কেন মাহারানা প্রতাপের বীরগতি প্রাপ্তের খবর শুনে কেন আকবর কেঁদে ছিলেন?
রাজেশ রায়: ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বন্দনীয় হিন্দু রাজাদের কাতারে মেবারের মহারানা প্রতাপের নাম সবার উপরে আসে। ইতিহাস বইয়ে মহারানা প্রতাপের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী উল্লেখ আছে হলদিঘাটির যুদ্ধে যেখানে আকবরের সাথে যুদ্ধ হয়। কিন্তু আরও একটি যুদ্ধের কথা আছে যার উল্লেখ খুব কম পাওয়া যায় তা হচ্ছে ব্যাটেল অফ দিওয়ার বা দিভির, এই যুদ্ধে মহারানা প্রতাপের সামনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল ৩৬,০০০ মুঘল সেনা। কিন্তু কোন অজানা কারন বশত ভারতের ইতিহাস বই থেকে এই যুদ্ধের কাহিনী কিছুটা হলেও আড়াল করা হয়েছে। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয় বাবরের মাধ্যমে কিন্তু বাবর দিল্লি জয়ের চার বছরের মধ্যেই মারা যায়, এরপর তার ছেলে হুমায়ুন রাজা হয় কিন্তু হুমায়ুনও মাত্র এগারো বছরই রাজত্ব করতে পেরেছিল। এরপর হুমায়ুনের পুত্র আকবর সিংহাসনে বসে। বলা যায় আকবরের সময়ই আসল মুঘল সাম্রাজ্য শুরু হয়, এই সময়ই মহারানা প্রতাপের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় আকবরের। কী করে আকবর মুঘল সাম্রাজ্যেকে আরও শক্তিশালী করেছিল? আকবর ও মহারানা প্রতাপের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতার কারন কী এবং কী ভাবে এটা শেষ হয়েছিল? কেনই বা মাহারানা প্রতাপের বীরগতি প্রাপ্তের খবর শুনে আকবর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলেছিল?
হুমায়ুনের হঠাৎ মৃত্যুর পর তার পুত্র আকবর মাত্র ১২-১৩ বছর বয়সেই সিংহাসনে বসে। সেই সময় রাজনীতি ও যুদ্ধনীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ আকবরের বলতে গেলে পুরো মুঘল সাম্রাজ্যের দায়িত্ব ছিল বৈরাম খানের উপর। হুমায়ুন নিজেও বৈরাম খানকে অনেক বিশ্বাস করত। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে মুঘল সাম্রাজ্য রক্ষা বৈরাম খানই করেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে আকবর বড় হতে থাকে, যখন আঠারো বছর বয়স হয় আকবরের তখন তার সামনে বাইরের শত্রুর থেকে সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেয় আভ্যন্তরীন সমস্যা। বৈরাম খানের সাথে আকবরের মতবিরোধ শুরু হয় বিভিন্ন ব্যাপারে। আকবর সিদ্ধান্ত নেয় বৈরাম খানকে পুরো মুঘল সাম্রাজ্য থেকে বহিষ্কার করার। আকবর বৈরাম খান কে নির্দেশ দেয় মক্কায় গিয়ে হজ করতে। বৈরাম খান প্রথমে একটু বিরোধীতা করলেও পরে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় কিন্তু তার কপাল এতটাই খারাপ ছিল যে গুজরাটের কাছে হঠাৎ এক আক্রমনে তাকে হত্যা করে হাজি খান। এই হাজি খান পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে সম্রাট হেমুর পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করেছিল, সুতরাং একটা পুরোনো শত্রুতা ছিল। এবার আকবরের লক্ষ হয়ে দাঁড়ায় মুঘল সাম্রাজ্যের আরও বিস্তার। আকবরের সামনে তিনটি প্রধান বাধা ছিল রাজপুত রাজাদের, মেবার ও মালওয়া। আকবর প্রথমে মালওয়া আক্রমন করে। কারন মালওয়ার রাজা ছিল আফগানিস্তানের বাজ বাহাদুর। বাজ বাহাদুর নিজে তেমন যোদ্ধা ছিল না। আসলে বাজ বাহাদুর একটু শিল্পী গোছের মানুষ ছিলেন, সংগীত, ছবি আকা এসবে তার বেশী আগ্রহ ছিল যার জন্য তার সেনাবাহিনীও তেমন শক্তিশালী ছিল না। এই সময় রানী রুপমতির সাথে বিয়ে হয় বাজ বাহাদুরের। রানী রুপমতী ও বাজ বাহাদুরের প্রেম কাহিনী সম্পর্কে অনেক বই আছে। কিন্তু বাজ বাহাদুরের দুর্ভাগ্য হচ্ছে তার বিয়ের পরই আকবর মালওয়া আক্রমন করে শুরু হয় ব্যাটেল অফ সারাংপুর। যাতে আকবরের সামনে খুব সহজেই মালওয়া পরাজিত হয় এবং বাজ বাহাদুর মেবার পালিয়ে যায়, রানী রুপমতী বাধ্য হয়ে আত্মহত্যা করে। এইসময় মুঘল সাম্রাজ্যে অনেক আভ্যন্তরীন বিদ্রোহ দেখা দেয় যা শক্ত হাতে দমন করে আকবর। এরপর আকবর শুরু করে মেবার আক্রমন। রজাপুতানার সবচেয়ে শক্তিশালী রাজত্ব ছিল মেবার। ১৫৬৭ সালে মেবারের চিতোর গড় দুর্গ আক্রমন করে আকবর। এই সময় মেবারের রানা ছিল উদয় সিং দ্বিতীয়। এক বছর ধরে ক্রমাগত আক্রমন করে আকবরের সেনা চিতোর গড়ে প্রবেশ করে এবং ৩০ থেকে ৪০ হাজার সাধারন চিতোর বাসীকে হত্যা করে। উদয় সিং বাধ্য হয়ে গিয়ে একটু দূরে গোকুন্ডা নামক জায়গায় উদয়পুর নামে একটি শহর তৈরি করে। চিতোরের পতন থেকে বাকী ছোট ছোট রাজপুত রাজারা মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসা ঠিক মনে করে। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো পদ্মাবত সিনেমায় আলাউদ্দীন খলজী যে চিতোর আক্রমন করেছিল দেখানো হয়েছিল সেটা এই চিতোরই তবে আলাউদ্দীন খলজী ১৩০৩ সালে চিতোর আক্রমন করে যেখানে আকবর করে ১৫৬৭ সালে। ১৫৭২ সালে উদয় সিং এর মৃত্যু হয়। এরপর মেবারের দায়িত্ব নেয় মহারানা প্রতাপ। দেখুন মহারানা উপাধি উনি পেয়েছিলেন, ওনার আসল নাম প্রতাপ সিং। অসাধারন বীরত্বের জন্য মহারানা উপাধি পান উনি। দায়িত্ব নিয়েই মহারানা প্রতাপ ঘোষনা করেন চিতোর আকবরের কাছ থেকে পুনরায় ছিনিয়ে নেবেন, আশে পাশের সমস্ত ছোট ছোট রাজপুত রাজা যখন মুঘল সাম্রাজ্যের সামনে আত্মসমর্পন করছিল তখন একমাত্র মহারানা প্রতাপ একা দাঁড়িয়ে ছিল আকবরের বিরুদ্ধে। আকবরের নিজের জেনারেলদের আট থেকে নয় বার মহারানা প্রতাপের কাছে পাঠিয়েছিল যাতে মেবার আত্মসমর্পন করে। কিন্তু মহারানা প্রতাপ নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। আকবর বাধ্য হয়ে তার প্রধান জেনারেল মান সিং কে পাঠায় প্রতাপের কাছে তাতেও লাভ হয় না। ঠিক হয় হলদিঘাটিতে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হবে।
হলদিঘাটির যুদ্ধে আকবরের হয়ে যুদ্ধ করে মানসিং, প্রায় দশ হাজার মুঘল সেনার সামনে মাত্র সাড়ে তিন হাজার সেনা ছিল মাহরানা প্রতাপের। কিন্তু তা সত্বেও মহারানা প্রতাপের বীরত্বের সামনে প্রথম থেকেই চাপে পড়ে মুঘল সেনা। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় মুঘল সেনার। মহারানা প্রতাপ তার ঘোড়া চেতকে করে সোজা মানসিং এর হাতির সামনে এসে তাকে বল্লম ছুড়ে মারে কিন্তু অল্পের জন্য প্রানে বেঁচে যায় মান সিং। কিন্তু হাতির গায়ে লাগানো ধারালো ব্লেডের চেতকের পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু খুবই উচ্চ জাতের শক্তিশলী ঘোড়া ছিল চেতক। আহত অবস্থায় ও তীব্র গতিতে মহারানা প্রতাপকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে সরিয়ে আনে চেতক। কিন্তু দুঃখের বিষয় চেতক মারা যায়। ইতিহাস বলে হলদিঘাটির যুদ্ধে মহারানা প্রতাপ হেরে যায় কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করলে দেখা যায় এই যুদ্ধে কোন পক্ষই জয়লাভ করেনি। মান সিং এর লক্ষ ছিল মেবারকে দখল করে মহারানা প্রতাপকে আটক করে আকবরের সামনে উপস্থিত করা কিন্তু উল্টে মানসিং নিজেই কোনও রকমে প্রান বাঁচায়। আসলে আকবরের সেনার কাছে মাস্কেটম্যান নামে বড় বড় বন্দুক ধারী কিছু সেনা ছিল যার জন্য মহারানা প্রতাপের সেনার ক্ষয়ক্ষতি হয়, এটা না হলে হলদিঘাটিতে শোচনীয় পরাজয় হত মুঘল সেনার। মুঘল সেনা হলদিঘাটির যুদ্ধে কিছু লাভ করতে না পেরে মহারানা প্রতাপের একটি বিশাল হাতি যার নাম রাম প্রসাদ তাকে দিল্লি নিয়ে যায় ধরে। আকবর এই হাতির নাম পাল্টে রাখে পীর প্রসাদ। এই হাতিটি মহারানা প্রতাপকে এত ভালবাসত যে দিল্লি গিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে কোনও কিছু না খেয়ে মারা যায়। বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের সেনার সামনে সরাসরি যুদ্ধ করা যাবে না এটা বুঝতে পারে মহারানা প্রতাপ কারন মুঘল সাম্রাজ্যের কাছে সম্পদ, লোকবল, আধুনিক অস্ত্র, তোপ, বন্দুক সব ছিল, তাই গোরিলা যুদ্ধের নীতি নেয় মহারানা প্রতাপ। নতুন করে সেনা গঠন শুরু হয়। মহারানা প্রতাপ তার সমস্ত রাজকীয় সম্পদ, জমি বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে। ওনার মন্ত্রী ভামা শাহ প্রচুর সাহায্য করে মহারানা প্রতাপকে যাতে ৪০,০০০ সদস্য যুক্ত বিশাল সেনা গঠন করা হয়। এই সময় মেবাররের আশেপাশে কুম্ভলগড় থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে দিভির নাম জায়গায় আকবরের বিশাল সেনা গুজরাটের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল যার নেতৃত্বে ছিল আকবরের কাকা সুলতান খান ও আকবরের সবচেয়ে শক্তিশালী জেনারেল বল্লোল খান। আসলে আকবর যেকোনও ভাবে গুজরাট দখল করতে চাইছিল কারন গুজরাট সেসময় ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল যা দখল করলে অনেক রাজস্ব আদায় হত মুঘল সাম্রাজ্যের। মহারানা প্রতাপ এই বহরের উপর আক্রমন করে। রজাপুত সেনা দুভাগে ভাগ হয়ে মুঘল সেনার উপর আক্রমন করে। একটি ভাগের নেতৃত্ব দেয় মহারান প্রতাপের ছেলে অমর সিং এবং আরেকটি ভাগ স্বয়ং মহারানা প্রতাপ নিজে নেতৃত্ব দেয়। অমর সিং সুলতান খানকে এবং মহারানা প্রতাপ বল্লোল খানকে হত্যা করে। বলা হয় মহারানা প্রতাপ এত দ্রুত গতিতে তরোয়াল চালায় যাতে ঘোড়া সহ বল্লোল খান দুই টুকরো হয়ে যায়, এই ঘটনা দেখে ভয়ে ৩৬,০০০ মুঘল সেনা মহারানা প্রতাপের কাছে আত্মসমর্পন করে দেয়। এভাবে ব্যাটেল অফ দিভারে মহারানা আকবরের কাছ থেকে মেবারের বিশাল অংশ পুনরায় ছিনিয়ে নেয়। আকবরের জীবনে এটা সবচেয়ে বড় পরাজয় ছিল। ১৫৯৭ সালে ভারত মায়ের বীর পুত্র মহারানা প্রতাপ বীরগতি প্রাপ্ত হন। তবে তিনি কোনও যুদ্ধে মারা যাননি, শিকারে বেড়িয়ে একটি দুর্ঘটনায় অনেকদিন পর বীরগতি প্রাপ্ত হন। এই খবর যখন আকবরের কাছে পৌঁছায়, আকবর নিজে সবার সামনে কেঁদে ফেলে। কারন গোটা ভারতে একমাত্র মহারানা প্রতাপই মুঘল সাম্রাজ্যের সামনে মাথা নোয়ায় নি। আকবর তার জীবনে এত বড় বীর কোনওদিন দেখেননি। আকবর যার জন্য মহারানা প্রতাপকে সম্মান করতেন অনেক।