কত হাজার কিলোমিটার জুড়ে আন্তর্জাতিক সীমানা আছে ভারতবর্ষের?
রাজেশ রায়:—- জানেনকী ভারতের আন্তর্জাতিক সীমান্ত বিশ্বের সবচেয়ে অদ্ভুত। ভারতের বিশাল সীমান্ত অত্যন্ত উষ্ণ আবহাওয়ার স্থান থেকে শুরু করে পর্বত্য অঞ্চল, তুষার আবৃত এলাকা হয়ে আরও অনেক বন্ধুর প্রাকৃতিক অঞ্চল হয়ে বিস্তৃত যার জন্য ভারতের এই সীমান্ত সর্বদা শত্রুর থেকে রক্ষা করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। আয়তনের দিক দিয়ে ভারত বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ হলেও ভারতের ১৫,২০০ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে যার জন্য আন্তর্জাতিক সীমান্তের ক্ষেত্রে ভারত তৃতীয় স্থানে রয়েছে রাশিয়া ও চীনের পরেই। আজ এব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করব।
সাতটি দেশের সাথে ভারতের সীমানা রয়েছে। আফগানিস্তানের সাথে ভারতের সরাসরি কোন সীমানা নেই কিন্তু যেহেতু পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর ভারতের অংশ সেজন্য আফগানিস্তানকেও ধরা হয়। ভারতের ১৫,২০০ কিলোমিটার স্থল সীমানা সহ ৭৫১৫ কিলোমিটার সমুদ্র সীমনাও আছে চারটি দেশের সাথে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা,থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া। ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধার্মিক কারনে এসব সীমান্ত তৈরি হয়েছে। যেমন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্তকে বিশ্বের অন্যতম বিপদজনক সীমান্ত বলা হয়। ভারত পাকিস্তান সীমান্তে ভারত সরকার প্রায় দেড় লাখ বিশেষ আলো বসিয়েছে যাতে মহাকাশ থেকেও ভারত পাকিস্তান সীমান্তকে দেখা যায়। আসলে অবৈধ সীমান্ত পারাপার, চোরাকারবারি আটকাবার জন্য এসব বিশেষ আলো বসানো হয়েছে। ৩৩২৯ কিলোমিটার লম্বা ইন্দো পাক সীমান্ত বিশ্বের নবম বৃহত্তম সীমান্ত যার দক্ষিন সীমান্ত আরব সাগরের স্যার ক্রীক থেকে শুরু হয়। গুজরাটের কচ্ছ এবং সিন্ধের সুজাওয়াল জেলার মাঝে অবস্থিত সিন্ধু নদীতে এই সীমান্ত ভারতের অন্যান্য সীমান্ত থেকে আলাদা। কারন এখানে কোন কাঁটা তারের বেরা নেই, আসলে এই জায়গায় প্রচুর খাল রয়েছে এবং জোয়ারের সময় পুরো এলাকা জলের তলায় চলে যায়। সেজন্য এখানে বিএসএফের টহল দিতো অনেক সমস্যা হয়। পাকিস্তান এই পুরো স্যার ক্রিক খাঁড়ি নিজেদের বলে দাবি করে তবে ভারত তা মানেনি। স্যার ক্রিক থেকে পূর্বে এগিয়ে এই সীমান্ত সাকুর লেকের মধ্যে দিয়ে গেছে। এখানে নজর রাখার জন্য ভারত সরকার ইন্দো পাক সীমান্ত রোড তৈরি করেছে যা গুজরাট স্টেটস হাইওয়ে ৪৫ এর সাথে গিয়ে মিশেছে। সকুর লেক থেকে এই সীমান্ত কচ্ছের রন হয়ে গিয়েছে। কচ্ছের রন প্রায় ২২,০০০ স্কোয়ার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।
গুজরাটের সাথে পাকিস্তানের প্রায় ৫৩৩ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেক অংশে কোন কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া সম্ভব হয়নি কারন এখানকার ভৌগোলিক কারন। প্রচন্ড উষ্ণ তাপমাত্রা, একাধিক খাঁড়ি থাকার কারনে এখানে জনবসতি খুবই কম, সেইজন্য এই এলাকা যথেষ্ট শান্তিপূর্ণ। গুজরাট থেকে এগিয়ে ভারত পাকিস্তান সীমান্ত রাজস্থানে প্রবেশ করে। রাজস্থানের চার জেলা বারমের, বিকানের, জয়সলমীর ও শ্রী গঙ্গানগরের সাথে পাকিস্তানের সিন্ধ ও পাঞ্জাব প্রদেশের ১০৪৮ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত রয়েছে। পুরো রাজস্থানে ইন্দো পাক সীমান্তকে বিশেষ কাঁটা তারের বেরা৷ দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এখানে রয়েছে ২ লাখ স্কোয়ার কিলোমিটার এলকা জুড়ে থর মরুভূমি যার জন্য এখানে তাপমাত্রা পৌঁছায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া বারমের ও জয়সলমীর এলকায় প্রায়ই মরু ঝড় আসে। এরকম অবস্থায় ধাতুর বেরা কতদিন টিকবে সেটাই দেখার। রাজস্থান থেকে পাকিস্তান অবধি থার এক্সপ্রেস চলে। ২০০৬ সালের সিমলা চুক্তি অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই ট্রেন চলে। দিল্লি থেলে লাহোর অবধিও সমঝোতা এক্সপ্রেস নামে একটি ট্রেন চলে। যোধপুরের ভগত কী কোঠি থেকে থার এক্সপ্রেস যাত্রা শুরু করে মুনাবাও, জিরো পয়েন্ট, মীরপুর, হায়দ্রাবাদ হয়ে করাচি পৌঁছায়, মোট ৭০৯ কিলোমিটারের এই রেলপথ।
রাজস্থান থেকে এগিয়ে এই সীমান্ত পাঞ্জাবে প্রবেশ করে। পাঞ্জাবের ছয় জেলা ফাজিলকা, ফিরোজপুর, তরন তারন, অমৃতসর, গুরদাসপুর ও পাঠানকোটের সাথে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের ৫৩৩ কিলোমিটার সীমন্ত রয়েছে। পাঞ্জাবে রাবি ও শতদ্রু নদীর ভারত পাকিস্তান সীমান্ত সবচেয়ে বিপদজনক কারন এখান দিয়েই অনুপ্রবেশের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশী থাকে। ২০২১ সালে এখান দিয়েই অনেক অস্ত্র, ড্রাগস উদ্ধার করা হয়। তাছাড়া পাঞ্জাবেই রয়েছে বিখ্যাত আটারি ওয়াঘা সীমান্ত। এতদূর পর্যন্ত ভারত পাকিস্তান সীমান্ত স্বীকৃত আছে উভয়পক্ষেরই। এরপর শুরু হচ্ছে জম্মু কাশ্মীর, সমস্যা এখান থেকেই। পাঞ্জাব থেকে কাঠুয়া, সাম্বা ও জম্মু অবধি ২০০ কিলোমিটার ভারত পাকিস্তান সীমান্ত পাকিস্তান স্বীকার করেনা। এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে ৭০০ কিলোমিটার লম্বা এলওসি বা লাইন অফ কন্ট্রোল রয়েছে যা কাশ্মীরের রাজৌরি, পুন্চ, বারমুলা, কুপওয়ারা ও বান্দিপুর হয়ে গেছে। এই অঞ্চল অত্যন্ত ঘাতক সীমান্ত। এখানে প্রায় প্রতিদিনই উভয়পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয়। কাশ্মীর হয়ে ভারত পাকিস্তান সীমান্ত কারগিল হয়ে লে তে এনজে ৯৮৪২ তে শেষ হয়। এর আগে রয়েছে কারাকোরাম পর্বতমালা। এখানেই রয়েছে সীয়াচেন হিমবাহ। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু যুদ্ধক্ষেত্র এটাই। ১৯৮৪ থেকে এই অঞ্চল ভারতের অধীনে রয়েছে।
লে এর এখান থেকেই শুরু হচ্ছে ভারত চীন সীমান্ত যাকে এলএসি বা লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বলা হয়। ১৯৬২ সালে ভারত চীন যুদ্ধের পর থেকেই এটি তৈরি হয়। ভারত ও চীনের মধ্যে ৩৪৮৮ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। তবে এখানে কোন কাঁটা তারের বেড়া নেই। প্রায় ৬০০০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট হিমালয় পর্বতমালা এখানের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সীমান্তের কাজ করে। গত কয়েক বছরে ভারত চীন সীমান্ত সমস্যা হয়েছে কিন্তু পাকিস্তানের মতন সেনসেটিভ নয়। তবে এখানে ভাগ আকসাই চীন দাবি করে অন্যদিকে চীন অরুনাচল প্রদেশ দাবি করে। ভারত ও চীনের সীমান্ত তিনভাগে বিভক্ত। পশ্চিম, মধ্য ও পূর্ব সেক্টর। এলএসি কারাকোরাম রেঞ্জের দৌলতবেগ ওল্ডি থেকে শুরু হয়ে দক্ষিনে গালওয়ান ভ্যালি হয়ে প্যাংগং লেক পর্যন্ত গেছে। এই গালওয়ান ভ্যালিতেই ভারত ও চীনের সেনার মধ্যে ২০২০ তে সংঘর্ষ হয়েছিল। এর আগে ভারত চীন সীমান্ত রয়েছে হিমাচল প্রদেশের লাহুল স্পিতি ও কিন্নর জেলায়, এখানে ভারত চীনের ২০০ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে।
লাদাখ ছাড়া হিমাচল প্রদেশের সাথে তিব্বতের সীমান্ত অনেক দুর্গম। তবুও এখানে বছরে আটকোটি টাকার মত বানিজ্য হয় দুই দেশের মধ্যে যার মধ্যে উলের জিনিস, কার্পেট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। হিমাচল প্রদেশের পর ৩৪৫ কুলোমিটার লম্বা ভারত চীন সীমান্ত উত্তরাখন্ডের তিন জেলা চামোলি, উত্তর কাশী ও পিথোরাগড় জেলা হয়ে গেছে। পিথোরাগড়ে রয়েছে বিখ্যাত লিপুলেখ পাস যা উত্তরাখন্ডকে তিব্বতের সাথে যুক্ত করে। এপথেই মানস সরোবর যাত্রা হয়। এখানেই ভারত চীনের সীমান্তের মধ্য ও দক্ষিনভাগ শেষ হয়। এবার নেপাল সীমান্ত আরাম্ভ হয়। তবে এছাড়া সিকিমে ভারত চীনের মধ্যে ২২০ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত আছে। এখানে ডোকলাম অঞ্চল নিয়ে ভারত চীনের মধ্যে ঝামেলা আছে। ডোকলামের চুম্বী ভ্যালি স্ট্রাটেজিক্যালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল কারন কারন এখান দিয়েই ভারতের পুরো শিলিগুড়ি করিডরের উপর নজর রাখা যায়। অরুনাচল প্রদেশ ও চীনের মধ্যে ১১২৬ কিলোমিটার সীমন্ত আছে। অরুনাচল প্রদেশের দশটি জেলার সাথে চীনের সীমান্ত রয়েছে। চীন বরাবরই অরুনাচল প্রদেশকে তাদের বলে দাবি করে।