পৃথিবীর ভূভাগ যা আবিষ্কারের আগেই তার নামকরন করে দেওয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস
বহু শতাব্দী ধরে বিশ্বের বেশীরভাগ মানুষ শুধু পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ সম্পর্কেই জানতো। বিশ্বের বেশীরভাগ দেশও উত্তর গোলার্ধেই অবস্থিত। একটা সময় ইউরোপের মানুষের কাছে পৃথিবীর দক্ষিন গোলার্ধে কী আছে তার সম্পর্কে কোনও তথ্যই ছিলনা। সেসময় ওশিয়ানিয়া মহাদেশ অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং অ্যান্টার্কটিকা আবিষ্কারও হয়নি। সেসময় অনেক মানুষের ধারনা ছিল পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে ওজন বেশী হয়ে গেলে পৃথিবী উল্টে যেতে পারে এবং মানুষ এটাও বিশ্বাস করতো পৃথিবীর ওজনের সমতা বজায় রাখতে দক্ষিন গোলার্ধে বিশাল কোনও পর্বতময় ভূমি আছে। সেসময়কার মানুষের এমন বিশ্বাসের কোনও বৈজ্ঞানিক কারন ছিলনা কিন্তু তবুও অনেক ইউরোপীয়ন ভৌগোলিক দক্ষিন গোলার্ধের এই কাল্পনিক ভূখন্ডের নাম দিয়েছিল টেরা অস্ট্রালিস ইনকগনিটা। ল্যাটিন ভাষায় এই নামের অর্থ অজানা দক্ষিন ভূখন্ড। দক্ষিন গোলার্ধ পৃথিবীর প্রথম কোনও ভূভাগ যা আবিষ্কারের আগেই তার নামকরন করে দেওয়া হয়। সময়ের সাথে সাথে অস্ট্রালিস শব্দ পরিবর্তিত হয়ে অস্ট্রেলিয়া হয়ে যায়। প্রায় হাজার বছর ধরে ইউরোপীয়ানদের কাছে সম্পূর্ন অজানা ছিল অস্ট্রেলিয়া দেশ এবং এখানকার মানুষজন। একদিন এক ব্রিটিশ ব্যক্তি ক্যাপ্টেন জেমস কুক খুঁজে পায় এই অজানা দেশ অস্ট্রেলিয়া। তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন এক সম্পূর্ন নতুন বিশ্ব।
ক্যাপ্টেন জেমস কুক যখন ইংল্যান্ড থেকে রওনা হয়েছিলেন তখন তার উদ্দেশ্য ছিলনা টেরা অস্ট্রালিস ইনকগনিটা যাওয়া। ইংল্যান্ডের নৌবাহিনীর জাহাজ এইচএমএস এন্ডেউভার জাহাজ নিয়ে রওনা হয়েছিলেন ক্যাপ্টেন জেমস কুক একটি বৈজ্ঞানিক গবেষনার জন্য। আসলে ১৭৬৯ সালের জুন মাসে শুক্র গ্রহের ট্রানজিট ছিল। সূর্যের চারদিকে সমস্ত গ্রহ গুলো নিজস্ব কক্ষপথে আবর্তন করে, আবর্তন কালে একটি নির্দিষ্ট সময় শুক্র গ্রহ সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে থাকা বুধ গ্রহের সাথে এক সরলরেখায় চলে আসে, তখন সূর্যের দিকে শুক্র গ্রহকে দেখতে একটি কালো বিন্দুর মতো লাগে, একেই শুক্র গ্রহের ট্রানজিট বলা হয়।
প্রতি ২৪৩ বছর অন্তর দুবার এরকম বিরল ঘটনা ঘটে। ১৭৬৯ সালে মহাকাশ বিজ্ঞান এতটা আধুনিক না হলেও তখনকার মহাকাশ বিজ্ঞানে সৌরমন্ডল সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারনা ছিল। সেকারনে বিজ্ঞানীরা জানতো ১৭৬৯ সালের জুন মাসে শুক্র গ্রহের এই ট্রানজিট দেখা যাবে দক্ষিন প্রশান্ত মহাসাগরের তাহিটি দ্বীপে। বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য ছিল এই ট্রানজিটের মাধ্যমে সূর্য থেকে গ্রহ গুলোর দূরত্ব নির্নয় করা। সেসময় বৈজ্ঞানিকরা জানতো সৌরমণ্ডলে ছয়টি গ্রহ আছে, ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটো গ্রহ তখনও আবিষ্কার হয়নি। বিজ্ঞানীরা জানতো পৃথিবী ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যে দূরত্ব পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে দূরত্বের থেকে পাঁচ গুন বেশী। কিন্তু কিলোমিটার হিসাবে এটার মান কত তা জানা ছিলনা। এসব জানার জন্য ক্যাপ্টেন জেমস কুকের সাথে চারজন বিজ্ঞানীকে এন্ডেউভার জাহাজে করে তাহিটি দ্বীপে পাঠানো হয়।
ইংল্যান্ডের নৌবাহিনী জেমস কুককে একটি সীল করা বিশেষ চিঠি দিয়েছিল এবং নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তাহিটি দ্বীপে মিশন সম্পন্ন হওয়ার পর এটি খুলে দেখতে। তাহিটি দ্বীপে শুক্র গ্রহের ট্রানজিট পরীক্ষন মিশন সফল ভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর জেমস কুক সীল খুলে চিঠিটা পড়ে, চিঠিতে ইংল্যান্ডের নৌবাহিনী জেমস কুককে নির্দেশ দিয়েছিল ইংল্যান্ড ফেরার আগে দক্ষিন গোলার্ধে কোনও নতুন স্থলভাগ খুঁজে তা ব্রিটেনের রাজার জন্য দখল করতে হবে। জেমস কুক ও তার দল পরবর্তী মিশনের জন্য বেড়িয়ে পড়ে। ১৭৬৯ সালেরই অক্টোবর মাসে নিউজিল্যান্ড এসে উপস্থিত হয় যা ইউরোপীয়ানদের জন্য একটি সম্পূর্ন নতুন ভূমি ছিল। সেসময় নিউজিল্যান্ডে মাউরি উপজাতি সম্প্রদায় বসবাস করতো।
নিউজিল্যান্ড পৌঁছেই জেমস কুক সেখানে ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় পতাকা উত্তোলন করে নিউজিল্যান্ডে ব্রিটেনের অধিকার ঘোষনা করে। এরপর জেমস কুক তার অভিযান আবারও শুরু করে। ১৭৭০ সালের এপ্রিল মাসে অবশেষে বহু চর্চিত টেরা অস্ট্রালিস ইনকগনিটায় এসে পৌঁছায় জেমস কুক। ক্যাপ্টেন জেমস কুকই প্রথম ইউরোপীয়ান ব্যক্তি যিনি এই ভূখন্ড পা রাখে। এখনে পৌঁছেও তিনি ইংল্যান্ডের পতাকা উত্তোলন করে এই ভূমিতে ইংল্যান্ডের অধিকার ঘোষনা করেন। তবে ক্যাপ্টেন জেমস কুকের অস্ট্রেলিয়া খুঁজে পাওয়ার আগেও এশিয়ার অধিবাসীরা অস্ট্রেলিয়া খুঁজে পেয়েছিল। বলা হয় প্রায় পঞ্চাশ হাজার বছর আগে এশিয়া মহাদেশের কিছু অধিবাসী অস্ট্রেলিয়া এসে উপস্থিত হয়। আসলে আজ থেকে প্রায় কয়েক লাখ বছর আগে প্লাইস্টোসেন নামে শেষ শীতল যুগের সময় নিরক্ষীয় অঞ্চলে সমুদ্র বরফে পরিনত হয় এবং সমুদ্রের নীচের ভূমি উপরে উঠে আসে উপরে। তখন এশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত একটি স্থলপথ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যদিও সে পথের মাঝেমধ্যে বরফ অনেক পাতলা ছিল এবং নীচে সমুদ্র ছিল। বলা হয় সেই পথ ধরেই পরবর্তী কালে এশিয়ান আদি অধিবাসীদের একটা দল অস্ট্রেলিয়া এসে পৌঁছায়। তবে শীতল যুগ শেষ হওয়ার পর পুনরায় সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পায় এবং অস্ট্রেলিয়া পুনরায় এশিয়ার মূল ভূভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপে পরিনত হয়। তবে জেমস কুকের অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের প্রায় ১২৬ বছর আগে ১৬৪৪ সালে নেদারল্যান্ডসের একজন সামুদ্রিক অভিযাত্রী আবেল জ্যানসজুন তাসমান অস্ট্রেলিয়ার পুরো প্রদক্ষিন করে অস্ট্রেলিয়ার পাশে ছোট একটি দ্বীপে পৌঁছায় যা আজ অস্ট্রেলিয়ারই অংশ। আবেল জ্যানসুজন এই দ্বীপের নাম দেয় তাসমানিয়া। এই হিসাবে দেখতে গেলে আবেল জ্যানসজুন তাসমানই সর্বপ্রথম অস্ট্রেলিয়া খুঁজে পায়। তখন থেকে অস্ট্রেলিয়াকে নিউ হল্যান্ড বলা হত। উনবিংশ শতকের প্রথমদিক পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়াকে নিউ হল্যান্ডই বলা হত। ১৮১৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে অস্ট্রেলিয়া নাম ব্যবহার শুরু হয়।
ক্যাপ্টেন জেমস কুক যখন ব্রিটেন ফিরে যায় তখন তার নির্দেশিত পথে আরও ইংল্যান্ডের লোক অস্ট্রেলিয়া এসে উপস্থিত হয় এবং ধীরে ধীরে অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডের উপনিবেশে পরিনত হয়। তবে প্রথম দিকে ব্রিটেন কয়েদিদেরই অস্ট্রেলিয়া পাঠাতো। অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের আগে ব্রিটেন তাদের কয়েদিদের আমেরিকায় নির্বাসনে পাঠাতো কিন্তু আমেরিকা স্বাধীন হওয়ার পর ব্রিটিশরা তাদের কয়েদিদের অস্ট্রেলিয়া পাঠাতে থাকে। তবে ১৮৫০ সালের পর পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়।
১৮৫১ সালে অস্ট্রেলিয়াতে সোনার খনি আবিষ্কারের পর থেকে ইংল্যান্ড থেকে সাধারন মানুষ, ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক নেতারাও অস্ট্রেলিয়া আসা শুরু করে। অস্ট্রেলিয়াতে ব্রিটিশদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্রিটিশরা ধীরে ধীরে অস্ট্রেলিয়ার মূল নিবাসিদের তাদের জায়গা থেকেই হটানো শুরু করে। ঠিক এভাবেই আমেরিকার আদি অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের তাদের ভূমি থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ব্রিটিশরা প্রথমে নিউ ওয়েলস নামে একটি শহর তৈরি করেছিল অস্ট্রেলিয়াতে, এরপর ধীরে ধীরে তারা যখন অস্ট্রেলিয়ার আরও ভিতরে প্রবেশ শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসীদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয় তাদের। তবে ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে সহজেই পরাজিত হয় তারা। উপরন্তু ব্রিটিশদের থেকে একাধিক রোগ বিশেষ করে স্মল পক্স ছড়িয়ে পড়ে যাতে অস্ট্রেলিয়ার প্রচুর আদি অধিবাসীর মৃত্যু হয়। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে আদি অধিবাসীদের সংখ্যা খুবই কম। কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার সরকার অস্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসী অ্যাবরজিনিসদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এই ঘটনার জন্য।
১৯০১ সালের ১ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার ছয়টি প্রদেশ তাসমানিয়া, নিউ সাউথ ওয়েলস, ভিক্টোরিয়া, কুইন্সল্যান্ড, দক্ষিন অস্ট্রেলিয়া ও পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া একত্রিত হয়ে অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেশন গঠন করে। ব্রিটিশ সংসদ ভবন অস্ট্রেলিয়া দেশের স্বীকৃতি দেয়। তবে তখনও অস্ট্রেলিয়াব বৈদেশিক নীতি, সুরক্ষা সবই ব্রিটেনের হাতেই ছিল কারন ব্রিটেন সেসময় বিশ্বের একটি সুপার পাওয়ার দেশ ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে বিশেষ করে ১৯৪১ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়া আমেরিকাকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করে কারন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো প্রায় ধ্বংস হয়ে যায় এবং বিশাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরও পতনের সূচনা হয়ে যায়, সেসময় সুপার পাওয়ার হিসাবে আমেরিকার উত্থান ঘটে।
১৯৮৬ সালের ৩ মার্চ ব্রিটেনের কাছ থেকে সম্পূর্ন রূপে মুক্ত হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় পশু বলা হয় ক্যাঙ্গারুকে তবে এর পেছনেও একটি গল্প আছে। বলা হয় জেমস কুক যখন অস্ট্রেলিয়াতে যায় তখন তিনি ক্যাঙ্গারু কি জানতেন না, ক্যাঙ্গারুকে দেখে জেমস কুক একজন অস্ট্রেলিয়ান অধিবাসীকে জিজ্ঞেস করেন এটা কী, সেই অধিবাসীটি জেমস কুককে বলেন ক্যাঙ্গারু যা নিজের ডায়রিতে লিখে রাখে জেমস কুক। পরে একটি গবেষনায় জানা যায় অস্ট্রেলিয়ার ওই অধিবাসী জেমস কুককে যে ক্যাঙ্গারু কথা বলে সেটার অর্থ কালো প্রানী। অস্ট্রেলিয়ার মূল অধিবাসীরা কালো ক্যাঙ্গারুকে গুনগুরু বলে এবং এটাও বলা হয় ক্যাপ্টেন জেমস কুক সেই গুনগুরু শব্দ ভুল করে ক্যাঙ্গারু শোনে। তবে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় প্রানী হিসাবে ক্যাঙ্গারুকে বেছে নেওয়া হয় কারন ক্যাঙ্গারু কোনওদিন পেছনে চলতে পারেনা শুধু সামনে এগিয়ে যায়। সেকারনে অস্ট্রেলিয়ার ক্রমবর্ধমান উন্নতির প্রতীক হিসাবে ক্যাঙ্গারুকে বেছে নেওয়া হয় এবং ক্যাঙ্গারু অস্ট্রেলিয়াতেই সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায়।