ভবিষ্যতে পৃথিবীতে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে বিরাট ভূমিকা নেবে ভারতবর্ষ
রাজেশ রায়:– ভবিষ্যতে নতুন বিশ্ব কেমন হতে পারে বা ভবিষ্যতে বিশ্বে ক্ষমতার মেরুকরন কেমন হবে কখনও ভেবে দেখেছেন? যদি বর্তমানে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের কথাই ধরা হয় দেখা যাবে বিশ্বের সমস্ত বড় শক্তি গুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখানে যুক্ত আছে। যুদ্ধ অফিসিয়ালি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে হচ্ছে কিন্তু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনকে পরোক্ষভাবে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে। ভারত ও চীন জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দানে বিরত থাকে যা একপ্রকার রাশিয়ার প্রতি সমর্থনেরই নিদর্শন। সুতরাং বিশ্বের সমস্ত বড় শক্তি গুলো এখানে যুক্ত। তাই আজ এটাই আলোচনা করব ভবিষ্যতে বিশ্বে শক্তির ভারসাম্য কেমন হতে চলেছে বিশেষ করে ভারত কি পদক্ষেপ নিতে চলেছে?
গত ২৪ ফেব্রুয়ারী থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে গোটা বিশ্বে নতুন করে রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। ২৩ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল, ন্যাটোর প্রভাব গোটা বিশ্বেই ছিল কিন্তু বর্তমানে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পরই আমেরিকা সহ ন্যাটোর দুর্বলতা গোটা বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। ১৯৯১ এ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর থেকে আমেরিকা বিশ্বে একমাত্র সুপার পাওয়ার হিসাবে বর্তমান। খাতায় কলমে আমেরিকার সামরিক সক্ষমতার ধারে কাছে কেউ নেই কিন্তু বর্তমানে ইউরোপে আমেরিকা খানিকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। যার জন্য বিশ্বে নতুন জোট গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যেমন দক্ষিণ এশিয়ান দেশ ভারত ও চীন অনেকটা সেফ খেলছে কারন এরা সরাসরি রাশিয়ার বিপক্ষে না গিয়ে অনেকটা পরিস্থিতি মাপছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটা নীতি আছে যাকে বলা হয় “রিয়েলিজম”. যা বলে প্রতিটি দেশের বৈদেশিক নীতি নির্ভর করে তার জাতীয় স্বার্থের উপর। জাতীয় স্বার্থের দুটি থিওরি আছে একটি হচ্ছে বিশেষ কিছু নীতি যা কখনও পরিবর্তন হয় না এবং আরেকটি হচ্ছে এমন কিছু নীতি যা সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়। এখন এটা আলোচনা করা যাক এই মহূর্তে ইউক্রেনে বিশ্বের শক্তিশালী দেশ গুলোর কি অবস্থা হচ্ছে যার প্রভাব বিশ্ব রাজনীতিতে কি হতে পারে? ইউক্রেনে যুদ্ধে কী ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তা প্রতিনিয়ত জানতেই পারছেন সবাই।
ইউক্রেনের অর্ধেক তো ধ্বংস হয়েছে সাথে বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ রাশিয়ার অবস্থাও অতটা ভাল নয় আর্থিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে। দেখুন যদি সঠিক ভাবে লক্ষ্য করেন এই যুদ্ধে রাশিয়ার যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে কারন ইউক্রেন আক্রমন হচ্ছে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ভুলের মধ্যে একটা৷ রাশিয়ান প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভেবেছিল পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস এলাকায় রাশিয়ার সমর্থন রয়েছে তাহলে হয়ত ইউক্রেন আক্রমণ করা যাবে এবং বড়জোর ১০ দিনে ইউক্রেন দখল হয়ে যাবে কিন্তু এটা যে কত বড় ভুল তা আজ বোঝা যাচ্ছে। যদি ক্ষমতার তুলনা করা হয় তাহলে রাশিয়া যদি হাতি হয়, ইউক্রেন পিঁপড়ে। কিন্তু রাশিয়া ভুলে গেছিল যখন পিঁপড়ে হাতির কানে ঢুকে যায় তখন হাতিকেও বিপদে ফেলে দেয়। ইউক্রেন যে প্রত্যুত্তর দেবে এটা রাশিয়া কল্পনাও করে নি যার জন্য আজ প্রায় এক মাস হতে চলল এখনও যুদ্ধ চলছে। যখনই বিশ্বে ডেভিড বনাম গোয়ালেথ মানে ছোট দেশগুলোর সাথে বড় দেশ গুলোর যুদ্ধ হয় ছোট দেশগুলো প্রায়ই জয়লাভ করে যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকা ভিয়েতনাম আক্রমণ করে কিন্তু পরাজিত হয়। ২০০০ সাল থেকে ২০২১ অবধি ২১ বছর আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেও আমেরিকা আফগানিস্তান দখল করতে পারে নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আফগানিস্তান দখল করতে পারেনি। এর প্রধান কারন হয় সাপোর্ট চেন। ছোট শক্তি গুলো সবসময় বাকি দেশ গুলো থেকে সাহায্য পায়, যেমন ইউক্রেন ন্যাটো থেকে পাচ্ছে। ছোট দেশ গুলো গেরিলা যুদ্ধ করে তাতে সাধারণ মানুষের মৃত্যু হলেও কিছু যায় আসে না কিন্তু বড় দেশ গুলো যদি প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করে তখন কথা ওঠে। যেমন রাশিয়ার উপর অভিযোগ আনা হয়েছে রাশিয়া নিষিদ্ধ সাদা ফসফরাস বোম্ব ব্যবহার করেছে, হাইপারসনিক মিসাইল ব্যবহার করেছে।
বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ হওয়ার কারনে রাশিয়ার কাছে সেনাবাহিনী, যুদ্ধবিমান, মিসাইলের অভাব নেই, হয়ত ইউক্রেন আত্মসমর্পন করেও দিল কিন্তু রাশিয়া সত্যিই জিতবে? উত্তর হবে না, কারন এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশের সাথে আমেরিকার একটু মতবিরোধ ছিল কিন্তু রাশিয়ার কারনে আবার আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেল। প্রচুর আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে রাশিয়া বিশ্বে এক ঘরে হয়ে গিয়ে চীনের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। হয়ত রাশিয়া প্ল্যান বি অনুযায়ী দক্ষিণ ও পূর্ব ইউক্রেন দখল করেও ফেলবে তবে এটা শুধু সম্মান বাঁচানো একটা বিজয় হবে কারন গোটা বিশ্বের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে রাশিয়ান মিলিটারির পরিকল্পনার অভাবে দুর্বলতার ব্যাপার। এটা তো গেল রাশিয়ার কথা এবার আসি বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গ্লোবাল লিডার হিসাবে আমেরিকার উত্থান শুরু হয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তা আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর তো গোটা বিশ্বে আমেরিকার দিকে চোখ তুলে তাকাবার কেউ ছিল না কিন্তু ২০১০ এর পর থেকে পরিস্থিতি একটু বদলাতে শুরু করে। এই সময় আমেরিকার একের পর এক বিদেশনীতি ব্যার্থ হতে থাকে যেমন আফগানিস্তান যুদ্ধের কথাই ধরুন। ২১ বছর ধরে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যায়ের পর আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে খালি হাতে ফিরেছে। ইরাক থেকেও আমেরিকা সেনা সরিয়ে নিয়েছে। বর্তামানে ইউক্রেনেও সেনা না পাঠানোর কথা ঘোষণা করেছে আমেরিকা। কারন রাশিয়া পরমানু শক্তিধর দেশ। অর্থাৎ কোথাও না কোথাও আমেরিকা একটু পিছু হটছে। আমেরিকার বর্তমান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের মতে আমেরিকা আগে নিজের অর্থনীতির কথা আগে ভাববে। আমেরিকার একটু সরে যেতেই ব্যাপক পাওয়ার গ্যাপিং তৈরি হয়েছে। যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথাই বলি তাহলে এখানেও সমস্যা রয়েছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন হয়ত রাশিয়ার বিরুদ্ধে আছে কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশের মধ্যেই ঐক্য নেই। যেমন জার্মানি ও ফ্রান্স এনার্জির জন্য ৫০ শতাংশ রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল সুতরাং এরা সরাসরি রাশিয়ার সাথে বিরোধিতা চাইছিল না। আবার তুরস্কের সাথে রাশিয়ার ভাল সম্পর্ক আছে। সুতরাং ইউরোপ দ্বিধাবিভক্ত। রাশিয়া যদি গ্যাস সরবরাহ না করে চীনকে সাপ্লাই দেয় ইউরোপে বিশাল এনার্জি ক্রাইসিস চলে আসবে।
এই পুরো ব্যাপারটা যদি ভাল করে দেখেন দেখবেন ভারত ও চীন একই অবস্থায় আছে। যদিও চীন কিছুটা হলেও অ্যান্টি ন্যাটো স্টেটমেন্ট দিয়েছে কিন্তু ভারত তাও দেয় নি। ভারত ও চীন কেউই সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে কিছু বলে নি। যখন পূর্ব বনাম পশ্চিমের ঝামেলা হয় ভারত বরাবরই পশ্চিমা পক্ষ নেয় না। এটাই সঠিক সময় যখন বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন একটি অক্ষ তৈরি হওয়ার ভারত, চীন যৌথভাবে। কিন্তু ভারত ও চীনের মধ্যে গত তিন চার বছরে সম্পর্ক অবনতি হয়েছে, ডোকলাম ভ্যালি থেকে শুরু করে গালওয়ান ভ্যালি পর্যন্ত ভারত ও চীনের বিবাদ হয়েছে। সুতরাং নিজেদের মধ্যে ঝামেলা মিটিয়ে নেওয়া গেলে নিঃসন্দেহে একটি শক্তিশালী অক্ষ তৈরি হত। এখানে একটা প্রশ্ন বারবার আসে ভারত কোন পক্ষে? গত দশ বছর ধরে বিশেষ করে ২০০৮ থেকে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে সিভিল নিউক্লিয়ার ডিলের পর থেকে অনেকে মন্তব্য করেছিল ভারত আমেরিকান ব্লকে গেছে কিন্তু সম্প্রতি ইউক্রেন ইস্যু তে এটা স্পষ্ট ভারত রাশিয়ার দিকে একটু ঝুঁকে আছে৷ সত্যি কথা বলতে কি ভারতের পররাষ্ট্র নীতি যথেষ্ট শক্তিশালী, ভারত নিজেদের স্বার্থে কাজ করে। তবে একটা কথা খুব পরিস্কার আমেরিকা ও ন্যাটোর পিছিয়ে আসার কারনে রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের পুরোনো সম্মান কিছুটা হলেও ফিরে পেতে চলেছে। অদূর ভবিষ্যতে ভারত, রাশিয়া, চীন, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, সৌদি আরব মিলে একটি জোট হয় কীনা তা হয়ত সময়ই বলবে।