ভারত

হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, ধর্মের মানুষদের প্রিয় স্থান কৈলাস মন্দিরের কি দৈবিক ক্ষমতা রয়েছে জানেন?

হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র স্থান বলা হয় কৈলাস মানস সরোবরকে। বিশ্বাস করা হয় এখানে স্বয়ং মহাদেব ও মা পার্বতী বসবাস করেন। তিব্বতে অবস্থিত এই জায়গা থেকেই পান্ডবরা স্বর্গারোহন শুরু করেছিল বলে কথিত আছে, সেজন্য এই জায়গাকে স্বর্গের সিঁড়ি ও বলা হয়। সবচেয়ে আশ্চর্য জনক ব্যাপার হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতম পর্বত মাউন্ট এভারেস্টে আজ পর্যন্ত ৪০০০ বারের বেশী অভিযান হয়েছে, প্রতিবছর এখানে প্রচুর অভিযান হয় কিন্তু আজ পর্যন্ত কৈলাস পর্বতে কেউ উঠতে পারেনি। এভারেস্টের উচ্চতা ৮৮৪৮ মিটার কিন্তু কৈলাস পর্বতের উচ্চতা এর থেকে ২০০০ মিটার কম প্রায় ৬৭১৭ মিটারের মতন কিন্তু তাও এখানে কেউ উঠতে পারেনি। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, তাও ধর্মের লোকেদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এই জায়গায় এমনই দৈবিক ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করা হয় যার জন্য এখানে কেউ উঠতে পারেনা। 

১৯২৬ সালে ব্রিটিশ কর্নেল আর সি উইলসন কৈলাসে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তিনি জানান যখনই মনে হচ্ছিল এবার কৈলাসে ওঠা খুবই সহজ হবে তখনই হঠাৎ আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়, তুষারপাত শুরু হয় এবং তিনি কৈলাসে উঠতে পারেননি। অস্ট্রেলিয়ান পর্বতারোহী হার্বার টিচি ১৯৩৬ সালে কৈলাসে ওঠবার জন্য একজন শেরপা কে বলে। কিন্তু শেরপা জানান কৈলাসে শুধুমাত্র সেই ব্যাক্তি উঠতে সক্ষম যে পবিত্র এবং যার ভিতরে কোন পাপ নেই। ১৯৮০ সালে বিখ্যাত জার্মান পর্বতারোহী রেইনহোল্ড মেসনার কৈলাস পর্বতে ওঠার প্রস্তাব নাকোচ করে দেয়। বলা হয় কৈলাসে ওঠবার সময়ে হঠাৎই আবহওয়া পরিবর্তন হয়ে যায়। আবার এটাও বলা হয় কৈলাসে উঠতে বয়স খুব দ্রুত বেড়ে যায়,হাতের নোখ, মাথার চুল দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এক সাইবেরিয়ান পর্বতারোহী কৈলাসে ওঠার চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়ে ফিরে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থ স্কন্দ পূরান, শিব পূরান, মতস পূরান সহ মহাভারতে বলা হয়েছে কৈলাস মহাদেব ও দেবী পর্বতের ঘর। এখানে পবিত্র আত্মারা থাকে।

কৈলাস পর্বতকে গোল্ডেন পর্বত বলা হয় কারন সূর্যের আলো যখন এই পর্বতের উপর পড়ে তখন একে দেখতে পুরো উজ্জ্বল সোনালী বর্নের লাগে। কৈলাস পর্বতকে উত্তর, দক্ষিন, পূর্ব, পশ্চিম চার দিক দিয়ে চার রকম লাগে দেখতে, এটা বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার। কৈলাস পর্বতের উপরিভাগ দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতন কিন্ত এর আয়তন পিরামিডের থেকে অনেক বড়। কৈলাস পর্বত কীভাবে তৈরি হয়েছে সেটা নিয়েও অনেক গল্প আছে। আজ থেকে প্রায় ৩০ মিলিয়ন সাল আগে যখন হিমালয় পর্বতমালার গঠন হয় তখনই কৈলাস পর্বত তৈরি হয়। তবে স্থানীয় তিব্বতিদের বিশ্বাস অনুযায়ী দৈবিক শক্তিরা এই পর্বত তৈরি করেছে। হিন্দুদের পাশাপাশি জৈন ধর্ম অনুযায়ী তাদের ধর্মগুরু ঋষভদেব কৈলাসেই নিরবনা হয়েছিলেন অর্থাৎ জাগতিক কর্মবন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন। তিব্বতিদের বিশ্বাস অনুযায়ী কৈলাস পর্বত সিংগলে বজ্রের ঘর যিনি অসীম খুশী প্রদানকারী। তিব্বতে কৈলাস পর্বতকে কাং রেম্পোচে বলা হয় যার অর্থ মূল্যবান রত্ন। কৈলাস মানস সরোবর তিন ভাবে যাওয়া যায়। প্রথম নেপালের কাঠমান্ডু হয়ে যাওয়া যায়, দ্বিতীয়ত সরাসরি চীন থেকে যাওয়া যায়, তৃতীয়ত ভারতের উত্তরাখন্ড হয়ে যাওয়া যায়। ইন্দো চীন ঝামেলার কারনে ১৯৬২ এর পর প্রায় দুই দশক ধরে কৈলাস পর্বত যাত্রা ভারতীয়দের বন্ধ ছিল। ১৯৮১ সাল থেকে আবার কৈলাস সরোবর যাত্রা শুরু হয়। তবে ভারত থেকে কেও ইচ্ছে করলেই কৈলাস যেতে পারবেনা। ভারতে একমাত্র কেএমভিএন বা কুমায়ুন মন্ডল বিকাশ নিগম এই ভ্রমন করায়, এছাড়া নেপাল বা চীনের কোন ভ্রমন সংস্থার সাথে ভারতীয় সংস্থা যৌথভাবে এই যাত্রা করায়। প্রথমে কেএমভিএনের ওয়েবসাইটে ৫০০০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করাতে হয় তবে এই মূল্য ফেরতযোগ্য নয়। এরপর কেএমভিএন মেল পাঠায় এবং নির্দিষ্ট হসপিটালে মেডিক্যাল চেকআপ হয়। এরপর উত্তরাখন্ডের ১৭০০০ ফুট উচ্চতায় লিপুলেখ পাস হয়ে কৈলাস মানস সরোবর যাত্রা শুরু। 

লিপুলেখ পাস থেকে কৈলাস প্রায় ৯৭ কিলোমিটার দূরে। সমগ্র যাত্রায় প্রায় ২৪ দিন সময় লাগে এবং মাথাপীছু ৪০-৫০ হাজার অবধি খরচ হয়। তবে সিকিমের গ্যাংটক থেকেও নাথুলা পাস হয়ে এই যাত্রা হয় যাতে ২১ দিন সময় লাগে। কৈলাস যাত্রা সাধারনত দলবদ্ধ ভাবে হয় কারন চীন একজনের ভিসা দেয় না। কৈলাস চায়না অধিকৃত তিব্বতে অবস্থিত হওয়ায় এখানে যাবার জন্য অবশ্যই পাসপোর্ট লাগে। সাধারনত মে থেকে অক্টোবর হচ্ছে এই যাত্রার আদর্শ সময়। এখানকার রাস্তা খুবই খারাপ যার জন্য এখানে যাবার জন্য যথেষ্ট শারীরিক সক্ষম হতে হয়। বলা হয় কৈলাস পর্বত প্রদক্ষিন করলে জীবনে মুক্তি প্রাপ্ত হয়। কৈলাস পর্বতের পাদদেশেই দুটি লেক রয়েছে। একটি মানস সরোবর এবং আরেকটি রাক্ষস তাল। মানস সরোবরের জল খুবই মিষ্ট এবং এটি বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চতম মিষ্টি জলের হ্রদ। 

রাক্ষস তাল বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চতম লবনাক্ত জলের হ্রদ। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার মানস সরোবর ও রাক্ষস তাল একদম পাশাপাশি তাসত্ত্বেও দুটির চরিত্র ভিন্ন যা বিজ্ঞানীদের অবাক করে। হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী মানস সরোবরের জল ভীষন পবিত্র ধনাত্মক শক্তির আধার এটি। অন্যদিকে বলা হয় রাক্ষস তালের সামনে তপস্যা করলে রাবনের মত আসুরিক শক্তি প্রাপ্ত হয়। এখানে প্রায়ই ওম কার ধ্বনি এবং ডমরুর শব্দ শোনা যায়। বিজ্ঞানীদের দাবি বরফ গললে এমন শব্দ হয়। ভৌগলিক ভাবে পৃথিবীর একদিকে উত্তর মেরু এবং অন্যদিকে দক্ষিন মেরু রয়েছে। এই দুই মেরুর মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে হিমালয় এবং হিমালয়ের মাঝে রয়েছে কৈলাস পর্বত। একে ফোকাল পয়েন্ট বা বিজ্ঞানের ভাষায় অ্যাক্সিস মুন্ডি বলা হয় যার অর্থ পৃথিবীর ভৌগলিক মেরুর কেন্দ্র। কৈলাস পর্বত, বারমুডা ট্রাঙ্গাল, ইস্টার দ্বীপ এবং স্টোনহেঞ্জ একই সরলরেখায় অবস্থিত যার জন্য এইসব জায়গায় চুম্বকীয় বল অনেক বেশী হয়। সেজন্য বিজ্ঞানীদের ধারনা এই জন্য এখানকার আবহওয়া এরকম কিন্তু এখানে কোন সংস্থাই তেমন কোন গবেষনা করেনি বিজ্ঞানীরা যা দাবি করেছে সবই অনুমানের ভিত্তিতে। ১১ শতকে তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্ম গুরু মিলেরেপা প্রথম ও শেষ কোন ব্যাক্তি যিনি এই পর্বতে উঠেছিলেন। বন ধর্ম অনুযায়ী এখানে ৩৬০ জন দেবতা বসবাস করে। 

২০১৩ সালে বিজ্ঞানীদের একটি দল তিব্বত পৌঁছায়। স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে তারা গবেষনা করে এটা বুঝতে পারে সনাতন হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে অনেক ব্যাপারে আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে। তারা সেখানে একটি খুবই অদ্ভুত কাহিনী দেখতে পায়। একটি রাতের মধ্যে প্রায় এক লাখ লোক অদৃশ্য হয়ে যায় যেনো তাদের কোনওদিন কোনও অস্তিত্বই ছিলনা। তিব্বতের বিভিন্ন গ্রন্থে এই কাহিনী সম্পর্কে উল্লেখ আছে। ঘটনাটা ঠিক এরকম যে ১৩ শতকে গুগে সাম্রাজ্য বলে একটি অত্যন্ত ধার্মিক সাম্রাজ্য ছিল তিব্বতে। কিন্তু যখন এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয় তখন এই জায়গা জীবন ধারনের জন্য একদমই অনুপযুক্ত ছিল। আশেপাশের রাজ্য ভেবেছিল এই সাম্রাজ্য বেশীদিন টিকবেনা। কিন্তু ১৫ শতক আসতে আসতে এই সাম্রাজ্য অভূতপূর্ব উন্নতি করে। এমন বন্ধুর জায়গা হওয়া সত্বেও এখানকার লোকেদের জীবন ধারনের মান অত্যন্ত উন্নত ছিল। এর কারন হিসাবে গুগে সাম্রাজ্যের লোকেরা বলত এসবই সাম্ভালার লোকেদের দয়ায় হয়েছে। 

সাম্ভালাকে তিব্বতের রহস্যময় নগরী বলা হয় যেখানে দেবতারা বাস করে। হিন্দু ধর্মেও এর উল্লেখ আছে। বিষ্ণু পুরান অনুযায়ী ভগবান বিষ্ণুর দশম অবতার কল্কি অবতারের জন্মথান এখানেই হবে। ১৬৭৩ সালে লাদাখের রাজা গুগে সাম্রাজ্য আক্রমন করে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। কিন্তু যখন লাদাখের সেনা গুগে সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে তখন সবাই অবাক হয়ে যায় যে গোটা সাম্রাজ্যে একটাও মানুষ নেই। চারিদিক ঘিরে ফেলা সত্বেও এক লাখ লোক যেন উবে গেছে রাতারাতি। অনেক খোঁজাখুজির পর বেশ কীছু গুহা পাওয়া যায় যা ১-২ কিলোমিটার লম্বা। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার এইসব গুহা গুলো গিয়ে মিশেছে কৈলাস পর্বতে এবং সেখানে কোন জন মানবের চিহ্ন অবধি নেই তাহলে রাতারাতি এত লোক কোথায় গেল!! আজও এর কোন ব্যাখা পাওয়া যায়নি। তিব্বতিরা অবশ্য বলে এইসব মানুষরা সাম্ভালা নগরে চলে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.