চীন

চীনের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। প্রভাব পরতে পারে বহু দেশের উপরে

করোনা মহামারী থেকেই বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। ইতিমধ্যেই শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল সহ একাধিক দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই সঙ্গীন। বিশ্বের অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউস বলে খ্যাত চীনের অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ হতে চলেছে। চীনের বন্ড মার্কেট, ওভারসিজ বন্ড মার্কেট ১১.৩ থেকে ১০.১ এ নেমে এসেছে। আমেরিকান ডলারের তুলনায় চাইনিজ ইউয়ান ক্রমশ নীচে নামছে। চীনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারও খুব কমে গেছে। তবে চীনের জন্য যেটা সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে রিয়েল এস্টেট সমস্যা যা চীনের অর্থনীতি অনেকটাই ক্ষতি করতে পারে। এই ঘটনা গোটা বিশ্বের জন্যও ক্ষতিকারক কারন চীনের উপর বিশ্বের সব দেশই প্রায় কোনও না কোনও ভাবে নির্ভরশীল। ২০০৮ সালে আমেরিকার লেম্যান ব্রাদার্স ডুবে যায় তারপর আইসল্যান্ড, গ্রীসের মতন দেশ দেওলিয়া হয়ে যায় কিন্তু ভারতের সেসময় কোন ক্ষতি হয় নি। চীনেও সেরকম পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এবার কিন্তু ভারতও বাঁচতে পারবে না এর হাত থেকে। বেলুন যেমন হাওয়া খেয়ে ফুলে থাকে এবং একবার ব্লাস্ট করলে চুপসে যায় ঠিক তেমনি চীনের যা অবস্থা তার ফলে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতির তাই হতে চলেছে। এব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

গুগল পে, পেটিএম, ফোন পে এর মতন ইউপিআই অ্যাপ আসার পর থেকে মানুষ হাতে লিকুইড টাকা রাখার বদলে ব্যাঙ্কের মাধ্যমেই লেনদেন করছে। কিন্তু যদি কোনওদিন এমন হয় যে সকালে উঠে দেখা গেল কোন অ্যাপ কাজ করছে না, এটিএম কার্ড ও বন্ধ। তখন আপনি কী করবেন? নিশ্চয় ব্যাঙ্কে ফোন করবেন। কিন্তু যদি ফোনও না লাগে তাহলে! তখন নিশ্চয় সরাসরি ব্যাঙ্কে যাবেন কিন্তু গিয়ে দেখা গেল আরও অনেক লোক ব্যাঙ্কে ভিড় করেছে একই সমস্যার কারনে এবং সবচেয়ে বড় কথা কেউই ব্যাঙ্কে ঢুকতে পারছে না বরং এক শ্রেনীর লোক পেটাচ্ছে ব্যাঙ্কে ঢুকতে গেলেই! না এটা কোন গল্প নয় বরং চীনে গত এপ্রিল থেকে। ঘটনার সূত্রপাত চীনের হেনান প্রদেশের চারটি ব্যাঙ্ক থেকে যেখানে হঠাৎই গ্রাহক দের সব অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া হয় এবং লাখ লাখ লোক রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে শুরু করে। এই ঘটনার জন্য বেশ কিছু কারন আছে তবে অনেকাংশে চীনের রিয়েল এস্টেট সেক্টরের সংকটই দায়ী। চীনের মোট জিডিপি ১৭.৫ ট্রিলিয়ন ডলার এর এক তৃতীয়াংশ বা প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার আসে রিয়েল এস্টেট থেকে। চীনের অর্থনীতির সামান্য একটু ইতিহাস সম্পর্কে জানা দরকার প্রথমে। 

১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট দল সরকার গঠন করে এবং মাও জে ডং চীনের প্রথম রাষ্ট্রপতি হয়। ১৯৭৬ সালে যখন মাও জে ডং এর মৃত্যু হয় তখন চীনের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মাও জে ডং চীনের জন্য যেসব নীতি নিয়েছিল তার অধিকাংশ ব্যার্থ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৬০ এর দিকে চীনের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল লোক খিদের চোটে গাছের পাতা পর্যন্ত খেতে বাধ্য হয়। মাও জে ডং এর পর চীনের রাষ্ট্রপতি হয় ড্যান জিও পিং। তিনি অত্যন্ত কুশলী নেতা ছিলেন। আধুনিক চীন গঠনের কাজ তিনিই শুরু করেন। ড্যান জিও পিং না থাকলে আজও চীন একটি পিছিয়ে পড়া দেশ হিসাবে থাকত। যেসময় তিনি চীনের শাসন ভার গ্রহন করেন তখন চীনের রিয়েল এস্টেট সেক্টরে ব্যাপক সমস্যা ছিল। থাকার জন্য পর্যাপ্ত ঘর ছিলনা মানুষের। ড্যান জিও পিং অনেক সংস্কার করেন। ১৯৮৯ অবধি তার ১০ বছরের শাসনকালে চীনের অভূতপূর্ব উন্নতি করে ড্যান জিও পিং। এর জন্য ওনাকে আধুনিক চীনের জনক বলা হয়। ড্যান জিও পিং মানুষকে থাকার জন্য ঘর দেওয়া শুরু করে। কিন্তু এর জন্য দরকার জমি। সেজন্য চাইনিজ সরকার অনেক ব্যাঙ্ক তৈরি করে যারা মানুষকে কম খরচে লোন দিত। ফলে ধীরে ধীরে চীনে আরও অনেক ব্যাঙ্ক, লোনের সংস্থা তৈরি হয় যার জন্য চীনের অর্থনীতি মজবুত হতে শুরু করে এবং বাকী বিশ্বের সাথে যুক্ত হয় চীন। চীন ও আমেরিকার মানুষের একটা অভ্যাস আছে তারা সহজে সেভিংস করে না। যেকোনও বড় বড় কোম্পানি মালিক বা সফল লোকেরা তাদের সাক্ষাৎকারে একটা কথাই বলে সেভিংস দরকার। কিন্তু আমেরিকা ও চীনের মানুষ মাসে মাইনে পায় খরচ করে ফেলে। কিন্তু ভারতের মানুষের সেভিংসের অভ্যাস আছে সেজন্য যেকোনও বড় অর্থনৈতিক সমস্যায়ও ভারত বেঁচে যায়। এইজন্য করোনা মহামারীতে চীনের লোকেদের অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল কারন অর্থ উপার্জন হচ্ছিলনা। চীনে রিয়েল এস্টেট ব্যাবসা খুব দ্রুত গতিতে এগোচ্ছিল। 

রিয়েল এস্টেটে হয় কী ধরুন কোন ব্যাক্তি দিল্লিতে গিয়ে একটা ফ্ল্যাট কিনবে। তখন ব্যাক্তিটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে যোগাযোগ করে এবং কোম্পানি ব্যাক্তিটিকে একটি নির্দিষ্ট দাম বলে এর জন্য। ব্যাক্তিটি করে কী বেশীর ভাগ সময় ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে সেই টাকা রিয়েল এস্টেট সংস্থাকে দিয়ে দেয়। বদলে সংস্থাটি তাকে পজেসান দেয়। পজেসান হচ্ছে যখন ফ্ল্যাট নির্মান হয়ে যাবে তখন সংস্থাটি ফ্ল্যাটের চাবি ব্যাক্তিটিকে দিয়ে দেবে। চীনেও তাই হয় কিন্তু করোনা মহামারীর ফলে চীনের রিয়েল এস্টেট সংস্থা গুলোর হাতে টাকা ফুরিয়ে যায়। এদিকে ব্যাঙ্ক লোনের জন্য গ্রাহকের থেকে ইএমআই নিচ্ছে। তখন চীনের এইসব ব্যক্তি বাধ্য হয়ে ব্যাঙ্ককে জানায় তারা রিয়েল এস্টেট থেকে ঘরও পায় নি এবং তাদের টাকাও ফেরত পায়নি সুতরাং তারা ব্যাঙ্ককে ইএমআই দেবে না। শুধু তাই নয় চীনের ব্যাঙ্কের লোকেরা সেইসব ব্যাঙ্ক থেকে তাদের সমস্ত জমাকৃত টাকা তুলে নেওয়া শুরু করে। এখনও পর্যন্ত চীনের হেনান ও আনহুই দুটি প্রদেশের নাম সামনে এসেছে যেখানে বিভিন্ন ব্যাঙ্কে চার লাখ গ্রাহকের প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার জমা আছে। চাইনিজ সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলা যাবে না। এরজন্য চাইনিজ এই দুই প্রদেশে লোক রীতিমতো প্রতিবাদ করছে রাস্তায়। ব্যাঙ্ক থেকে যাতে কেউ পয়সা তুলতে না পারে সেজন্য চাইনিজ কমিউনিস্ট সরকার ব্যাঙ্কে রীতিমোতো লোক ভাড়া করে রেখেছে যারা শক্ত হাতে প্রতিবাদীদের দমন করছে। অবস্থা এমন যে চীনের সরকার হেনান প্রদেশের ডিজিটাল কোভিড কোডে হস্তক্ষেপ করেছে। 

একটু ভাল করে বলা যাক ধরুন আরোগ্য সোতু অ্যাপে জোর করে কাউকে করোনা পজেটিভ ঘোষনা করল ভারত সরকার এবং সেই ব্যাক্তিটিকে বাইরে বেরোনো এবং গন পরিবহন ব্যাবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। বিক্ষোভ থামাতে চীনের হেনান প্রদেশেও তাই করা হয়েছে। এবার জানা যাক এই সংকট হল কী করে? যেকোনও দেশ বন্ড তৈরি করে যাতে বিভিন্ন দেশের সংস্থা বিনিয়োগ করে। বন্ড বলতে একটি আইনি কাগজ যাতে বলা হয় ধরুন কোন সংস্থা ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলে ১১০ টাকা ফেরত পাবে। আমেরিকাতেও তাই হয়েছিল। ধরুন ভারত চীনের বন্ডে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করল বদলে চীন থেকে নির্দিষ্ট সময় পর ১১০ কোটি টাকা পাবে। তবে ভারত চীনের কোন বন্ডে বিনিয়োগ করে নি এটা একটা একটা উদাহারন। এবার এসব পয়সা ব্যাঙ্কে জমা থাকে। ব্যাঙ্ক এসব পয়সা লোন হিসাবে দেয় গ্রাহকদের। এবার রিয়েল এস্টেট সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গ্রাহক ব্যাঙ্ককে পয়সা দিচ্ছে না ফলে ব্যাঙ্ক বন্ডের টাকা ফেরত দিতে পারবে না৷ চীনের এরকম বন্ডে বিশ্বের অনেক দেশ বিনিয়োগ করেছে। 

চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় উৎপাদন কেন্দ্র যার সাথে রিয়েল এস্টেটের সরাসরি সম্পর্ক আছে। সুতরাং চীনের রিয়েল এস্টেট সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অর্থ বিশ্বের সব দেশই ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া। সুতরাং আবারও বিশ্বে আর্থিক সংকট আসতে পারে। তবে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য এব্যাপারে এখনও তেমন কোন তথ্য চীন প্রকাশ করেনি। চীনে ভারতের বিনিয়োগ নেই কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বড় উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে চীনের উপর ভারতও নির্ভরশীল সুতরাং ভারতেও সমস্যা তৈরি হবে। আমেরিকায় যেমন লেম্যান ব্রাদার্স ডুবে গেছিল তেমন চীনেরও অন্যতম বড় রিয়েল এস্টেট সংস্থা এভারগ্রান্ডও ডুবে যেতে চলেছে। যার প্রভাব আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই বোঝা যায়। যদি এমন হয় তাহলে চীনে মানুষই বিদ্রোহ শুরু করে দিতে পারে এবং চীনে যদি বিদ্রোহ হয়ে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়ে যায় তাহলে ভারতের জন্য এর থেকে ভাল কীছু হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published.