আমেরিকা কি কারনে আফগানিস্থানে হেরে গেল?
দীর্ঘদিন ধরে লড়াইয়ে ব্যর্থ হয়ে আমেরিকা ২০২১ সালের আগস্টের মধ্যে যাবতীয় সৈন্য আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নিয়েছে। প্রায় কুড়ি বছর ধরে পশ্চিমী দেশগুলির সমর্থনে আমেরিকা তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছে আফগানিস্তানে। দীর্ঘ এই লড়াইয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ৯৭৮ মিলিয়ন ডলার। নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ৯ / ১১-এর হামলার পরেই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লু বুশ তালেবানদের নিশ্চিহ্ন করতে আফগানিস্তানের মাটিতে যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। আফগান প্রতিরক্ষা ও সুরক্ষা বাহিনী বহুদিনের চেষ্টাতেও তালিবানের বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। আশা ছিল সর্বোত্তম, সর্বাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত আমেরিকান সৈন্য পশ্চিমী বিশ্বের সমর্থনে তালিবানকে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হবে! কিন্তু এবার যুদ্ধ-ক্লান্ত আমেরিকা নিঃশব্দে পিছু হটেছে। এই লড়াইয়ে বহু অর্থ জলেই গেছে কেবল, তালিবানি জঙ্গিদের নিকাশ করতে অক্ষম হয়েছে আমেরিকাও।
প্রশ্ন উঠতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশ আমেরিকা কিভাবে পরাস্থ হতে পারে তালেবানের কাছে? উত্তরটা খুব সহজ। শুধুমাত্র ড্রাগ, ড্রাগ ও ড্রাগ। শুধুমাত্র পোস্ত অর্থনীতির উপর নির্ভর করেই গত কয়েক বছর ধরে তালিবানের বার্ষিক আয় প্রায় 1.5 বিলিয়ন ডলার। জানলে অবাক হবেন তালিবান আফগানিস্তানকে বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম আফিম উত্পাদনকারী দেশে পরিণত করেছে। ইউএনওডিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২০ সালে আফগানিস্তানে আনুমানিক ২,২৪,০০০ হেক্টর জমি আফিম চাষের আওতায় ছিল। শুধুমাত্র এই পোস্ত চাষের ওপর নির্ভর করেই তালিবান দফায় দফায় দরিদ্র চাষীদের কাছ থেকে কর আদায় করে। নিরুপায় আফিম চাষীদের কাছ থেকে তালিবান উৎপাদিত ফসলের ১০ শতাংশ “চাষাবাদ কর” বাবদ আয় করে। এ তো গেল কেবল প্রথম পর্যায়ের কথা। আফগানিস্তানের যে সমস্ত পরীক্ষাগারগুলোতে আফিমকে হেরোইনে রূপান্তরিত করা হয় সেখান থেকেও উচ্চ মানে করে সংগ্রহ করে তালিবান। বর্তমানে আফগানিস্থানে প্রায় 400 থেকে 500 পরীক্ষাগার রয়েছে আফিমকে হেরোইনে রূপান্তর করার জন্য।
এরপর আসে আসল পর্যায়। অবৈধ আফিম এবং হেরোইন সরবরাহে নিযুক্ত চোরাকারবারীদের উপরেও তালিবান আরোপ করেছে কর। এছাড়া অবৈধ ওষুধ থেকেও তালিবানের লাভ নেহাত কম নয়। আফগানিস্থানের অবৈধ ঔষধ অর্থনীতিতে তালিবানের অংশীদারিত্ব প্রায় 100 মিলিয়ন থেকে 400 মিলিয়ন ডলারের মতো। এছাড়া, দখল করা অঞ্চলে টেলিসংযোগ, মোবাইল ফোন অপারেটর, বিদ্যুৎ গ্রাহক, চরম লুটতরাজ থেকেও অসংখ্য আয় হয় তালিবানের।
অসংখ্য মূল্যবান খনিজ ও পাথরে সমৃদ্ধ আফগানিস্তানে তালিবান একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করে এক প্রকার লুঠটরাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্থানে প্রচুর অবৈধ খনন ঘটে যার জন্যও কর আমদানি করে তালিবান।এই অবৈধ খনন থেকেই বার্ষিক অনুমানিক ৫০ মিলিয়ন ডলার আয় তালিবানের। তাছাড়া গভীর-মূলযুক্ত ধর্মীয় কোণ থাকায় পাকিস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতারের অনেক ধর্মান্ধ ধনী নাগরিক বেসরকারি ভাবে লুকিয়ে নিয়মিত তালেবানকে আর্থিক সহায়তা করে থাকে।
অর্থের কোন অভাব না থাকার ফলে ঠিক যা অঘটন ঘটার তাই ঘটেছে। তালিবানি জঙ্গিদের অস্ত্রশস্ত্র স্বাভাবিক ভাবেই আফগান বাহিনীর চেয়ে অনেকাংশে উন্নত। তালিবানি অস্ত্রাগারের অসংখ্য ভারী মেশিনগান, রাইফেল বর্ম সুরক্ষিত যানবাহন রয়েছে।এর মধ্যে অবশ্য ৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেলটিই সবচেয়ে বেশি পছন্দের তালিবানি জঙ্গিদের। আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধে সব চেয়ে বেশি এই রাইফেলের ই দেখা পাওয়া যায়। এছাড়া আফগান সেনাবাহিনী ও পুলিশকে দেওয়া বহু আমেরিকান অস্ত্র ও হাতে রয়েছে তালিবানের। তালিবানদের সবচেয়ে পছন্দের।
কিন্তু এবার প্রশ্ন হলো ভারতের মিত্র এই প্রতিবেশী দেশটির সর্বনাশ ঠিক কতটা প্রভাব ফেলবে ভারতের ওপর?
আফগানিস্তানে ও মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনার পুনরবৃত্তি ঘটলে ভারতের কাশ্মীর ইস্যু , মাদক চক্র এবং ইন্টার্নাল সিকিউরিটি যে ভয়ানক সমস্যার মুখোমুখি হবে তা বলাই বাহুল্য।
আইএসআই মধ্যপ্রাচ্যে শক্তি হারালেও এখনও তালিবানের মধ্যে রয়ে গেছে প্রত্যক্ষ আইএসআই প্রভাব। ফলে, আফগানিস্তানে তালিবানের সাহায্যে ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করলে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচবে না ভারত। আফগানিস্তান এবং ভারত কারোর সাথেই বন্ধুত্ব নেই পাকিস্থানের। এমতাবস্থায় পাকিস্থানের সেনা বাহিনী যে সীমান্ত পেরিয়ে এবং ভূগর্ভস্থ টানেলের মাধ্যমে তালিবান কে কাশ্মীর অনুপ্রবেশে সহায়তা করবে না তার নেই কোনো প্রতিশ্রুতি। এই বিষয়ে মেজর গৌরব আর্য কে এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন ” যুদ্ধের পরবর্তী পটভূমি হয়ে চলেছে কাশ্মীর। তাই এই মুহূর্তে আমাদের অত্যন্ত সচেতন থাকতে হবে। এবারের যুদ্ধ কিন্তু রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বা আর্টিকেল ৩৭০ নিয়ে নয় বরং তালিবানের কাশ্মীর দখলের চেষ্টা নিয়েই হবে। আমাদের তাই যেকোনো মুহূর্তে হামলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”
দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তান তালিবানের অধীনে আসার ফলে ভারতে ড্রাগের রমরমা বাড়বে হু হূ করে। একই ড্রাগ প্রডিউসিং রিজিওন-গোল্ডেন ক্রিসেন্ট এবং গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল এর মাঝে অবস্থিত হওয়ায় বর্তমানে আমেরিকার প্রহরা থাকা সত্ত্বেও প্রচুর পরিমাণে ড্রাগ ল্যান্ড রুট এবং সামুদ্রিক চ্যানেলের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশ থেকে ভারতে আমদানি করা হচ্ছে। তারওপর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো ভারতেও দুর্নীতি এক বড় সমস্যা হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচ্ছন্ন মদত এবং দুর্নীতিগ্রস্থ আমলাদের দোষে বেশিরভাগ সময়ই এই সমস্ত চোরাচালান র্যাকেটের হদিস পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠছে । আবার কখনো হদিস পাওয়া গেলেও দেশের দুর্বল ড্রাগ রুল ও দুর্নীতির জন্য প্রায়ই বেকসুর খালাস পেয়ে যাচ্ছে দোষীরা। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য বর্তমানে মাদক মাফিয়াদের অবাধ চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয় রাজনৈতিক মদত থাকার কারণে বিভিন্ন এজেন্সি চেয়েও এই মাদক পাছার রুখতে কিছু করে উঠতে পারছে না। এই রকম পরিস্থিতে আফগানিস্তান দখল করে তালিবান যদি সর্বত্র অবাধ ড্রাগ উৎপাদনের সুযোগ পায় তাহলে তার ফলস্বরূপ ড্রাগ আমাদের দেশেও সহজলভ্য হয়ে উঠবে। আর এর প্রভাব আমাদের যুব সমাজের উপর যে ঠিক কতখানি প্রভাব ফেলবে তা একেবারেই কল্পনাতীত।
তৃতীয় কারণ হলো ইন্টার্নাল সিকিউরিটি। কাশ্মীরের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ধর্ম কে হাতিয়ার করে তালিবান ও অন্য জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি বহুকাল ধরেই এই দেশের শিক্ষিত যুবকদের মগজ ধোলাইয়ের চেষ্টা চালিয়ে আসছে ভারতের বিরুদ্ধে তাদের অস্ত্র হিসাবে ব্যাবহার করার জন্য। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের পরিকল্পনা সফল করে যে আবার বেশ কিছু যুবক জঙ্গিদের পাতা এই ফাঁদে পা দিচ্ছে তা কেরালার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনারের মন্তব্যেও পরিষ্কার হয়েছে অনেকটা। তার মতে কেরালা যেভাবে সন্ত্রাসবাদী দলগুলির জন্য নিয়োগ ক্ষেত্র হয়ে উঠছে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই একই সুর শোনা গেছে ভারতের চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত এর গলায়। বেশি বিবরণ তিনি যদিও দেন নি তবে আফগানিস্থান তালিবানের অধীনে এসে গেলে ভারতে জঙ্গি সমস্যা যে অনেকটাই বেড়ে যাবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই কোনো। একই সঙ্গে ভারতে অবৈধ ভাবে বাংলাদেশী এবং রোহিঙ্গা আগমন এই সমস্যা আরও অনেকটাই বাড়িয়ে দিতে পারে বলে সন্দেহ। এরকম পরিস্থিতে অভ্যন্তরীণ ঝামেলা, সাম্প্রদায়িকতা সামলে আলোচনার মাধ্যমে ভুল পথে পা বাড়ানো যুবকদের শোধনের মাধ্যমে পুনরায় সঠিক রাস্তায় কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায় তা চিন্তা করতে হবে ভারত সরকারকেই। অদূর ভবিষ্যতে জঙ্গি সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ন্ত্রন করার এটাই একমাত্র পথ। এখন দেখা যাক সামনের এতো বড় পরীক্ষা ঠিক কি ভাবে উৎরায় ভারত সরকার।