্টিক প্রজেক্টাইলস আঘাত করলেও কোন ক্ষতি হয় না। অ্যাপাচি বিশ্বের প্রথম অ্যাটাক হেলিকপ্টার যাতে যুদ্ধবিমানের মত হেলমেট মাউন্টেড ডিসপ্লে ব্যবহার করা হয়েছে অর্থাত পাইলট যে দিকে তাকাবে অটোমেটিক টার্গেট লক হয়ে যাবে। লকহিড মার্টিনের তৈরি অ্যারোহেড টার্গেটিং সিস্টেম রয়েছে অ্যাপাচিতে। লকহিড মার্টিনের তৈরি এন/এপিজি ৭৮ লংবো রেডার যুক্ত অ্যপাচি ৫০ কিলোমিটার এলাক জুড়ে একসাথে ২৫৬ টি টার্গেট কে একসাথে শনাক্ত করতে সক্ষম। লংবো রেডার যুক্ত করলে অ্যাপাচির রেঞ্জ দাঁড়ায় ৪৭৬ কিমি। ৫৮ ফিট লম্বা একটি অ্যাপচিতে সর্বোচ্চ দুই জন ক্রু থাকতে পারে এবং গতি ২৯৩ কিমি/ঘন্টা। অস্ত্র হিসাবে অ্যাপাচি তে রয়েছে একটি ৩০ মিলিমিটার এম২৩০ চেইন গান যা ১২০০ রাইন্ড ফায়ার করতে সক্ষম। এয়ার টু গ্রাউন্ড রকেট হিসাবে রয়েছে ৭০ মিলিমিটারের হাইড্রা ৭০, সিআরভিসেভেন রকেট। মিসাইল হিসাবে রয়েছে এইম ৯২ স্ট্রিংগার মিসাইল এবং লিজেন্ডারি এজিএম ১১৪ হেলফায়ার মিসাইল। তবে বর্তামানে অ্যাপাচি তে ইসরায়েলের তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের স্পাইক মিসাইল ইনস্টল করা হচ্ছে। এছাড়াও অ্যাপাচি এমবিডিএর তৈরি ব্রিমস্টোন অ্যান্টি আর্মর মিসাইল বহন করতে সক্ষম। অ্যপাচির যেটা সবচেয়ে বড় সক্ষমতা যা বিশ্বের অন্য কোন অ্যাটাক হেলিকপ্টার পারে না তাহল অ্যাপাচির পাইলট ড্রোন কন্ট্রোলও করতে পারে। ভবিষ্যতে অ্যাপাচিতে ডাইরেক্ট এনার্জি ওয়েপনস বা লেজার ওয়েপনস যুক্ত করা হবে যা একে আরও ঘাতক করে তুলবে।
এএইচ ৬৪ অ্যাপাচির অন্তত ৮-৯ টি ভার্সন রয়েছে:—-
* এএইচ ৬৪ এ :– একদম প্রথমে এই ভার্সনই তৈরি হয়েছিল। পরে আমেরিকা এই এ ভার্সন গুলো ডি ভার্সনে আপগ্রেড করে নেয়। ২০১২ এর মধ্যে বাকী কিছু এ ভার্সনকে অবসরে পাঠানো হয়।
* এএইচ ৬৪ বি :– ১৯৯১ সালে অপারেশন ডেসার্ট স্ট্রোমের পর সমস্ত এ ভার্সনের অ্যাপচি গুলোকে বি ভার্সনে আপগ্রেড করার কথা বলা হয়েছিল। যারজন্য প্রাথমিক ভাবে ৮২ মিলিয়ন ডলার ফান্ডিং ও দেয়া হয়েছিল কিন্তু ১৯৯২ সালে এই প্রজেক্ট ক্যানসেল হয়ে যায়।
* এএইচ ৬৪ সি:– সি ভার্সন ও ডি ভার্সনের মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে লংবো রেডার যা সি ভার্সনে নেই।
*এএইচ ৬৪ ডি:– এন /এপিজি ৭৮ লংবো রেডার যুক্ত ডি ভার্সনের প্রথম ডেলিভারি হয় ১৯৯৭ সালে। এই অ্যাপাচির রেডার একসাথে ১২৮ টি টার্গেট কে ডিটেক্ট করতে পারে এবং ১৬ টিকে এনগেজ করতে সক্ষম। ডি ভার্সনের উপর বেসড করে ডি বল্ক ২ ও জেপি নামে দুটি ভার্সন তৈরি করা হয়। ব্লক ২ এর প্রথম ডেলিভারি হয় ২০০৩ সালে এবং জেপি ভার্সন এইম ৯২ স্ট্রিংগার এয়ার টু এয়ার মিসাইল বহন করতে সক্ষম।
* এএইচ ৬৪ ই :– ২০১২ সালে তৈরি করা হয় অ্যপাচির এই নতুন ভার্সন যার নাম এএইচ ৬৪ ই গার্ডিয়ান। এতে নতুন, জয়েন্ট ট্যাকটিক্যাল ইনফর্মেশন ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম, আপগ্রেডেড ডিজিটাল সিস্টেম, শক্তিশালী ইঞ্জিন যুক্ত করা হয়। এই ই ভার্সন ড্রোন কন্ট্রোল করতেও সক্ষম। এই ই ভার্সনে একটি নতুন এসা রেডার যুক্ত করা হয়েছে এবং এই ভার্সন মেরিটাইম অপারেশনেও ব্যবহার করা হয়।
* এএইচ ৬৪ এফ:—- অ্যাপাচির সর্বাধুনিক এই এফ ভার্সন, এতে আরও শক্তিশালী ইন্জিন ইনস্টল করা হয়েছে এবং আপগ্রেডেড সেন্সর, অ্যাভনিক্স যুক্ত করা হয়েছে।
অ্যাপাচির গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড :—-
* ১৯৮৯ সালে পানামা ক্যানেল নিয়ে ঝামেলার জন্য অপারেশন যাস্ট কসেঅ্যপাচি হেলিকপ্টার ব্যবহার করে আমেরিকা। এই সময় ২৪০ ঘন্টা ধরে শত্রুর বহু টার্গেট ধ্বংস করে অ্যাপাচি।
* ১৯৯০ সালে সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত আক্রমনের সময় সৌদি আরবে অ্যাপাচি মোতায়েন করে আমেরিকা। এই সময় অপারেশন ডেসার্ট স্ট্রোমে ইরাকের বিরুদ্ধে অংশ নেয় অ্যাপাচি। এই অপারেশনে অপ্যাচি ২৭৮ টি ইরাকি ট্যাংক সহ বহু ইরাকি ভ্যেইকল ধ্বংস করে। ২৭৭ টি অ্যপাচি এই অপারেশনে অংশ নেয় মাত্র একটি অ্যপাচি ধ্বংস হয় এতে।
*২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানে অপারেশন এন্ডিউরিং ফ্রিডমে অংশ নেয় অ্যাপাচি। বহু তালিবান টেরোরিস্ট কে খতম করা হয়।
*২০০৩ সালে অপারেশন ইরাকি ফ্রিডমে অংশ নেয় অ্যাপাচি।
* ২০১১ সালে ইরাকে মিলিটারি অভিযানে অ্যাপচি ব্যবহার করে আমেরিকা।
ভারত প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার বা ২২,০০০ কোটি টাকার বিনিময়ে ২৮ টি অ্যাপাচি হেলিকপ্টার এর অর্ডার দেয় আমেরিকাকে যার মধ্যে ২২ টি বায়ুসেনার জন্য এবং ৬ টি সেনাবাহিনীর জন্য। অলরেডি ২২ টি অ্যাপাচি হেলিকপ্টার ভারতকে ডেলিভারি দিয়ে দিয়েছে আমেরিকা।