ভারতীয় নৌসেনার নতুন পতাকা যুক্ত কেন করা হচ্ছে?
রাজেশ রায়:- ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ভারতীয় ইতিহাসে এক স্মরনীয় দিন হিসাবে লেখা থাকবে। এই দিন দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। প্রথমত কোচিতে ভারতের নিজস্ব তৈরি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আইএনএস বিক্রান্ত সরকারি ভাবে নেভিতে যুক্ত হয়েছে এবং ভারতীয় নেভির পতাকা পরিবর্তন করা হয়েছে। ভারতীয় নেভির পতাকা পরিবর্তনের খবর বেশ কীছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। অনেকেরই দাবি ছিল ভারতীয় নেভিতে যদি নতুন পতাকা যুক্ত করাই হয় তাহলে তাতে যেন ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের কোন চিহ্ন থাকে। শুধু মহারাষ্ট্র নই পশ্চিম বঙ্গ, উত্তর প্রদেশ, কর্নাটক সহ ভারতের সব প্রান্ত থেকে মানুষদের এই দাবি ছিল। ভারতীয় নৌবাহিনীতে নতুন পতাকা কেন যুক্ত করা হল? এর আগেও কী কখনও ভারতীয় নৌবাহিনীর পতাকা পরিবর্তন করা হয়েছিল?
ভারতীয় নৌবাহিনীর জনক বলা হয় ছত্রপতি শিবাজি মহারাজকে। ১৬৭৪ সালে পশ্চিম ভারতে তিনি মারাঠা সাম্রাজ্য গঠন করেন। সমুদ্র বানিজ্যকে রক্ষা করার জন্য তিনি কঙ্কোন ও গোয়া উপকূলে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করেছিলেন যার জন্য ওনাকে ভারতীয় নৌবাহিনীর জনক বলা হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর পুরোনো পতাকায় সেন্ট জর্জের ক্রস ছিল, এটা পরিবর্তন করে নতুন পতাকা তৈরি করা হয়েছে, যাতে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের চিহ্ন রয়েছে। এর উপর নেভি একটি ছোট ভিডিও তৈরি করেছে। তবে এটাই প্রথমবার নয় এর আগে ২০০১ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারি বাজপেয়ী সেন্ট জর্জ ক্রস সরিয়ে ভারতীয় নৌবাহিনীর নতুন পতাকা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্ত ২০০৪ সালে পরবর্তী ইউপিএ সরকার এটা পরিবর্তন করে পুনরায় সেন্ট জর্জ ক্রস নিয়ে আসে ভারতীয় নৌবাহিনীর পতাকায়। মূলত ভারতীয় নেভির পতাকার রঙ আগে ছিল সাদা তাতে লাল রঙের সেন্ট জর্জ ক্রস ছিল সেই ক্রসের মধ্যে ছিল ভারতের জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভ এবং ক্রসের বাদিকে একদম উপরে ছিল ভারতীয় জাতীয় পতাকা। স্বাধীনতার আগে ভারতীয় পতাকার জায়গায় সেখানে ছিল ব্রিটেন জাতীয় পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক। কারন ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের পর ভারতে প্রায় ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হয় ব্রিটেনের অধীনে।
ব্রিটেনের রয়্যাল নেভির অধীনে ভারতীয় নৌবাহিনীর গঠন হয় সেজন্য ভারতীয় নৌবাহিনীতে ব্রিটেনের জাতীয় পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক ব্যাবহার করা হত। সেন্ট জর্জ ক্রস ইংল্যান্ডের এই ইউনিয়ন জ্যাকেও ব্যবহার করা হয় কারন সেন্ট জর্জ ইংল্যান্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি ছিলেন কিন্তু ভারতের ইতিহাসে সেন্ট জর্জের কোন অবদান নেই, সেন্ট জর্জ ভারতে কোনদিন পাও রাখেননি। তাই ভারতীয় নেভির পতাকা থেকে ঔপনিবেশিক ছাপ সরাতে অটলবিহারি বাজপেয়ী ২০০১-০৪ এ তার সরকারের সময় এই ভারতীয় নৌবাহিনীর নতুন পতাকা প্রকাশ করেন যাতে ভারতের পতাকা ও অশোক স্তম্ভ সহ নোঙরের ছবি ছিল। ভারতীয় নৌবাহিনীতে নতুন যে পতাকা যুক্ত করা হল সেটা মূলত অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময়ের পতাকাই শুধু সেখানে চিহ্ন গুলো নীল ছিল, এখনকার পতাকায় সেগুলো সোনালী হরফে করা হয়েছে। এছাড়া নতুন পতাকায় লেখা হয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীর মোটো শ্যাম নৌ বরুনা। এই অশোকস্তম্ভ,নোঙরের চিহ্ন ও মোটো কে একটি অষ্টভুজের মধ্যে রাখা হয়েছে, যা সোনালী ও নীল রঙে রয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর এই মোটো শ্যাম নৌ বরুনার অর্থ হচ্ছে হিন্দু ধর্মে সমুদ্রের দেবতা বলা হয়েছে বরুনদেবকে। সেজন্য বলা হয়েছে শ্যাম নৌ বরুনা বা বরুনদেব যেন তার আশীর্বাদ দেন। নতুন পতাকায় ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের রাজমুদ্রাও রয়েছে। এবার একটা কথা মনে হতেই ভারতে শিবাজি মহারাজকেই কেন ভারতীয় নৌবাহিনীর জনক বলা হয়?
এর উত্তর পাওয়া যাবে ভারতীয় নৌবাহিনীর সরকারি পেজে। ভারতীয় নৌবাহিনীর ইতিহাস অনেক প্রাচীন। হরপ্পা সভ্যতায় লোথাল ছিল বিশ্বের সবচেয়ে গভীর সমুদ্র বন্দর, যদিও এটা বিতর্কিত বিষয়। ঋক বেদেও বানিজ্যের কথা উল্লেখ আছে। মৌর্য সম্রাট অশোকেরও নেভি ছিল, গুপ্ত সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে দক্ষিন ভারতের মহান চোলদেরও শক্তিশালী নৌবহর ছিল। চোল নৌবাহিনী এতটাই শক্তিশালী ছিল যে ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এসব অঞ্চলেই তাদের প্রভাব ছিল। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে ভারতীয় নৌবাহিনীর ইতিহাস এতটাই পুরনো যে তার সুস্পষ্ট ধারনা পাওয়া মুশকিল। এসব কীছুই ভারতীয় নৌবাহিনীর পেজে লেখা আছে। এটা তো গেল ভারতীয় নৌবাহিনীর অতি সংক্ষিপ্ত একটি বিবরন, তবে আক্রমনের জন্য নেভির ব্যাবহার ছত্রপতি শিবাজির সময়েই শুরু হয়। এর আগে যত ভারতীয় নৌবহর ছিল তা শুধুমাত্র বানিজ্য, ভ্রমন অথবা সেনা পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হত। চোলদের নৌবহর শক্তিশালী ছিল কিন্তু ছত্রপতি শিবাজির নেতৃত্বে আরও বেশী শক্তিশালী নৌবহর গঠন হয়। ফ্রান্স, ব্রিটেন, পর্তুগালের মতন ইউরোপীয়ানদের বিরুদ্ধে ছত্রপতি শিবাজিই ছিল প্রথম কোন ভারতীয় সম্রাট যার শক্তিশালী নেভি ছিল। মারাঠা নৌবহরে ৫০০ জাহাজের বিশাল নৌবহর ছিল। তবে ব্রিটিশদের তুলনায় মারাঠাদের জাহাজ আকারে ছোট ছিল কিন্তু তবু মারাঠা যুদ্ধজাহাজে ক্যানন ছিল। এইজন্য ছত্রপতি শিবাজি মহারাজকে ভারতীয় নৌবাহিনীর জনক বলা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৬৮০ সালে ছত্রপতি শিবাজির মৃত্যুর পর মারাঠা নৌবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। এর পরবর্তী কোন মারাঠা রাজা তার নেভির প্রতি এতটা গুরুত্ব দেয়নি। এটা ছিল সবচেয়ে বড় ভুল, যদি মারাঠা নৌবাহিনী শক্তিশালী থাকত তাহলে ব্রিটেন চাপে থাকত এবং আরব সাগরে ভারতের প্রভাব থাকত। এইজন্য ভারতীয় নৌবাহিনীর পতাকায় ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের চিহ্ন থাকা দরকার কারন এটা আমাদের স্মরন করায় আমাদের সোনালী ইতিহাস সম্পর্কে এবং এটাও বোঝায় নিজের সীমানা রক্ষা করতে গেলে আরও শক্তিশালী নৌবহর গঠন করতে হবে।
স্বাধীনতার পর এই নিয়ে পাঁচবার ভারতীয় নৌবাহিনীর পতাকা পরিবর্তন হল। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হবার পরও ১৯৫০ অবধি ভারতীয় নৌবাহিনীর পতাকায় ব্রিটেনের ইউনিয়ন জ্যাক ব্যাবহার করা হত। ১৯৫০ এ ইউনিয়ন জ্যাকের বদলে ভারতের পতাকা লাগানো হয়। ১৯৭০ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীর তৎকালীন ভাইস অ্যাডমিরাল ভিভিয়ান বারবোজার, তবে ২০০১ সালেই প্রথম পরিবর্তন হয়। ২০০৪ সালে রেড ক্রসে সোনালী অশোক স্তম্ভ স্থাপন করা হয়। ২০১৪ সালে অশোক স্তম্ভের নীচে দেবনাগরী হরফে লেখা হয় সত্যমেব জয়তে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন এই নতুন পতাকার মাধ্যমে পরাধীনতার চিহ্ন থেকে মুক্তি পেল ভারত। এই কথাটা কিন্তু সত্যি দক্ষিন এশিয়ার বাকী সমস্ত দেশ শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মালদ্বীপ কারোর নেভিতেই এরকম ক্রস চিহ্ন ছিলনা। এমনকী অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডার মতন দেশগুলোও তাদের নৌবাহিনী থেকে ক্রশ চিহ্ন তুলে নিয়েছে। কিন্তু ভারতের এই চিহ্ন সরাতে ৭৫ বছর সময় লেগে গেল!! এটা সত্যিই অদ্ভুত ব্যাপার। যেন কোথাও মনে হচ্ছিল ভারতে আজও ব্রিটিশ প্রভাব রয়েছে। সেজন্য ভারতীয় নেভির নতুন পতাকা সত্যিই গর্বের বিষয়। কিন্তু এটা এখন দেখার যে এই পতাকা কতদিন থাকে। কারন এর আগে ২০০১ সালে অটলবিহারি বাজপেয়ীজীর তৈরি নতুন পতাকা ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকার তুলে দেয়, এটাই দেখার যে ভবিষ্যতে নতুন কোন সরকার এলে এই পতাকা থাকে কীনা। তবে তৎকালীন ইউপিএ সরকার ২০০৫ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীজীর পতাকা পরিবর্তনের কারন হিসাবে জানায় ওই পতাকায় যে অশোকস্তম্ভ ও নোঙরের ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল তা ছিল নীল রঙের। গভীর সমুদ্রে যখন জাহাজ যেত তখন সমুদ্রের নীল রঙ, নীল আকাশের কারনে দূর থেকে এই পতাকা এতটা বোঝা যেতনা তাই পতাকা আবারও পরিবর্তন করা হয়। এতক্ষন যে ভারতীয় নৌবাহিনীর পতাকা বলা হচ্ছে তাকে এনসাইন বলা হয়। আসলে কোন যুদ্ধজাহজের সামনের দিককে জ্যাকস্টাফ বলা হয় এবং পেছনের অংশকে বলা হয় স্ট্রেন। জ্যাকস্টাফে ব্যাবহার করা হয় ভারতের জাতীয় পতাকা, জাহজের পেছনে ব্যাবহার করা হয় এনসাইন। ১১৯০ সালে ব্রিটেন জাহাজে এনসাইন লাগানো শুরু করে ভূমধ্যসাগরে নিজেদের জাহাজ চেনবার জন্য। প্রথমে নেভিতেই এনসাইন ব্যবহার করা হত কিন্তু এখন ভারতীয় সেনাবাহিনী ও ভারতীয় বায়ুসেনাতেও আলাদা আলাদা এনসাইন ব্যবহার করা হয়।