ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে গোটা পৃথিবীতে দাদাগিরি করার চেষ্টা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
নিজস্ব সংবাদদাতা:এতদিন পারমানবিক বোমা সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল বিশ্বে। এখন সন্ত্রাসের অপর নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে অপারমাণবিক বোমা। এবারেও সূচনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর ম্যাসিভ অর্ডিনেন্স এয়ার ব্লাস্ট মোয়াব বা জিইউবি-৪৩/বি তে অত্যন্ত বিস্ফোরক যে ভয়ঙ্কর বোমাগুলি রয়েছে জানা যাচ্ছে ওগুলোই হলো অপারমাণবিক বোমা। মার্কিন সমরবিদেরা বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও সর্বশক্তিশালী এই অপারমাণবিক বোমাকেই ‘মাদার অব অল বোম্বস’ নামে প্রচার করছে। জানলে অবাক হবেন পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে ১১ টন টিএনটি ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর কাছে থাকা বিশেষ ভাবে তৈরি জিইউবি-৪৩/বি বা মোয়াব। ‘মাদার অব অল বোম্বস’ নিয়ে প্রচার করে এক ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে এই ভয়কে কাজে লাগিয়েই গোটা বিশ্বে দাদাগিরি ফলাচ্ছে আমেরিকা।
আন্তর্জাতিক এক গণমাধ্যম সূত্রের রিপোর্টে জানা গেছে এই সব কিছুর সূচনা হয়েছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৩৯ সালের ২ আগস্ট বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে একটি চিঠি লিখে পরমাণু বোমা তৈরির জন্য অর্থ বরাদ্দ করার অনুরোধ করেছিলেন। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন সেই সময় আইনস্টাইনের অনুরোধে রুজভেল্ট যদি ওই বিপুল পরিমাণ অর্থ পরমাণু বোমা তৈরির জন্য বরাদ্দ না করতেন তবে আজ ইতিহাস হতে পারতো অনেকটাই আলাদা। হিটলারের প্রতি ঘৃণা থেকে যারা এই পরমাণু গবেষণায় অংশ নেন তাদের বেশিরভাগই ছিলেন ইহুদি বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানীদের সহায়তায় পরমাণু বোমা তৈরি যখন শেষের পথে সেই সময় ১৯৪৫ সালের ১২ এপ্রিল মারা যান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। তার বদলে দায়িত্ব নেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান। তিনি ক্ষমতায় এসেই সদ্য তৈরি পরমাণু বোমা যুদ্ধরত জাপানের ওপর নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিলে ওই একই বছরের ৬ আগস্ট প্রথম পরমাণু বোমাটি নিক্ষেপ করা হয় জাপানের হিরোশিমা শহরে। এই ভয়াবহতা থেকে বেরোনোর আগেই ১৩ দিনের মাথাতে পুনরায় জাপানের নাগাসাকি শহরে পুনরায় পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিঃশর্ত ভাবে আত্মসমর্পণ করে জাপান। এরপর দীর্ঘ বহু বছর ধরে পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জর্জরিত হয়ে থেকেছে জাপান। কিন্তু পারমানবিক বোমা মানবজাতির ক্ষেত্রে কতটা ভয়ঙ্কর তা জানার পরও বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি পাল্টায় নি। দিন দিন সেই বেড়েই চলেছে পারমাণবিক বোমার সংখ্যা। তবে, এখন চিন্তা আরো বেশি বাড়াচ্ছে অপারমানবিক বোমা। পারমাণবিক উপাদান না থাকার ফলে এই বোমা যেমন সহজে বহনযোগ্য তেমন এটি ব্যবহারের অনুমতি ও মেলে সহজে। কিন্তু ভয়ের ব্যাপার হলো এর ক্ষমতা আরো মারাত্মক।
এই গোটা প্রজেক্টর সারা হয়েছে অত্যন্ত গোপনে। ২০০২ সালে প্রথমবার ম্যাসিভ অর্ডিনেন্স এয়ার ব্লাস্ট (মোয়াব) জিইউবি-৪৩/বি “মাদার অব অল বোম্বস” এর ডিজাইন তৈরি করা হয় এবং তার পরের বছরই অর্থাৎ ২০০৩ সালে গোপনে বাকি বিশ্বের চোখ এড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার ফোর্স রিসার্চ ল্যাবরেটরি ম্যাকলেস্টার আর্মি এমুনিউশন প্লান্টে এই বোমার উৎপাদন শুরু হয়ে যায়। সূত্রের খবর খুব সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো পর্যন্ত মাত্র ৩০টি হাই এক্সপ্লুসিভ নন-নিউক্লিয়ার (মোয়াব) তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। অপরদিকে আমেরিকার “মাদার অব অল বোম্বস” তৈরির খবর সামনে আসতেই অপর সুপার পাওয়ার এবং আমেরিকার শত্রু দেশ রাশিয়া তাদের কাছে উল্টে ১৫ টন ওজনের বিশ্বের সর্ববৃহৎ অপারমানবিক বোমা থাকার দাবি জানিয়েছে। তবে,“ফাদার অফ অল বোম্বস” নামে প্রচার করা এই বোমা তারা সত্যিই তৈরি করতে পেরেছে কিনা তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মনে রয়েছে যথেষ্ট সন্দেহ। রাশিয়ান এই বোমা নিয়ে যতোই সন্দেহ থাকুক তবে আমেরিকার তৈরি শক্তিশালী বোম যে সত্যিই যুদ্ধের দিক ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম তা নিয়ে নেই কোনো দ্বিমত। আসুন জেনে নেওয়া যাক এর বিশেষত্বগুলি। সি-১৩০ হারকিউলিকস/এমসি-১৩০এইচ সামরিক পরিবহণ বিমান থেকে নিক্ষেপের উপযোগী ভাবে তৈরি এই বিমানে রয়েছে ৯,৮০০ কেজি বা ২১,৬০০ পাউন্ড ওজন বিশিষ্ট ম্যাসিভ অর্ডিনেন্স এয়ার ব্লাস্ট (মোয়াব) জিইউবি-৪৩/বি কে। ৯.৮৮৫ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১০৩ সেন্টিমিটার ব্যাস বিশিষ্ট মোয়াব ভয়ঙ্কর ১১ টন টিএনটি বিস্ফোরক ক্ষমতাবিশিষ্ট। যার ফলে সাধারণ বোমা তো ছাড়ুন বিশ্বের যে কোন অপারমানবিক বোমাও এর কাছে নেহাতই তুচ্ছ। এর উৎপাদন খরচও নেহাত কম নয় কিন্তু। প্রতি ইউনিট মোয়াব উৎপাদনের জন্য খরচ প্রায় ২.২৫ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
মোয়াব বিস্ফোরণ ঘটলে তার ফলে প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকা ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। এতটা ভয়ঙ্কর এই বোম যে বিস্ফোরণের ফলে এটি সৃষ্টি করতে পারে প্রবল ভূমিকম্পের মতো এক শক ওয়েভ। মোয়াবের আঘাতে এক মাইলের মধ্যে থাকা যে কোনো বাড়ি ঘর, স্থাপনা, যানবাহণ সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে এক নিমেষে। সেই সঙ্গে এতটাই ভয়ঙ্কর এর ক্ষমতা যে মাটির ৩০০ ফুট নিচে অবস্থিত ব্যাংকার অব্দি ধ্বংস করে দিতে পারে এটি। এক দিকে মোয়াবের শক ওয়েভের আঘাতে ১.৭ মাইল অঞ্চলের মধ্যে থাকা যেকোনো প্রাণীর মৃত্যু যেমন একদম নিশ্চিত তেমনি দুই মাইল পর্যন্ত এলাকার মধ্যে থাকা মানুষের শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে মারাত্বক ভাবে।
দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী ম্যাসিভ অর্ডিনেন্স এয়ার ব্লাস্ট (মোয়াব) জিইউবি-৪৩/বি অর্থাৎ “মাদার অব অল বোম্বস” নিয়ে গোপনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেও কখনই যুদ্ধক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করেনি। কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় এলে। সামরিক নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়ে ২০১৭ সালের ৩ই এপ্রিল প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানে আইএস জঙ্গির ডেরাই মোয়াব নিক্ষেপ করা হয় তার নির্দেশে। আর জঙ্গিদের ওপর এই আক্রমণের মাধ্যমেই নিজেদের নতুন সামরিক ক্ষমতার কথা বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত করে আমেরিকা।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মোয়াব আক্রমনে তাৎক্ষনিক ভাবে ৯৪ জঙ্গিসহ মারা যান শতাধিক নির্দোষ মানুষ। তাছাড়া, মোয়াব শুধুমাত্র যে আফগানিস্তানে জঙ্গি দমনে ব্যবহার করা হয়েছে তা কিন্তু নয়। আসলে মোয়াব প্রকাশ্যে আনার পেছনে মার্কিন প্রশাসনের ছিল এক অন্য কারণ। কার্যত রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া ও ইরানকে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করলো আমেরিকা যে ভবিষ্যতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে কোনো রকম দ্বিধা না করেই মার্কিন বাহিনী মোয়াব বা এর চেয়েও ভয়ঙ্কর অস্ত্র প্রয়োগে করবে। এভাবেই পরস্পরের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে সামরিক ক্ষমতা সম্পন্ন প্রথম সারির দেশগুলো বিশ্বের বুকে শান্তি স্থাপন করতে না পারলেও ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র তৈরি করে মানব জাতিকে ধ্বংস এবং মানবতাকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করার কৌশল ক্রমশ আয়ত্ত করছে।