পাকিস্তান

পাকিস্তানের সাথে কেন এত বন্ধুত্ব তুরস্কের?

নিউজ ডেস্কঃ “কথায় আছে শত্রুর শত্রু আমার মিত্র” ঠিক তেমনই আবার ভেবে দেখুন যে শত্রুর মিত্র আমার শত্রু। এটা শুধু ব্যাক্তিগত ক্ষেত্রে নয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এমনই হয়ে থাকে। অর্থাৎ পাকিস্তানের বন্ধু যে ভারতবর্ষের শত্রু হবে তা বলাই বাহুল্য। পাকিস্তানের বন্ধু চীন সকলেরই জানা যদিও পাকিস্তানকে আসতে আসতে নিজেদের উপনিবেশে পরিনত করতে যে চীন এই কাজ করছে তা ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন একাধিক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞেরা। পাকিস্তানের বেশ কিছু জায়গায় এখন চীনা মুদ্রা বৈধ। তবে শুধু চীন নয়, চীনের পাশাপাশি পাকিস্তানের আরও এক বন্ধু আছে যারা এই মুহূর্তে তাদের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমর্থনের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দিয়ে আসছে। তুরস্ক। আসতে আসতে শক্তি বাড়াচ্ছে দেশটি তবে অনেকের সাথেই এই মুহূর্তে বেশ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে তারা। ভারতের বন্ধু ফ্রান্স এবং ইসরায়েলের সাথে তাদের সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায়। ইতিমধ্যে কয়েকবার ফ্রান্স তাদের রাফালে নিয়ে তুরস্কতে হামলাও করেছে। তবে তুরস্কের সেনাবাহিনী কতটা শক্তিশালী?

জনশক্তি, যুদ্ধাস্ত্র, প্রযুক্তি-প্রশিক্ষণ ও সামরিক ব্যয়সহ বিভিন্ন দিক থেকে তুর্কি সামরিক বাহিনী বেশ শক্তিশালী। ১৯৫২ সাল থেকেই দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য।

সমরশক্তি বিষয়ক আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের ২০১৬ সালের র‍্যাঙ্কিং এ বিশ্বে সামরিক শক্তির দিক থেকে তুরস্কের অবস্থান অষ্টম। শক্তিশালী সামরিক বাহিনীগুলোর এই তালিকায় ১২৬টি দেশের মধ্যে তুরস্কের ওপরে অবস্থান করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জাপান। জার্মানি, ইতালি কিংবা পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানও এ ক্ষেত্রে তুরস্কের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। দেশটির ২০১৬ সালের সামরিক বাজেট ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার।

গঠন ও আয়তন
সংবিধান অনুযায়ী তুর্কি সামরিক বাহিনীর বর্তমান কমান্ডার ইন চিফ বা সর্বাধিনায়ক দেশটির প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান। সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। আর বাহিনীর কার্যক্রম সমন্বয় ও পরিচালনা করেন চিফ অব জেনারেল স্টাফ বা সশস্ত্রবাহিনী প্রধান। কিছুদিন আগে অভ্যুত্থান চেষ্টার সময় চিফ অব স্টাফ জেনারেল হুলুসি আকারকে বিদ্রোহী সেনারা বন্দী করলে দায়িত্ব দেয়া হয় জেনারেল উমিত দানদারকে। এর পর থেকে তিনিই ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া স্থল, নৌ ও বিমান প্রতিটি বাহিনীর একজন করে জেনারেল পদমর্যাদার কমান্ডার ও লেফট্যানেন্ট জেনারেল পদমর্যাদার চিফ অব স্টাফ নিয়োজিত থাকেন। সামরিক বাহিনীর সদর দফতার রাজধানী আঙ্কারায়।

তুর্কি সামরিক বাহিনীর বর্তমান সদস্যসংখ্যা ৪ লাখ ১০ হাজার। আর রিজার্ভ সদস্য রয়েছে আরো এক লাখ ৭৮ হাজার ৭০০ জন। আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যসংখ্যা এক লাখ ৫২ হাজার। সব মিলে দেশটির বর্তমান সামরিক জনশক্তি ৭ লাখেরও বেশি।

সেনাবাহিনী
‘তুর্কি স্থলবাহিনী’ নামে পরিচিত দেশটির সেনাবাহিনী। যার সদস্যসংখ্যা প্রায় চার লাখ। এই বাহিনীর বর্তমান কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জেনারেল সালিহ জেটি চোলাক। চিফ অব স্টাফ লেফট্যানেন্ট জেনারেল ইহসান উইয়ার।

প্রধানত চারটি ডিভিশন রয়েছে তুরস্কের সেনাবাহিনীর ফার্স্ট আর্মি (ইস্তাম্বুল), সেকেন্ড আর্মি (মালাতায়া), থার্ড আর্মি (ইরজিনকান) ও আজিয়ান আর্মি (ইজমির)। এই ডিভিশনগুলোর অধীনে রয়েছে ১০টি কমান্ড। আর কমান্ডগুলোর অধীনে রয়েছে শতাধিক সেনা ব্রিগেড। এ ছাড়া রয়েছে সেনাবাহিনীর নিজস্ব বিমান, নৌ ও পুলিশিং ইউনিট।

বাহিনীর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধসরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে ট্যাংক ৩ হাজার ৭৭৮টি, আর্মারড ফাইটিং ভেহিকেল (এএফভি) ৭ হাজার ৫৫০টি, স্বচালিত কামান (এসপিজি) ১ হাজার ১৩টি, ভ্রাম্যমাণ কামান (টিএ) ৬৯৭টি, বহুমুখী রকেট ব্যবস্থা (এমএলআরএস) ৮১১টি।

বিশেষ অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ১০০টি এমজিএম-১৪০ ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা। এই ক্ষেপণাস্ত্র ১০০ মাইল দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। চলতি বছরই নিজস্ব প্রযুক্তিতে উৎপাদিত আলটায় ট্যাংক যুক্ত হয়েছে তুর্কি বাহিনীতে। আছে আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল মিজরাক-ইউ। আছে সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি ৬০০ সাঁজোয়া যান বিএমসি কিরপি। পান্টার হুইটজার নামক অত্যাধুনিক কামান, যার পাল্লা ২৫ মাইল।

বিমান বাহিনী
তুর্কি বিমান বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল আবদিন উনাল, চিফ অব স্টাফ লেফট্যানেন্ট জেনারেল মোহাম্মদ সানভার। এ বাহিনীর মোট সদস্যসংখ্যা ৬০ হাজার।

প্রধানত পাঁচটি ডিভিশনে বিভক্ত তুর্কি বিমানবাহিনী। ফার্স্ট এয়ার ফোর্স কমান্ড (এসকিশেইর), সেকেন্ড এয়ার ফোর্স কমান্ড (দিয়ারবাকির), স্টাফ ডিভিশন কমান্ড, ট্রেনিং কমান্ড (ইজমির), লজিস্টিক কমান্ড (আঙ্কারা)।

এই কমান্ডগুলোর অধীনে রয়েছে ৯টি যুদ্ধবিমান ঘাঁটি। এ ছাড়া ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি ও ড্রোন ঘাঁটিসহ রয়েছে আরো ১১টি ঘাঁটি ও ৪১টি স্কোয়াড্রন। মোট বিমানসংখ্যা ১০০৭টি, যুদ্ধবিমান ২০৭টি, প্রশিক্ষণ বিমান : ২৭৬টি, হেলিকপ্টার ৪৪৫টি, সামরিক হেলিকপ্টার ৬৪টি।

তুরস্কের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধবিমানের মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরী অত্যাধুনিক এফ-১৬ ফ্যালকন। ২০১৯ নভেম্বরে এই বিমানটিই তুরস্কের আকাশসীমায় প্রবেশকৃত রাশিয়ার এসইউ-২৪এম বোম্বার ভূপাতিত করেছে।

আছে ইসরাইলের তৈরী মনুষ্যবিহীন বিমান আইএআই হিরন। এর সংখ্যা দশটি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের তৈরী সর্বাধুনিক প্রযুক্তির তিনটি প্রিডেটর ড্রোন রয়েছে তুরস্কের। প্রিডেটর ড্রোন শত্রুকে নিজের উপস্থিতি জানতে না দিয়েই মিসাইল হামলা করতে সক্ষম। এর সংখ্যা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির।

নৌবাহিনী
তুর্কি নৌবাহিনীর কমান্ডার অ্যাডমিরাল বুলেন্ত বোস্তানুগলু, চিফ অব স্টাফ ভাইস অ্যাডমিরাল সারদার দুলগার। এই বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৪৮ হাজার ৬০০ জন।

এ বাহিনীর প্রধান ঘাঁটিগুলো হলো, নৌবহর কমান্ড (ফ্লিট), উত্তর সমুদ্র এলাকা কমান্ড, দক্ষিণ সমুদ্র এলাকা কমান্ড, নৌপ্রশিক্ষণ কমান্ড এবং আরো রয়েছে তিনটি বিশেষ বাহিনী কমান্ড। এই কমান্ডগুলোর অধীনে রয়েছে ১৮টি নৌঘাঁটি।

তুর্কি নৌবাহিনীর যুদ্ধ সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে ফ্রিগেট ১৬টি, বিশেষ রণতরী ৮টি, সাবমেরিন ১৩টি, উপকূল প্রতিরক্ষা যান ২৯টি, মাইন ব্যবস্থাপনা যান ১৫টি, হেলিকপ্টার ও বিমান মোট ৫১টি, ব্যবহৃত বন্দর ৯টি। জার্মানির তৈরি টাইপ-২০৯ সাবমেরিনগুলোর প্রত্যেকটি ১৪টি টর্পোডো বহন করতে সক্ষম। আছে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরী যুদ্ধজাহাজ।

ন্যাটো ঘাঁটি
১৯৫২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ন্যাটো জোটে যোগ দেয় তুরস্ক। এরপর থেকে দেশটি এই সামরিক জোটের ইস্টার্ন কমান্ড হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পর তুরস্কের সামরিক সক্ষমতা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে তারা কৃষ্ণসাগর, আজিয়ান সাগরসহ ওই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দখলে রেখেছে। বর্তমানে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আয়তনের দিক থেকে তুর্কি সামরিক বাহিনীর অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই। তুরস্কে মোট ২৪টি ঘাঁটি রয়েছে ন্যাটোর।

তুরস্কে ন্যাটোর সবচেয়ে বড় ঘাঁটি ইনসিরলিক বিমান ঘাঁটি। তিন হাজার ৩২০ একর জায়গার ওপর নির্মিত এই ঘাটিটির অবস্থান দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আদানায়। ইনসিরলিক ঘাঁটিতে প্রায় পাঁচ হাজার মার্কিন বিমান সেনা ও আরো কয়েক হাজার ব্রিটিশ ও তুর্কি সেনা রয়েছ। ১৯৫৫ সালে এই ঘাঁটিটি চালু হয়েছে। বর্তমানে ইরাক ও সিরিয়ায় জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান হামলা পরিচালিত হয় এই ঘাঁটি থেকে। তবে তুরস্কে ন্যাটো তথা মার্কিন সেনাদের ব্যবহৃত সবচেয়ে পুরনো ঘাটি ইজমির বিমান ঘাটি। ১৯৫২ সালে এখানে প্রথম মার্কিন সেনারা অবস্থান নেয়। অন্যান্য ঘাঁটিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

এ ছাড়া তুরস্কে মোতায়েন রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পিজিএম-৯ জুপিটার পারমানবিক ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা। আছে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়টিক ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published.