আমেরিকার এফ ১৬ বনাম ভারতের তেজস মার্ক ২। কোনটি বেশী বিধ্বংসী?
আধুনিক যুগে একটি ইঞ্জিন বিশিষ্ট যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে এখনও আমেরিকার এফ ১৬ অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুদ্ধবিমান। ১৯৭৪ থেকে ২০২৩ অবধি ৪৯ বছর ধরে আকাশ যুদ্ধে রীতিমতো ঘাতক যুদ্ধবিমান এই এফ ১৬। ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েও পৃথিবীর বহু দেশের বায়ুসেনার মেরুদণ্ড এই এফ ১৬। আধুনিক পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের সাথেও সমান তালে পাল্লা দিচ্ছে আমেরিকার এফ ১৬ যুদ্ধবিমান। বর্তমানে পৃথিবীর বহু দেশই এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট যুদ্ধবিমান তৈরি করছে তবুও সেসব যুদ্ধবিমানের থেকে এফ ১৬ কোথাও যেন একটু এগিয়ে রয়েছে। রাশিয়া, জাপান, চীন, দক্ষিন কোরিয়ার মতোন ভারত নিজেও এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট যুদ্ধবিমান তৈরি করছে। যদিও ভারত এক ইঞ্জিনের পাশপাশি পঞ্চম প্রজন্মের দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট আমকা যুদ্ধবিমানও তৈরি করছে। তবে ভারতের তৈরি এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট তেজস মার্ক ২ যুদ্ধবিমানকে এফ ১৬ যুদ্ধবিমানের সমতুল্য প্রতিদ্বন্দ্বী বলা হচ্ছে, যদিও তেজস মার্ক ২ এখনও সার্ভিসে আসেনি। তবে বলা হচ্ছে ২০২৮ সালে যখন তেজস মার্ক ২ যখন সার্ভিসে আসবে তখন এটিও এফ ১৬ এর মতোই শক্তিশালী যুদ্ধবিমান হবে।
** আমেরিকার অ্যাভিয়েশন জায়েন্ট লকহিড মার্টিনের তৈরি এফ ১৬ যুদ্ধবিমান তৈরি হয় আজ থেকে প্রায় ৪৯ বছর আগে ১৯৭৪ সালে। অবশ্য এফ ১৬ প্রথম তৈরি করে আমেরিকার জেনারেল ডায়নামিকস নামে একটি সংস্থা, পরে ১৯৯৩ সালে সংস্থাটি তাদের বিমান তৈরির ব্যবসা লকহিড সংস্থাকে বিক্রি করে দেয়। আমেরিকার বায়ুসেনার জন্য এই মাল্টিরোল যুদ্ধবিমানটি তৈরি করা হয়েছিল। সরকারী ভাবে এফ ১৬ কে ফাইটিং ফ্যালকন নামে ডাকা হয় কিন্ত এফ ১৬ এর পাইলট ও ক্রুরা একে ভাইপার বলে। এফ ১৬ যুদ্ধবিমানকে ফ্লাই বাই ওয়ের সিস্টেমের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করা হয়। ফ্লাই বাই ওয়ের পদ্ধতিতে বিমানের সমস্ত সিস্টেম নিয়ন্ত্রন করে ফ্লাইট কম্পিউটার এবং ইলেকট্রনিক সংকেত। ফ্লাই বাই ওয়ের সিস্টেম পুরোনো যান্ত্রিক পদ্ধতির থেকে অনেক হালকা যার কারনে বিমানের তেল ধারন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ডিজাইন অনেক আধুনিক হয়। ১৯৭৬ সাল থেকে এখনও অবধি অন্তত ৪,৬০০ এফ ১৬ যুদ্ধবিমান তৈরি করা হয়েছে।
** অন্যদিকে তেজস মার্ক ২ ও একটি মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান যা তৈরি করছে এডিএ বা এরোনটিক্যাল ডেভলপমেন্ট এজেন্সি এবং হ্যাল বা হিন্দুস্তান এরোনটিকস লিমিটেড। এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট, ক্যানার্ড ডেল্টা উইং যুক্ত তেজস মার্ক ২ কে তৈরি করা হচ্ছে ভারতীয় বায়ুসেনার সেপক্যাট জাগুয়ার, মিকোয়ান মিগ ২৯ এবং ড্যাসল্ট মিরাজ ২০০০ যুদ্ধবিমানের বিকল্প হিসাবে। ২০২৩ সালে তেজস মার্ক ২ এর ট্যাক্সি ট্রায়াল শুরু করবে হ্যাল এবং ২০২৭ সালে তেজস মার্ক ২ প্রজেক্ট সম্পূর্ন শেষ হবে। ২০২৮ সাল থেকেই তেজস মার্ক ২ ভারতীয় বায়ুসেনায় যুক্ত হবে।
এফ ১৬ বনাম তেজস মার্ক ২:—
এফ ১৬ ফাইটিং ফ্যালকন এবং তেজস মার্ক ২ উভয়েই অত্যন্ত ঘাতক যুদ্ধবিমান, তবে দুটি বিমানই দুটি ভিন্ন প্রজন্মের যুদ্ধবিমান হিসাবে সার্ভিসের জন্য তৈরি হয়েছে যার কারনে দুটি বিমানেই কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
** তেজস মার্ক ২ লাইট কমব্যাট এয়ারক্রাফট বা এলসিএ তেজসের আপগ্রেডেড ভার্সন যা তৈরি করছে এডিএ এবং হ্যাল। অর্থাৎ তেজস মার্ক ২ সম্পূর্ন নতুন একটি যুদ্ধবিমান। অন্যদিকে লকহিড মার্টিনের তৈরি এফ ১৬ একটি যুদ্ধে পরীক্ষিত যুদ্ধবিমান যা গত ৪৯ বছরে অসংখ্য আকাশ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে এবং বিশ্বের বহু দেশ এফ ১৬ ব্যবহার করে।
** তেজস মার্ক ২ মূলত এয়ার সুপিউরিটি এবং মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান। এতে আধুনিক অ্যভিয়েনিক্স, আপগ্রেডেড সেন্সর ইনস্টল করা হয়েছে। এই যুদ্ধবিমান সার্ভিসে এলে ভারতীয় বায়ুসেনার পুরোনো যুদ্ধবিমান গুলো অবসরে যাবে। কিন্ত এফ ১৬ ফ্যালকন একটি বহুমুখী মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান, এটি আকাশ যুদ্ধের পাশাপাশি, আকাশ থেকে ভূমিতে আক্রমনে এবং ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারে সক্ষম।
** তেজস মার্ক ২ পূর্বের মার্ক ১ ভার্সনের তুলনায় অধিক গতি, রেঞ্জ যুক্ত। মার্ক ২ এর অস্ত্র বহন সক্ষমতাও মার্ক ১ এর থেকে বেশী। তেজস মার্ক ২ এর অ্যভিয়েনিক্স মার্ক ১ এর থেকে আধুনিক। তেজস মার্ক ২ এর সর্বোচ্চ গতি ১.৮ ম্যাক এবং কমব্যাট রেঞ্জ ৬০০ থেকে ৮০০ কিলোমিটার। যেখানে এফ ১৬ এর সর্বোচ্চ গতি ২.০৫ ম্যাক। এফ ১৬ এর কমব্যাট রেঞ্জ ৮৬০ কিলোমিটার। অর্থাৎ এফ ১৬ এর কমব্যাট রেঞ্জ ও গতি তেজস মার্ক ২ এর থেকে খানিকটা বেশী।
** তেজস মার্ক ২ তে কোন স্টেলথ বৈশিষ্ট্য নেই, এটি চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। তেজস মার্ক ২ তৈরিতে ম্যানুয়েভারবিলিটি, আধুনিক অ্যাভিয়েনিক্স এবং নেটওয়ার্ক সেন্ট্রিক ওয়ারফেয়ারের উপর বেশী জোর দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে এফ ১৬ যুদ্ধবিমানেও স্টেলথ বৈশিষ্ট্য নেই কিন্ত এফ ১৬ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারে পারদর্শী।
** যেখানে তেজস মার্ক ২ সর্বোচ্চ ৬,৫০০ কেজি পেলোড বহন করতে সক্ষম সেখানে ৭,৭০০ কেজি পেলোড বহন করতে সক্ষম। অর্থাৎ এফ ১৬ তেজস মার্ক ২ এর থেকে বেশী অস্ত্র বহন করতে সক্ষম।
** তেজস মার্ক ২ এর সার্ভিস শিলিং ৫৬,৭৫৮ ফুট কিন্ত এফ ১৬ এর সার্ভিস শিলিং ৫০,০০০ ফুট।
** যেখানে তেজস মার্ক ২ তিনটি জ্বালানি ট্যাঙ্ক সহ ৩,৫০০ কিলোমিটার যেতে সক্ষম সেখানে এফ ১৬ জ্বালানি ট্যাঙ্ক সহ ৪,২১৭ কিলোমিটার যেতে সক্ষম। অর্থাৎ এফ ১৬ এর ফেরি রেঞ্জও তেজস মার্ক ২ এর থেকে বেশী।
** তেজস মার্ক ২ এ অস্ত্র বহনের জন্য ১৩ টি হার্ড পয়েন্ট রয়েছে। এফ ১৬ এ অস্ত্র বহনের জন্য ১১ টি হার্ড পয়েন্ট রয়েছে।
** তেজস মার্ক ২ ও এফ ১৬ উভয়েই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের প্রচুর অস্ত্র বহন করতে সক্ষম।
হ্যাল তেজস মার্ক ২ অস্ত্র হিসাবে অস্ত্র, আসরাম, মিকা, মিটিওর এয়ার টু এয়ার মিসাইল, ব্রাহ্মস এনজি, স্ট্রোম শ্যাডো, ক্রিস্টাল মেজ এয়ার টু সারফেস মিসাইল, রুদ্রম সিরিজের অ্যান্টি রেডিয়েশন মিসাইল, ডিআরডিও এর গ্লাইড বোম্বস, ইসরায়েলের স্পাইস বোম্ব সহ সুদর্শন লেজার গাইডেড বোম্ব, ক্লাস্টার মিউনেশন এবং ক্যাটস আলফা লয়টারিং মিউনেশন বহন করতে সক্ষম।
এফ ১৬ এইম ৯ সাইডউইন্ডার, এইম ১২০ আমরাম, পাইথন ৪,৫ এয়ার টু এয়ার মিসাইল, এজিএম ৬৫ মাভেরিক, এজিএম ৮৮ হার্ম, এজিএম ১৫৮ জ্যাসাম, এজিএম ১৫৪ জয়েন্ট স্ট্যান্ডঅফ এয়ার টু সারফেস মিসাইল, এজিএম ৮৪ হার্পুন, এজজিএম ১১৯ পেঙ্গুইন অ্যান্টি শিপ মিসাইল, হাইড্রা ৭০ মিলিমিটার রকেট সহ একাধিক রকেট ও বোম্ব বহন করতে সক্ষম।
** তেজস মার্ক ২ এর ইঞ্জিনের থেকে এফ ১৬ এর সর্বাধুনিক ভার্সনের ইঞ্জিন অনেক বেশী শক্তিশালী। তেজস মার্ক ২ এ আমেরিকার জেনারেল ইলেকট্রিকের এফ ৪১৪ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হবে যা ৯৮ কিলো নিউটন পর্যন্ত থ্রাস্ট উৎপন্ন করতে পারে। কিন্ত এফ ১৬ এর সর্বাধুনিক ব্লক ৭০ বা ভাইপার ভার্সনে ব্যবহৃত জেনারেল ইলেকট্রিকের নতুন এফ ১১০ জিই ১৩২ ইঞ্জিন ১৪৪ কিলো নিউটন থ্রাস্ট উৎপন্ন করতে পারে।
** এফ ১৬ ব্লক ৭০ এর রেডার তেজস মার্ক ২ এর থেকে শক্তিশালী। তেজস মার্ক ২ এ ভারতের নিজস্ব তৈরি উত্তম এসা রেডার ইনস্টল করা হবে যার রেঞ্জ ১৫০ কিলোমিটার। এফ ১৬ এর সর্বাধুনিক ভার্সন ব্লক ৭০ তে নর্থ্রুপ গ্রুম্যানের তৈরি এপিজে ৮৩ এসা রেডার ব্যবহার করা হয়েছে যাতে এফ ২২ এবং এফ ৩৫ এর প্রযুক্তি রয়েছে। এই রেডারের রেঞ্জ ৩৭০ কিলোমিটার।
এফ ১৬ বহু যুদ্ধে পরীক্ষিত যুদ্ধবিমান, বিশ্বের ২৫ টির বেশী দেশের বায়ুসেনাতে এফ ১৬ যুক্ত রয়েছে। ভারতের প্রধান শত্রু পাকিস্তানের কাছে এফ ১৬ এর পুরোনো ভার্সন রয়েছে যেগুলো সর্বোচ্চ ব্লক ৫০/৫২ ভার্সনে আপগ্রেড করা সম্ভব। ভারতের তেজস মার্ক ২ এই ব্লক ৫০/৫২ ভার্সনের থেকে শক্তিশালী হবে।