বীণা দেবীর মতো স্বাধীনতা সংগ্রামে ৩ বাঙালি নারীর অবদান
নিউজ ডেস্কঃ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন নারীরাও। দিয়েছিলেন নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে দেশের জন্য। তা সত্ত্বেও সংগ্রামী নারী হিসাবে হাতে গোনা কয়েকটি নাম আমরা বলতে পারব। এই হাতে গোনা জানা নামের বাইরেও এমন অনেক নাম আছে যারা দেশের জন্য চালিয়ে গেছে যুদ্ধ। কিন্তু তাদের নাম এবং তাদের সম্পর্কে তথ্য নেই এই স্বাধীন ভারতে থাকা বেশিরভাগ মানুষজনের কাছে। যাদের হারিয়ে ফেলছি ইতিহাসের পাতায়। তাদের মধ্যে অন্যতম বাঙালি ৩ স্বাধীনতা সংগ্রামী নারীরা হলেন-
ননিবালা দেবী :
১৮৮৮ সালে হাওড়ার বালিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ননিবালা দেবী। তার খুবই অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিধবা হন তিনি। এরপর তিনি চলে যান বাবার কাছে। এরপর থেকে আস্তে আস্তে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে ঝুঁকতে থাকেন।
অমরেন্দ্র চ্যাটার্জীর কাছে থেকে ১৯১৫ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী হওয়ার দিক্ষা নিয়েছিলেন ননিবালা দেবী। বিপ্লবীদের তিনি রিষড়া ও চন্দননগরে ভাড়াবাড়িতে আশ্রয় দিতেন। এছাড়াও ১৯১৫ সালে রামচন্দ্র বাবুর স্ত্রী সেজে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে জেলে গিয়ে আলিপুর জেলে বন্দি বিপ্লবী রামচন্দ্র মজুমদারের কাছ থেকে পিস্তলের খোঁজ সহ গোপন তথ্য নিয়ে আসতেন। প্রেসিডেন্সি জেলে তিনি ১৯১৯ সাল পর্যন্ত বন্দী ছিলেন। বাঙালি বিপ্লবীর পাশাপাশি ননীবালা দেবী ছিলেন প্রথম মহিলা রাজবন্দি। তবে শেষ জীবন তার খুবই অবহেলার সাথে কেটেছিল। তাঁর শেষ জীবনে তাকে কেউ আশ্রয় দিতেন না পুলিশের ভয়ে। তাঁর জীবনের নিত্য সঙ্গী হয়ে ওঠেছিল কষ্ট ও দরিদ্রতা।
সরকারের কাছ থেকে সাহায্য হিসাবে তিনি পেয়েছিলেন পঞ্চাশের দশকে পঞ্চাশ টাকা করে পেনশন। বাংলার প্রথম মহিলা স্টেট প্রিজনার ছিলেন ননিবালা দেবী। মৃত্যুর সঠিক তথ্য না পাওয়া অনুমান করা হয় যে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে তিনি মৃত্যুবরন করেছিলেন।
আভা দে : আভা দে এমন এক নারী যিনি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো পুরুষের থেকে কোন অংশে কম ছিলেন। তাঁর সাহস ও শারীরিক শক্তির জোরে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে দেশের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। সাঁতার কাটা থেকে শুরু করে দৌঁড়ানো, গাছে ওঠা, সাইকেল চালানো সমস্ত কাজেই পারদর্শী ছিলেন তিনি। ওই সময় একবার ছাত্রীসংঘ থেকে সাইকেল প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়। সেই প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে কলকাতা থেকে বর্ধমান পর্যন্ত প্রায় ১০০ কিমিরও বেশি পথ সাইকেল চালিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।
তিনি ব্রিটিশদের আইন অমান্য করে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৩০ সালে যোগ দেন ব্রিটিশ আইন অমান্য আন্দোলন-এ। যুক্ত হন নারী সত্যাগ্রহ সমিতির সাথে। এরপর তিনি বে-আইনি শোভাযাত্রা ও সভায় যোগদান করার জন্য জেলেও গিয়েছিলেন ওই বছর। তিনি অত্যন্ত সাহসী এবং রাজনৈতিকভাবে অনেক দৃঢ় ছিলেন। ১৯৩২ সালে জনসভা ভাঙ্গার উদ্দেশ্যে পুলিশের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেন এবং এক মহিলাকে বাঁচান। যার কারনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
দেশের জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে চালিয়ে গেছে ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার আন্দোলন। এইরকম এক বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী নারীর জন্মকাল, জন্মস্থান সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য জানা যায় নি। এমনকি দারিদ্রের পীড়নে কতখানি পীড়িত ছিলেন তা কেউ জানতো না। তবে জানা যায় যে এমনও নাকি অনেক দিন অতিবাহিত হয়েছে যখন তিনি গোটা দিন দু চার পয়সায় তেলে ভাজা খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে জানা গিয়েছে যে ১৯৩৮ সালে তিনি দারিদ্রের মধ্যে নিতান্ত অবহেলায় বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন।
বীণা দেবী- ১৯১১ সালের ২৪শে অগাস্ট কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবের নেত্রী বীণা দাস। তাঁর পিতা ছিলেন বেণী মাধব দাস যিনি একজন ব্রাহ্মসমাজী পণ্ডিত ও দেশপ্রেমিক ছিলেন এবং তাঁর মাতার নাম ছিল সরলা দাস যিনি নিঃস্ব ও অসহায় মহিলাদের সাহায্যার্থে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সরলা পুণাশ্রম।
‘ভারত পথিক’ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর লেখা এই বইয়ের মাধ্যমে জানা যায় যে র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে পড়াকালীন তিনি বেণীমাধব দাসের ছাত্র ছিলেন। তখন থেকেই তিনি দেশপ্রেমের অমোচনীয় দাগ কেটে গেছেন সুভাষের মনে।
ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনৈতিক মনস্ক হয়ে ওঠেন। ওই সময় তিনি যুগান্তর দলের সংস্পর্শে আসেন। ১৯২৮ সালে বেথুন কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে তিনি আন্দোলন করেছিলেন সাইমন কমিশন বয়কট করার উদ্দেশ্যে। ১৯৩০ সালে তিনি ছোট ছোট দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লর্ড ডালহৌসির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য এবং গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এরপর ১৯৩২ সালে ৬ই ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেন বীণা দাস। কিন্তু রক্ষা পেয়ে যান জ্যাকসন। স্ট্যানলি জ্যাকসনকে হত্যা প্রচেষ্টায় তাঁকে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দান করেছিলেন।