অ্যামেরিকা

আমেরিকা এবং রাশিয়ার কাছে কত হাজার পরমানু বোমা একটিভ রয়েছে?

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ থামার কোন লক্ষ্মনই নেই। এদিকে ইউরোপ ও আমেরিকা যদি সরাসরি ইউক্রেনে আসে তাহলে পরমাণু বোম্ব ব্যবহারের হুমকী দিয়েছে রাশিয়া, যার জন্য ভয়ে কেউই ইউক্রেনের পাশে সরাসরি দাড়াচ্ছে না। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন যে পরমানু বোম্ব কীভাবে তৈরি হয়, এটি কি ভাবে কাজ করে? বিশ্বের কতগুলি দেশের কাছে পরমানু বোম্ব আছে? 

বিশ্বে মাত্র নয়টি দেশের কাছে ১২,৭০০ পরমানু অস্ত্র রয়েছে। এখনও পর্যন্ত দুবার পরমানু অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে লিটলবয় এবং ফ্যাটম্যান নামে দুটি পরমানু বোম্ব ফেলে। এরপরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় কারন জাপান আত্মসমর্পন করে। আমেরিকা তাদের বি-২৯ বোমারু বিমান থেকে এই বোম্বিং করে। বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমারের নেতৃত্বে “ম্যানহাটন প্রজেক্টে” এই পরমাণু বোম্ব তৈরি করা হয়। এত শক্তিশালী বোম্ব ছিল এই দুটি যে ৭৭ বছর পর আজও হিরোশিমা ও নাগাসাকির বাতাসে রেডিয়েশন পাওয়া যায়। হিরোশিমাতে প্রায় ১,৪০,০০০ লোক এবং নাগাসাকি তে ৭৪,০০০ লোক মারা যায় এই বোম্বের প্রভাবে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আরও প্রায় ২,১৪,০০০ লোক মারা যায়। জাপানের তথ্য অনুযায়ী রেডিয়েশনের কারনে হিরোশিমাতে ২,৩৭,০০০ লোক এবং নাগাসাকি তে ১,৩৫,০০০ লোক মারা যায়। এখনও জাপানে বংশানুক্রমে অন্ধত্ব, বধিরতা ও পঙ্গুত্বের মতো নানা ধরনের জটিল অসুখ হয়ে চলেছ। আজ ৭৭ বছর পরেও মানব ইতিহাসে এতবড় ধ্বংস যজ্ঞ সত্যিই শিহরণ জাগায়। এরপর আর কোন জায়গায় পরমাণু বোম্ব ব্যবহার করা হয় নি। এবার একটা কথা ভাবুন সেটা ছিল ১৯৪৫ আর আজ ২০২২, এত বছরে পরমানু বিজ্ঞানে প্রচুর উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের কাছে যেসব পরমানু বোম্ব আছে সেগুলো অনেক বেশী ঘাতক ও উন্নত। তবে পরমানু বোম্ব নিয়ে যে গোটা বিশ্বে এত আলোচনা তা এই বোম্ব তৈরির আসল কারিগর কিন্তু জার্মান বিজ্ঞানী অটোহ্যান ও স্ট্র্যাসম্যান। বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নেতৃত্বে জার্মান বিজ্ঞানীরা এবিষয়ে জানত এবং তারা কাজ ও শুরু করে দিয়েছিল কিন্তু আমেরিকা, ব্রিটেন ও কানাডা এই প্রচেষ্টা ব্যার্থ করে দেয় এবং নিজেরা ম্যানহাটন প্রজেক্টে কাজ শুরু করে যার নেতৃত্বে ছিল রবার্ট ওপেনহাইমার। ১৯৩৪ সালে এনরিকো ফার্মি পরীক্ষাগারে ইউরেনিয়ামকে নিউট্রন দ্বারা আঘাত করে সর্বপ্রথম পারমাণবিক বোম্বের ধারনা করতে পারেন। 

এবার পরমানু বোম্ব সম্পর্কে বলতে গেলে জানতে হবে পরমানু কী? পৃথিবীর প্রত্যেকটি পদার্থ অনু দিয়ে তৈরি। আর অনু তৈরি হয় পরমাণু দিয়ে। সোজা ভাষায় পরমানু হচ্ছে কোন পদার্থের সবচেয়ে ছোট সূক্ষ টুকরো যার পরে তাকে আর ভাঙ্গা যায় না। পরমানুর তিনটি প্রধান কনা রয়েছে প্রোটোন, ইলেকট্রন ও নিউট্রন। পরমাণুর একদম ভেতরে থাকে প্রোটন ও নিউট্রন। প্রোটন ও নিউট্রন একসাথে জোটবদ্ধ অবস্থায় থাকে একে নিউক্লিয়াস বলা হয়৷ প্রোটনের চার্জ পজেটিভ এবং নিউট্রনের চার্জ শূন্য। সেজন্য নিউক্লিয়াসের চার্জ পজেটিভ বলা হয়। ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারিদিকে ঘোরে, এর চার্জ নেগেটিভ। আরও সহজ ভাষায় বললে প্রোটন ও নিউট্রন সমন্বিত নিউক্লিয়াস কে যদি সূর্য হিসাবে কল্পনা করা হয় তাহলে এর চারিদিকে গ্রহগুলির মতন কক্ষপথ ধরে আবর্তিত হয় ইলেকট্রন। পরমানুর মধ্যে যত সংখ্যক প্রোটন থাকে তত সংখ্যকই ইলেকট্রন থাকে অর্থাৎ যত সংখ্যক পজেটিভ চার্জ থাকে তত সংখ্যকই নেগেটিভ চার্জ থাকে। পরমানু আকারে এতটাই ছোট হয় যে একে হয়ত মাইক্রোস্কোপের সাহায্যেও ভালভাবে দেখা যায় না কিন্তু এর মধ্যে ধ্বংসাত্মক শক্তি থাকে যা পরমানু বিস্ফোরণ ঘটায়। একটা পরমানু বিস্ফোরণ দুইভাবে হতে পারে। যদি পরমাণুর নিউক্লিয়াস কে ভেঙ্গে দেওয়া যায়, যাকে পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় নিউক্লিয়ার বিভাজন বলা হয় এবং একাধিক নিউক্লিয়াস কে যদি একসাথে জুড়ে দেওয়া যায়, একে পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় নিউক্লিয়ার সংযোজন পক্রিয়া বলা হয়। নিউক্লিয়ার বিভাজন পক্রিয়ায় বিশেষ পদ্ধতিতে নিউট্রনের মাধ্যমে নিউক্লিয়াস কে আঘাত করা হয়। ফলে নিউক্লিয়াস ভেঙ্গে গিয়ে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয় এবার ওই ভেঙ্গে যাওয়া নিউক্লিয়াস থেকে উৎপন্ন হওয়া নিউট্রন আবার অন্য নিউক্লিয়াস কে আঘাত করে। এভাবে একটি চেন সিস্টেম চলতেই থাকে, যাতে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়। একেই আমরা অ্যাটম বোম্ব বলি যা নিউক্লিয়ার বিভাজন পক্রিয়ায় কাজ করে। নিউক্লিয়ার সংযোজন প্রক্রিয়াকে যে বোম্ব তৈরি করা হয় তাকে হাইড্রোজেন বোম্ব বলা হয়। এটাই অনেকে ভুল করে, কারন সবাই এগুলোকে অ্যাটম বোম্ব বলে কিন্ত অ্যাটম বোম্ব ও হাইড্রোজেন বোম্ব আলাদা। নিউক্লিয়ার সংযোজন নিউক্লিয়ার বিভাজনের সম্পূর্ণ বিপরীত পক্রিয়া। নিউক্লিয়ার সংযোজনে দুটি হালকা পরমানু যুক্ত হয়ে একটি বড় পরমানু আকার ধারন করে এতে আরও ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা তৈরি হয় যাকে হাইড্রোজেন বোম্ব বলা হয়। পরমানু বোম্ব তৈরিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পদার্থটি প্রয়োজন হয় তার নাম ইউরেনিয়াম,  যা অত্যন্ত শক্তিশালী ভারী তেজস্ক্রিয় পদার্থ। ভূ-পৃষ্ঠের উপরে এর পরিমান প্রায় ০.০০৪ শতাংশ কিন্তু ভূগর্ভে প্রায় ছাড়ে ছয় কিলোমিটার গভীরতায় প্রচুর ইউরেনিয়াম রয়েছে। আফ্রিকার কঙ্গোতে এবং কানাডার গ্রেট বিয়ার হৃদ এলাকায় এর আকরি পাওয়া গেছে। এছাড়াও অ্যারিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়া, কলোরাডোতেও ইউরেনিয়ামের আকরিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। ভারতের জাদুগোড়াতেও ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়।

আকরিক থেকে শোধন করে ইউরেনিয়াম আইসোটোপ পাওয়া যায়। যেমন- ইউরেনিয়াম-২৩৮, যার পারমাণবিক ওজন ২৩৮ অর্থাৎ এর নিউক্লিয়াসে ৯২টি প্রোটন এবং ১৪৬টি নিউট্রন রয়েছে। প্রকৃতিতে এধরনের আইসোটোপই সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায়। হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৯৯ শতাংশই জাতীয় ইউরেনিয়াম। আরও একটি আইসোটোপটির নাম ইউরেনিয়াম-২৩৫ অর্থাৎ এর নিউক্লিয়াসে ৯২টি প্রোটন এবং ১৪৩টি নিউট্রন রয়েছে। প্রকৃতিতে এদের পরিমান মাত্র ০.৭ ভাগ। তাই পারমাণবিক বোম্ব তৈরির জন্য সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হয় ইউরেনিয়াম ২৩৫ ও ২৩৮. ইউরেনিয়াম ২৩৮ এ যদি একটি নিউট্রন দ্বারা আঘাত করা হয় তাহলে এটির পারমাণবিক ওজন হয়ে যায় ২৩৯ এবং এটি কিছু সময় পর প্লুটোনিয়ামে পরিনত হয়। কিন্তু ইউরেনিয়াম ২৩৫ এর ক্ষেত্রে তা হয় না যখন ইউরেনিয়াম ২৩৫ এ নিউট্রন দ্বারা আঘাত করা হয় তখন এটি দুটি পরমানু বেরিয়াম ও ক্রিপ্টনে পরিনত হয়। এইভাবে চেন রিয়াকশ্যান চলতেই থাকে। ২০ শতাংশ বিশুদ্ধ ইউরেনিয়ামকে বলা হয় হাইলি এনরিচড ইউরেনিয়াম এবং ৮০ শতাংশ বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম কে বলা হয় উইপন্স গ্রেডেড ইউরেনিয়াম, কারন এই ইউরেনিয়াম দিয়েই পারমানবিক অস্ত্র তৈরি করা হয়। প্রতিটি পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে নূন্যতম যে পরিমান তেজস্ক্রিয় পদার্থ লাগে তাকে বলে সংকট ভর। বিশুদ্ধ ইউরেনিয়ামের সংকট ভর ৫৬ কিলোগ্রাম ও প্লুটোনিয়ামের বেশ কম, মাত্র ১০ কিলোগ্রাম। অর্থাৎ, একটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরী করতে কমপক্ষে ৫৬ কিলোগ্রাম ইউরেনিয়াম অথবা ১০ কিলোগ্রাম প্লুটোনিয়াম লাগবে। বর্তমানে মাত্র ৫ কিলোগ্রাম প্লুটোনিয়াম দিয়ে স্যুটকেস আকারের পারমাণবিক বোমা প্রস্তুতি সম্ভব। তাই পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে ইউরেনিয়ামের থেকে প্লুটোনিয়াম বেশী কার্যকারী।

এই মহূর্তে রাশিয়া, আমেরিকা, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইসরায়েল, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও উত্তর কোরীয়া এই নয়টি দেশের কাছে পরমানু বোম্ব রয়েছে। সবচেয়ে বেশী পরমানু বোম্ব রাশিয়ার কাছে আছে বলেই ধারনা করা হয়। রাশিয়ার কাছে মোট ৫,৯৭৭ পরমানু বোম্ব রয়েছে। আমেরিকার কাছে ৫,৪২৮, চীনের কাছে ৩৫০, ব্রিটেনের কাছে ২২৫, ফ্রান্সের কাছে ২৯০, ভারতের কাছে ১৬০, পাকিস্তানের কাছে ১৬৫, ইসরায়েলের কাছে ৯০ ও উত্তর কোরিয়ার কাছে ২০ টি পরমানু বোম্ব আছে বলে ধারনা করা হয়। তবে এগুলো সবই অনুমান ভিত্তিক কারন বাস্তবে কোন দেশের কাছে কটা পটমানু বোম্ব আছে সেগুলোর আসল তথ্য কোনওদিন প্রকাশ করা হয় না। যে জায়গায় পরমানু বোম্ব ব্যবহার করা হয় সেখানের তাপমাত্রা বহুগুন বেড়ে যায়,  পুরো আকাশ জুড়ে মাশরুম ক্লাউডের সৃষ্টি হয়। অবস্থা এমন হয় যে মানুষের কোষ গুলোও পর্যন্ত গলে যায়। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমান কমে যায় যাতে মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসে। তাছাড়া পরমানু বিস্ফোরনের ফলে নির্গত তীব্র রেডিয়েশনে কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত মানুষের ক্যান্সার হয়। সত্যি কথা বলতে কি পরমানু বোম্ব তৈরি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুল।

Leave a Reply

Your email address will not be published.