ভারত

জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু প্রভাব ফেলবে ভারতবর্ষের উপর

রাজেশ রায়:— ১৮৯৩ সালে বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে যাওয়ার সময় স্বামী বিবেকানন্দ জাপান ভ্রমন করেন। এর চারবছর পর দ্য হিন্দু কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন জাপানের মত প্যাট্রিয়টিক ও শৈল্পিক দেশ খুবই কম আছে। জাপানের এই উন্নতির পেছনে জাপানের মানুষের বিশ্বাস ও দেশপ্রেম রয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দজীর ধারনা ছিল জাপানের সমাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আত্মবলিদান এবং ঐক্যের উপর ভিত্তি করে ভারতও এমন দেশ হতে পারবে। শুধু তিনিই নন আরও দুজন মহান ভারতীয় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও জাপানের উপর প্রভাবিত ছিলেন। এর এগারো দশক পর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো সম্মেলনের একটি কথাকে কোট করে বলেছিলেন বিশ্বের ভারতের সবচেয়ে বড় অবদান তার সহ্যশক্তি। শিনজো আবের কাছে ভারত কোন সাধারন দেশ ছিল না, উনি ওনার দাদু এবং প্রাক্তন জাপানী প্রধানমন্ত্রী নবোসুকে কিসির উত্তরাধিকারি ছিলেন। গত আট জুলাই জাপানের এক ছোট শহর নারাতে এক সভায় ভাষনের সময় ওনার উপর গুলি চালানো হয় যাতে ওনার মৃত্যু হয়। সাথে সাথে ভারতীয় মানুষজনও উদাস হয়ে গিয়েছিলেন কারন শিনজো আবে ভারতের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। ইন্দো জাপান সম্পর্কের জন্য তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি ছিলেন। ইন্দো প্যাসিফিক এলাকায় ভারতের ও জাপানের সংযুক্তির পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। 

জাপানের সবচেয়ে বেশীদিন প্রধানমন্ত্রী থাকা শিনজো আবে প্রথম কোন জাপানী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন যিনি তিনবার ভারত সফরে এসেছিলেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাল বন্ধু শিনজো আবের সময়েই ভারত ও জাপানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় উঠেছিল। ভারত সম্পর্কে তিনি এতটাই আশাবাদী ছিলেন যে ২০০৭ সালে তার লেখা বই টুয়ারডস এ বিউটিফুল কান্ট্রি – মাই ভিসন ফর জাপানে তিনি লিখেছিলেন আগামী দশকে যদি ভারত ও জাপানের মধ্যে সম্পর্ক জাপান- আমেরিকা কিংবা জাপান- চীনের সম্পর্কের থেকেও মজবুত হয়ে যায় তাহলে অবাক হবার কীছু নেই। এরকম একজন মানুষের অকাল প্রয়ানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ৯ জুলাই দিনটিকে ওনার স্মরনে বিশেষ দিন হিসাবে ঘোষনা করেন। নরেন্দ্র মোদীজী বলেন বিশ্ব শিনজো আবেকে একজন মহান নেতা ও দক্ষ প্রশাসক হিসাবে বিশ্ব মনে রাখবে। শিনজো আবে ও ভারতের সাথে তার বন্ধুত্বের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। সাথে এটাও বলা হবে ওনার অনুপস্থিতিতে ভারত ও জাপানের সম্পর্কে কী প্রভাব পড়বে।

শিনজো আবে কোন সাধারন রাজনৈতিক ব্যাক্তি ছিলেন না, তিনি ওই বিশেষ রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি একবিংশ শতকে জাপানকে অর্থনৈতিক ও জিওপলিটিক্যালি শক্তিশালী করবার ভিত তৈরি করেছিলেন। ২০১২ সালে তিনি যখন দ্বিতীয় বারের মতন জাপানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তখন তিনি বলেন জাপান ফিরে এসেছে মানে জাপান এই সময় থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে একজন লিডারের ভূমিকায় নিজেকে দেখতে শুরু করে। জাপানের ডিফেন্স ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত করা শিনজো আবের প্রধান লক্ষ ছিল। ২০১১ সালের সুনামি ও পরমানু দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত জাপানে তিনি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনে যা জাপানের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারন জাপানে প্রায়ই প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন হয়েছে। ২০১২-২০ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে তিনি জাপানে অনেক নীতি তৈরি করেছেন যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইন্দো প্যাসিফিক এলাকায় ভারতের সাথে জোট গঠন এবং চীনের বিআরআই প্রজেক্টের বিকল্প পথের প্রস্তাব। এসব কাজেই তিনি ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হিসাবে ভাবতেন। 

২০০৭ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন প্রথমবার ভারত সফরে আসেন তিনি তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ডঃ মনমোহন সিং। তবে ভারত তার জন্য নতুন ছিল না তিনি তার দাদুর কাছে ভারতের ব্যাপারে অনেক গল্পই শুনেছিলেন। ওনার দাদু নবোসুকে কিসি ১৯৫৭ সালে ভারত সফরে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন। সেসময় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু ওনাকে অভ্যত্থনা জানিয়েছিলেন। জহরলাল নেহেরু ওনার সম্মানে একটি জনসমক্ষে একটি সভা করেছিলেন যাতে হাজার হাজার মানুষের সামনে তিনি ঘোষনা করেছিলেন এবং বলেছিলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী  নবোসুকে কিসিকে তিনি খুবই সম্মান করেন। সদ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জাপানের জন্য এটা খুবই সম্মান জনক ব্যাপার ছিল। সেসময় নেহেরু একটি হাতি উপহার দিয়েছিল যার নাম ওনার মেয়ে ইন্দিরার নামে ইন্দিরা রাখা হয়েছিল। ২০০৬-০৭ এ মাত্র একবছর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন শিনজো আবে ভারত সফরে এসে ভারতীয় সংসদে বলেছিলেন সময় এসেছে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে জোট গঠনের৷ আর আজ ১৫ বছর পর সেই ইন্দো প্যাসিফিক এলাকাই ভারতের বিদেশনীতি প্রধান অংশ এবং এই এলাকা জিও পলিটিক্যাল হটস্পট। বর্তমানে এই এলাকায় ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার জোট রয়েছে যার নাম কোয়াড যা শিনজো আবের স্বপ্ন ছিল। ওনার সময়ে দীর্ঘকাল ধরে জাপান ও ভারতের মধ্যে একটি ঝামেলা মেটানো হয় যা হচ্ছে ভারতের পরমানু শক্তি সম্পর্কে জাপানের বিরোধীতা। ২০১৬ সালে ভারত ও জাপান সিভিল নিউক্লিয়ার চুক্তি করে। শুধু স্ট্রাটেজিক্যাল সম্পর্কই নয় বরং শুনজো আবের সময় ভারত ও জাপানের মধ্যে প্রতিরক্ষা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এসব বিষয়গুলো সম্পর্কে একটু বলা যাক। 

যখনই অর্থনীতির কথা উঠবে তখন একটি শব্দ আসে তা হচ্ছে অ্যাবেনোমিক্স। জাপান একটি উন্নত দেশ কিন্তু দীর্ঘকাল জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধীর গতিতে হচ্ছিল। ২০১২ সালে দ্বিতীয় বারের মতন প্রধানমন্ত্রী হয়ে শিনজো আবে সরকারি খরচ, সহজ কর্মসংস্থান এবং অর্থনীতি পুনর্গঠন নিয়ে একটি তিন স্টেপ স্ট্রাটেজি তৈরি করেছিলেন যাকে অ্যাবেনোমিক্স বলা হয়। যার লক্ষ ছিল অর্থনৈতিক ভাবে জাপানকে আরও মজবুত করা। কিন্তু জাপানের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তার কম জনসংখ্যা এবং বৃদ্ধ জনসংখ্যা, তাছাড়া করোনা মহামারীতেও জাপানের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে ভারত ও জাপানের পার্টনারশিপে দুই দেশেরই উপকার হয়। ভারত তার তরুন প্রজন্মের জন্য নিজেকে ম্যানুফাকচারিং হাব তৈরির চেষ্টা করে যাতে মেক ইন ইন্ডিয়ার মত প্রজেক্ট গুরুত্বপূর্ণ। শিনজো আবের সময়ে ভারতে সবচেয়ে বেশী বিনিয়োগ জাপানের থেকেই এসেছে। জাপানের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ভারতের জন্য আশীর্বাদ স্বরুপ ছিল। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বুলেট ট্রেন প্রকল্প। ২০১৭ সালে এই প্রজেক্টর জন্য গুজরাটে আসেন শিনজো আবে। ১৭ বিলিয়ন ডলারের মুম্বাই আমেদাবাদ বুলেট ট্রেন প্রকল্প ও মুম্বাই দিল্লি ফ্রেড করিডরে জাপান বিনিয়োগ করে। এই সময়ে ভারতের মোট বৈদেশিক বিনিয়োগের ১০ শতাংশই জাপান থেকে আসে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি গত কয়েকবছরে ভারতে অনেক বিনিয়োগ করেছে। কোভিড ১৯ এর সময়ে ভারগ ও জাপানের বানিজ্য ১৭ বিলিয়ন ডলারের মতন ছিল যার মধ্যে ১২.৭৭ বিলিয়ন ডলার ভারত আমদানি করেছে এবং ৪.৮৬ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে। 

ভারত লোহা, স্টিলের জিনিস ও মেশিন আমদানি করেছে এবং পেট্রোলিয়াম দ্রব্য, পোষাক, কেমিক্যাল এবং অন্যান্য জিনিস রপ্তানি করে। জাপান ভারতের নবম বৃহত্তম বিনিয়োগকারী যা সম্ভব হয়েছে প্রয়াত শিনজো আবের জন্যই। অর্থনীতির পাশাপাশি ভারত ও জাপানের মধ্যে প্রতিরক্ষা সেক্টরেও গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়। শিনজো আবের প্রধানমন্ত্রী সময়কালের শেষের দিকে ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তে ভারত ও জাপানের মধ্যে মিলিটারি কোঅপারেশন চুক্তি হয় যাতে উভয় দেশ উভয় দেশের মিলিটারি বেসে প্রবেশাধিকার পায়। অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, আমেরিকার, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ার পর জাপানে ষষ্ঠ দেশ যার সাথে এমন চুক্তি হয় ভারতের। শিনজো আবে জাপানের সংবিধানে সংশোধন করতে চাইছিলেন। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলার কথা মাথায় রেখে জাপানি সংবিধানের আর্টিকেল ৯ এ লেখা আছে জাপান কোনওদিন নিজে থেকে যুদ্ধ ঘোষনা করতে পারবে না। শিনজো আবে এটাই সংশোধন করতে চাইছিলেন কারন এই ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের উপর আমেরিকার প্রভাবকে মনে করায়। এই জন্য জাপান ইন্দো প্যাসিফিক এলাকয় চীনকে আটকাতে ভারতের সাথে জোট গঠন করে। উত্তর পূর্ব ভারতের উন্নয়নে জাপান বিনিয়োগ করে, দক্ষিন ও দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে ভারতের প্রভাব বিস্তারে জাপান সাহায্য করে। এসবই হয়েছিল শিনজো আবের সময়ে। ইতিহাসে এই প্রথম বারের মতন ভারত ও জাপান এতটা কাছাকাছি এসেছিল। শিনজো আবেকে জাপনের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিশেষ ব্যাক্তি হিসাবে মনে রাখা হবে। তিনি জাপানকে শুধু আমেরিকার ছায়া থেকে বারই করেননি বরং এশিয়াতে একটি শক্তিশালী দেশ হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন। এশিয়াতে চীনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশকে নিয়ে জোট করে জাপানকে তিনিই দাড় করিয়েছিলেন। সত্যি ভারত শিনজো আবে নামে এক পরম বন্ধুকে হারালো। 

Leave a Reply

Your email address will not be published.