ভারত

এখনও প্রচুর সোনা রয়েছে? KGF আসলে কি?

রাজেশ রায়:- বলিউডে একটি খুব সুন্দর গান আছে “মেরে দেশ কে ধাত্রী সোনা উগলে, উগলে হীরে মোতি..”, সত্যিই করেই ভারতের মাটি সোনার, এর সবচেয়ে বড় উদাহারন ডেকান ভূমি। বর্তমানে ভারতের সিনেমাহলে কেজিএফ চ্যাপ্টার ২, চ্যাপ্টার ১ এর থেকে চ্যাপ্টার ২ মানুষকে বেশী আকর্ষন করেছে। রকি ভাইয়ের সমর্থক গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। কর্ণাটক রাজ্যের কোলারে জেলায় সোনার খনির উপর নির্ভর করে এই সিনেমায় যে কাহিনী দেখানো হয়েছে তা নিছকই সিনেমার প্রয়োজনে লেখা। তবে এর আসল কাহিনী সিনেমাকেও হার মানাবে। সাল ১৮০০ থেকে শুরু ২০০০ পর্যন্ত কেমন ছিল কেজিএফ, কারা রাজত্ব করেছে এখানে। প্রশান্ত নীল যে কেজিএফের ডিরেক্টর এই সিনেমায় মানুষের সমস্যা কে খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছে সাথে একটি সামাজিক বার্তাও আছে আজ এব্যাপারেই জানব।

কেজিএফ এর পুরো নাম কোলার গোল্ড ফিল্ডস। কর্নাটক রাজ্যের দক্ষিন পূর্বে ব্যাঙ্গালোর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই কোলার স্বর্নখোনী কে বিশ্বের দ্বিতীয় সবচেয়ে গভীর সোনার খোনী বলা হয়। দক্ষিন আফ্রিকার জোহানসবার্গ শহরের দক্ষিন পশ্চিম দিকে অবস্থিত মোপেং হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে গভীর গোল্ড মাইন, এরপরেই রয়েছে কোলার। এখানে মাটির তিন কিলোমিটার গভীরে সোনা পাওয়া যায়। দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রাকিতিক সম্পদের ভান্ডার বলা হয়। কয়লা, ডায়মন্ড, সোনা সব এখান থেকেই বেশী পাওয়া যায়। ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যও ঠিক এমনই প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। যদি ঝাড়খন্ডের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে ঠিক ভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে ভারতের সব দেনা মিটে যাবে। কয়লা, লোহা যে কোন ধাতুই মাটির গভীরেই পাওয়া যায়। তার জন্য গর্ত খুঁড়তেই হয় যত সম্ভব গভীর পর্যন্ত। কারন মাটির যত গভীরে যাওয়া যায় ততই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং চাপ ও বাড়ে যার জন্য এখানে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় হাজার হাজার বছর ধরে সোনা, ডায়মন্ড, কয়লা তৈরি হয়। দেখুন সৃষ্টির আদিতে আমাদের পৃথিবীও এমন শক্ত ভূভাগ ছিল না। কয়েক লক্ষ বছর ধরে ঠান্ডা ভূভাগের গঠন হয়েছে। একে ক্রাস্ট বলা হয়। মাটির নীচে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার গর্ত খুঁড়লে এসব সোনা, কয়লা পাওয়া যায়। এই ক্রাস্টের পর ধাপে ধাপে ম্যান্টাল, ডি লেয়ার সহ কোর রয়েছে, মাটির নীচে। এই কোর যেকোন গ্রহের জন্য জরুরি কারন এই উপ্তপ্ত কোর গোটা পৃথিবীর চারপাশে শক্তিশালী চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে যাতে সূর্য থেকে ক্ষতিকারক রশ্মি যেমন অতিবেগুনী রশ্মি, ইনফ্রারেড শুষে নেয় এবং জীবন সুরক্ষিত থাকে। যেমন মঙ্গলের কোর ঠান্ডা বলে এখানে জীবন নেই। ভারতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী সোনা আছে তবে তা সরকারের অধীনে নেই যার জন্য কোন ওয়েবসাইটে ভারতের নাম এভাবে পাবেন না বলে বিশেষজ্ঞদের একাংশ।

ভারতে প্রতিবছর এক কোটি বিবাহ হয় গড়ে, এর জন্য ভারতের মহিলাদের কাছে সহ বিভিন্ন মন্দিরে প্রচুর সোনা আছে। শুধু কেজিএফ থেকেই তৎকালীন দিনে প্রায় ৯৫ শতাংশ সোনা পাওয়া যেত। কিন্তু এর সিংহভাগই ব্রিটিশ সরকার নিয়ে গেছে। তবে কেজিএফের কথা বললে ব্রিটিশদের আগে একটু অতীত ও জানা যাক। দেখুন ভারতে দুটি সভ্যাতা ছিল আর্য ও দ্রাবিড় সভ্যতা। দক্ষিন ভারত বরাবরই গোটা উত্তর – পূর্ব ভারত থেকে স্বতন্ত্র ভাবে আলাদা ছিল। দক্ষিন ভারতের রক্তই বিজয় ছিল। দক্ষিন ভারতকে তেমন ভাবে কেউ জিততে পারে নি। আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে দক্ষিণ ভারতের গঙ্গা সাম্রাজ্য প্রথম কেজিএফ আবিষ্কার করে। এর পর চোল সাম্রাজ্যে আসে, তারপর যাদব, পরে নিজাম, মহীশুরের হায়দার আলি ও টিপু সুলতান এভাবে কেজিএফকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোকে শাসন করেছে। এরপর আসা যাক ব্রিটিশদের প্রসঙ্গে। ১৮ শতকের সময়ে, সে সময় কেজিএফ থেকে হাত দিয়েই মাটি খুঁড়ে সোনা বের করত মানুষ। এই খবর যখন ব্রিটিশরা পায় তখন ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট জন বারেন স্থানীয় লোকেদের বলে যদি সোনা তাদের বিক্রি করো তাহলে ভাল দাম পাবে। এজন্য তখন লোক গরুর গাড়ি করে সোনা মেশানো মাটি জন বারেনের কাছে নিয়ে হাজির হত। এভাবে জন বারেন প্রায় ৫৬ কেজি সোনা বের করেছিল।

১৮০৪ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত এভাবেই চলছিল সব, কিন্তু এতে অনেক মানুষ মারা যায় যার জন্য এভাবে সোনা বের করাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু ১৮৭১ তে কেজিএফ এ আবার কাজ শুরু হয়। নিউজিল্যান্ড থেকে ভারতে আসা এক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সেনা মাইকেল লাভেলি কেজিএফের ব্যাপারে বিস্তারিত অনুসন্ধান শুরু করে। কেজিএফের কাছে সবচেয়ে বড় শহর ব্যাঙ্গালোর। তাই লাভেলি ব্যাঙ্গালোর থাকত এবং রিসার্চের জন্য ব্যাঙ্গালোর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে কেজিএফ গরুর গাড়ি করে যেত। দুই বছর রিসার্চ করার পর পুরো সোনার খনির সঠিল অবস্থান লাভেলি বুঝতে পারে। তখন তিনি মহীশুরের রাজার কাছ থেকে এখানে কাজ করার লাইসেন্স চান। ১৮৭৫ তে জন টেলর নামে এক বিনিয়োগকারীর সাথে যৌথভাবে এখানে মাইনিং শুরু হয়। জন টেলর ১৮৮৮ সালে পুরো মাইনিং ব্যবস্থা নিজের দায়িত্বে নিয়ে নেয়। ১৮৯০ সালে তার লাগানো মাইনিং মেশিন ১৯৯০ পর্যন্ত অর্থাৎ ১০০ বছর চলে। ১৯০২ সালে কেজিএফ একাই ভারতের ৯৫ শতাংশ সোনা উত্তোলন করত। ১৯০৫ সালে ভারত বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম সোনা উত্তোলনকারী দেশে পরিনত হয়। এই সময় মাইনিং করা সবচেয়ে কষ্টকর ছিল কারন ইলেকট্রিসিটি ছিল না তেমন, শুধু কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় আলো জ্বলত কিছু, লিফটও ছিল না তখন। যার জন্য মাঝে মাঝেই দুর্ঘটনা ঘটত।

১৮৮০-২০০০ অবধি এখানে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রায় ছয় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দেখুন মাইনিং সবচেয়ে কঠিন কাজ। সোনার খনীতে মাইনিং এর জন্য বিষাক্ত সায়নাইড গ্যাস ব্যবহার করা হয় যাতে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। কেজিএফ ছবিতে এটাই দেখানো হয়েছে। রকি ভাই বা যশের মাও এই ভাবেই মারা গেছে। সোনার খনীতে কাজ করা শ্রমিকদের কথা কোনওদিন কেউ ভাবে নি। কেজিএফ ছবিতে যেমন দেখানো হয়েছে তেমনই ছোট ছোট ঘরে শ্রমিকরা থাকত। যাই হোক লাইটের সমস্যা দূর করার জন্য কর্নাটকের মান্ডিয়া জেলায় প্রথম পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করা হয়, কেজিএফ থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে এই কাবেরী বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হয়। এটি এশিয়ার দ্বিতীয় ও ভারতের প্রথম বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল। এরপর কেজিএফে কাজের গতি দ্বিগুন হয়ে যায়। মহিশূর, ব্যাঙ্গালোরকে ছেড়ে কেজিএফের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। বিশ্বের অনেক জায়গা বিশেষ করে ইংল্যান্ড থেকে ধনী ব্যাক্তিরা এসে এখানে বাড়ি তৈরি করে। পুরো এলাকার প্রচুর ডেভলপমেন্ট হয়। যার জন্য একে মিনি ইংল্যান্ড ও বলা হত। ১৯৩০ সালে কেজিএফে প্রায় ৩০,০০০ লোক মাইনিং এর কাজ করত। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত কেজিএফ ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। ১৯৫৬ সালে ভারত সরকার কেজিএফ ভারত সরকার নিয়ন্ত্রনে নেয় এবং বেশ কিছু মাইনিং স্থানীয় সরকারকে দিয়ে দেওয়া হয়। তবে ধীরে ধীরে কেজিএফে সোনার পরিমান কমতে থাকে। ১৯৭৯ সালে কেজিএফে সোনার পরিমান আরও কমে আসে, অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে কর্মচারীদের মাইনে দেওয়াও সম্ভব হচ্ছিল না। যার জন্য ২০০১ সালে কেজিএফ বন্ধ করে দেওয়া হয় পুরো। ১৮৮০ সাল থেকে ২০০০ সাল অবধি প্রায় ৯০০ টন সোনা পাওয়া গেছে কেজিএফ থেকে যার দাম প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা। এর বেশীরভাগই পেয়েছে ব্রিটিশ সরকার।

তবে বলা হয় এখনও কেজিএফে যা সোনা আছে তা দিয়ে গোটা ভারতের ধার শোধ করা সম্ভব হবে। ১৯০৫ সালে ভারত আমদানি করতই না তেমন কারন কেজিএফে প্রচুর সোনা পাওয়া যেত। তবে এখন সোনা উত্তোলন করতে যা খরচ পড়বে তার থেকে সোনার দাম কম হবে তাই কেজিএফকে বন্ধই রাখা হয়েছে। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার ইঙ্গিত দিয়েছিল পুনরায় কেজিএফ চালু করার কিন্তু এবিষয়ে পরে আর কোনও কথা শোনা যায় নি বলে মত বিশেষজ্ঞদের একাংশের। তবে ভারত যে পরিমান সোনা আমদানি করে তার জন্য কেজিএফের নতুন করে খোলা দরকার। ডাটা অনুযায়ী ২০২১ এ ভারত ১০৬৭.৭২ টন সোনা আমদানি করেছে। ভারত যে পাচটি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশী সোনা কেনে তার মধ্যে সবার উপরে আছে সুইজারল্যান্ড, এখান থেকে ৫৬.৭ শতাংশ সোনা আসে, এরপর হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ১১.৩ শতাংশ সোনা আসে এখান থেকে, তারপর আমেরিকা ৫.৮ শতাংশ, এরপর ঘানা ৫.৬ শতাংশ এবং সবশেষে দক্ষিণ আফ্রিকা, এখান থেকে ৫.২ শতাংশ সোনা আনদানি করে ভারত। যদি কেজিএফ নতুন করে খোলা হয় তাহলে এক্ষেত্রে ভারতের চাহিদা অনেকটাই মিটবে। আগেই বলা হয়েছে ভারতের মহিলাদের কাছে ও মন্দিরে সবচেয়ে বেশী সোনা আছে, বিশেষ করে দক্ষিন ভারতের মন্দির গুলোতে। একটি তথ্য অনুযায়ী এর পরিমান প্রায় ২৪ -২৫ হাজার টন! যার বাজারমূল্য ৭০ লাখ কোটি বা ১ ট্রিলিয়ন ডলার! ২০৩০ এর মধ্যে ভারতের অর্থনীতি ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের লক্ষ নেওয়া হয়েছে তার পাচ ভাগের এক ভাগ তো শুধু সোনাই রয়েছে ভারতের কাছে তবে এগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রনে নেই। যার জন্য ভারতকে একটা সময় “সোনে কী চিড়িয়া” বলা হত।

Leave a Reply

Your email address will not be published.