জাতিসংঘের ভারতবর্ষের স্থায়ী সদস্যপদকে কেন বাঁধা দিচ্ছে চীন?
আজ থেকে দশ বছর আগে তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা যখন প্রথম বারের জন্য ভারত সফরে আসেন তখন তিনি বলেছিলেন সেই দিন বেশী দূরে নেই যখন ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে স্থায়ী সদস্য পদ লাভ করবে। ইতিহাসে এই প্রথম বারের মতন কোনও আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জনসমক্ষে ভারতকে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য পদের জন্য সমর্থন করেছিল। এরপরে অস্ট্রেলিয়া থেকে শুর করে ফ্রান্স, ব্রিটেন, রাশিয়া বিশ্বের প্রায় সমস্ত শক্তিশালী দেশই ভারতকে সমর্থন করেছিল এই বিষয়ে। তবে বারাক ওবামার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন এ বিষয়ে আমেরিকা তেমন কোন পদক্ষেপ নেয় নি। তবে আমেরিকার বর্তমান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ভোট প্রচারের সময় জানিয়েছিল সে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে এই বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেবে। এখন জো বাইডেনের আমেরিকান সরকার ভারত কে কতটা সমর্থন করবে তা সময় বলবে তবে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যপদ লাভ দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এর জন্য বহু বছর ধরে অনেক দেশের সাথেই ভারত আলোচনা করেছে। জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য পদ পেতে যা প্যারামিটার দরকার হয় ভারত তা সবই অর্জন করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ভারত আজও এই সদস্য পদ লাভ করতে পারে নি। ভারত কী সত্যিই কোনওদিন জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করতে পারবে? কী কী কারনে এখনও ভারত আটকে আছে? এইসব বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
ভারতের জাতিসংঘে স্থায়ী সদস্য পদ লাভের ইতিহাস ততটাই পুরোনো যতটা জাতিসংঘের ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে বিশ্বে শান্তি স্থাপনের জন্য জাতিসংঘ তৈরি হয়। জাতিসংঘ তৈরির সময় যে ৫১ জন সদস্য ছিল ভারত তার মধ্যেই একজন। ভারতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রধান ভূমিকা শুরু হয় কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে ১৯৪৮ এ। সেসময় পাকিস্তানের সমর্থনে স্থানীয় লোক ভারতে আক্রমন করে যা নিয়ে জাতিসংঘে আলোচনা করে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু। কিন্ত জাতিসংঘ তখন পাকিস্তানের বিরোধীতা না করে এটাকে ভারত ও পাকিস্তানের সমস্যা নাম দেয়। যার ফলে তখন এটা ভারতের জন্য একটি বিশাল শিক্ষা হয়। ভারত বুঝতে পারে জাতিসংঘ আসলে একটি রাজনৈতিক সংস্থা এবং এখানের সদস্য দেশ গুলো নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝে না। এভাবেই প্রথমে ভারত ও জাতিসংঘের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা হয়। বলা হয় ১৯৫০ সালে আমেরিকা ভারতকে গোপনে জানায় যে জাতিসংঘে খুব শীঘ্রই তাইওয়ান কে রিপ্লেস করা হবে এবং এর জায়গা ভারতকে দেওয়া হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু স্পষ্ট জানায় সেসময় চীন এর যোগ্য দাবিদার। এটাও বলা হয় যে ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নও ভারতকে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য পদ অফার করে কিন্তু তখনও নেহেরু বলে যে বিশাল ও শক্তিশালী এশিয়ান দেশ হিসাবে ভারতের থেকে চীন দাবিদার এর জন্য। এটা জহরলাল নেহেরুর জীবনের অন্যতম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল যা এখন প্রমান হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারনা সেসময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলা ঠান্ডা যুদ্ধের কারনে ভারত এই বিষয় এড়িয়ে গেছিল। তবে ১৯৫৫ সালে লোকসভায় এক বক্তৃতায় জহরলাল নেহেরু জানায় তাকে এমন কোন প্রস্তাব দেওয়া হয় নি কোনওদিন। তার বক্তব্য ছিল জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য পদ পাবার জবাব জাতিসংঘের নির্দিষ্ট আইন আছে, তা পরিবর্তন না করে ভারতকে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। সেসময় তাইওয়ান জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য ছিল কারন তাইওয়ান ও চীন উভয়েই নিজেদের এক চীন হিসাবে দাবি করত কিন্তু ধীরে ধীরে তাইওয়ান কোনঠাসা হয়ে পড়ে এবং তাইওয়ানের জায়গায় চীন জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য পদ লাভ করে। বর্তমানে জাতিসংঘের পাঁচজন স্থায়ী সদস্য দেশ রয়েছে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও ব্রিটেন। জহরলাল নেহেরু যাই বলুক না কেন আজও তার সিদ্ধান্তকে ভুল বলেই মনে করে ভারতের রাজনৈতিক মহল।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে এখন ভারত বিশ্ব রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী দেশ। বিগত কয়েক দশকে অর্থনীতি ও মিলিটারি পাওয়ারে ভারত বিশ্বের প্রথম সারির দেশে পরিনত হয়েছে। এই মহূর্তে বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী দেশ ভারত। গত সাত দশকে ভারত আটবার জাতিসংঘের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। জাতিসংঘের যে-কোনও শান্তি মিশনে ভারত পাঁচ জন স্থায়ী সদস্য দেশের তুলনায় দ্বিগুণ সেনা পাঠিয়েছে। ১৯৪৮ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত জাতিসংঘের ৭১ টি মিশনের মধ্যে ৪৯ টি মিশনে ভারতের দুই লাখ সেনা অংশ নিয়েছে। ২০০৭ সালে লাইবেরিয়াতে ভারত তার একটি মহিলা সেনাবাহিনীর কম্যান্ডকে মোতায়েন করেছিল। এখনও পর্যন্ত জাতিসংঘের বিভিন্ন মিশনে প্রায় ১৬০ জন ভারতীয় সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছে। যদি ভারতের ব্যাপারে বলা হয় তাহলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ হিসাবে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গনতান্ত্রিক দেশ এবং আজ পর্যন্ত ভারতের গনতন্ত্র অক্ষুন্ন আছে।
ভারতের প্রচুর জাতি ও ভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করে যা ভারতের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ভারতীয় অর্থনীতি যথেষ্ট মজবুত এবং ভারতীয় বজার যথেষ্ট আকর্ষনীয়। ১৯৯৮ সালে ভারত পরমানু সক্ষমতা অর্জন করে কিন্তু তা সত্বেও ভারত পরমানু অস্ত্রের ক্ষেত্রে নো ফাস্ট ইউজ নীতি নিয়েছে যা প্রমান করে ক্ষমতার সাথে দায়িত্ববোধ যথেষ্ট রয়েছে ভারতের। ভারত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ইনফ্রাস্ট্রাকচার, ডিজিটালাইজেশন প্রত্যেক সেক্টরে উন্নতি করছে। আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইটি সেক্টর, ডাক্তার, ইন্জিনিয়ারদের বড় অংশে ভারতীয়রা যুক্ত আছে। ভারত এমটিসিআর বা মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রেজিমের সদস্য। যার অর্থ ভারত ৩০০ কিলোমিটারের বেশী রেঞ্জের মিসাইল বিক্রি ও কিনতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরেই তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোর ক্ষেত্রে একটি অলিখিত লিডার হিসাবেই কাজ করছে ভারত। ১৯৫০ এর দিকে যখন গেটা বিশ্ব আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল তখন ভারত কোনও পক্ষে যোগ না দিয়ে একটি তৃতীয় নিরপেক্ষ সংগঠন তৈরি করেছিল। বর্তমানে জিও পলিটিক্সের একটি উল্লেখযোগ্য নাম ভারত। ভারতের বৈদেশিক রিজার্ভ যথেষ্ট মজবুত। ১৯৫০ সাল থেকে ভারত নিজের যথেষ্ট উন্নয়ন করেছে অর্থাৎ জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য পদ পাবার জন্য যেসব কারন দরকার ভারত তার সব গুলিই পূরন করেছে। এমনকী রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধেও ভারত নিরপেক্ষ থেকেছে। কিন্তু আজও জাতিসংঘে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে পাঁচটি সদস্য দেশ ছিল তারাই আছে কোনও পরিবর্তন হয় নি। জাতিসংঘে ভারতের প্রাক্তন প্রতিনিধি ডঃ আকবরউদ্দিন সৈয়দ বলেন বিশ্বের জিওপলিটিক্স, অর্থনীতি অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আজ জিও পলিটিক্স এশিয়া কেন্দ্রীক বিশেষ করে ইন্দো প্যাসিফিক কেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে কিন্তু তবুও জাতিসংঘে এশিয়ান, আফ্রিকান ও লাতিন আমেরিকান কোন দেশের তেমন ভূমিকা না থাকায় জাতিসংঘের সমতা কিছুটা হলেও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যার জন্য জাতিসংঘে সংশোধন প্রয়োজন।
জাতিসংঘে স্থায়ী সদস্য হিসাবে ভারতের অন্তর্ভুক্তি কিংবা জাতিসংঘের সংশোধন কোনওটাই এত সহজ নয়। এর জন্য জাতিসংঘের স্থায়ী পাঁচ সদস্যদের সম্মতি দরকার। জাতিসংঘ তৈরি হবার পর প্রতি আট, দশ বছর অন্তর অন্তর জাতিসংঘের সংশোধনের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে কিন্তু তা সম্ভব হয় নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারনে জাতিসংঘের সংশোধন করবার দরকার পড়ে যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধের সময় চেষ্টা করা হয়েছিল উভয় পক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক শক্তি গুলোকে তাদের উপনিবেশকে স্বাধীন করতে বলা হয় এবং পরবর্তী সময়ে মানবতা ও আর্থিক বিকাশে জোর দেওয়া হয়। কিন্ত প্রত্যেকবারই পাঁচ সদস্যদের কারও না কারও ভেটো বা বিশেষ ভোট প্রয়োগে এসব সংশোধন প্রক্রিয়া বাতিল হয়ে যায়। জি-৪ দেশ গুলো যারা উভয় উভয়কেই জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য পদ লাভের জন্য সমর্থন করে ভারত, জার্মানি, ব্রাজিল ও জাপান এখনও সদস্য পদ পাচ্ছে না তার একটা কারন এসব দেশ গুলোর প্রতিবেশী ও ঐতিহাসিক ভাবে শত্রু দেশ গুলো এদের সমর্থন করে না।
যেমন জাতিসংঘে পাকিস্তান ভারতকে এবং চীন ও দক্ষিন কোরিয়া জাপানকে সমর্থন করে না। তাহলে মনে হতে পারে জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য পদ লাভের শর্ত কী কী? কোন দেশ কী শুধু গনতন্ত্র, অর্থনীতির জোরে স্থায়ী সদস্য পদ লাভ করতে পারবে! দেখুন জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য পদ লাভ করতে হলে প্রথমে জাতিসংঘের আইনের সংশোধন করা দরকার কিন্তু জাতিসংঘের আইনে আর্টিকেল ১০৮ ও ১০৯ অনুযায়ী কোন আইন পাশ করবার আগে পাঁচজন স্থায়ী সদস্য দেশের ভোট লাগবে যাকে ভিটো বলা হয়, যদি একটি দেশও প্রস্তাবিত আইনে অসম্মত হয় তাহলে সেই আইন বাতিল হয়ে যাবে। যেমন সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য আমেরিকা জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য পদ থেকে রাশিয়াকে বের করে দেবার জন্য একটি প্রস্তাব আনে যা রাশিয়া নিজেই ভিটো প্রয়োগে আটকে দেয়। সুতরাং এই জন্যই জাতিসংঘে কোন সংশোধন করা সম্ভব হচ্ছে না কারন কেউ না কেউ ভিটো প্রয়োগ করছে।
ভারতকে জাতিসংঘে স্থায়ী সদস্য পদ দেবার জন্য আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স ভোট দিয়েছে কিন্তু ভিটো প্রয়োগ করে চীন আটকে দিয়েছে। সুতরাং জাতিসংঘে ভারতকে ঢুকতে হলে চীনেরও ভোট লাগবে। বর্তমানে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে যে স্থায়ী পাঁচ সদস্য দেশ ছাড়াও আরও পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশকে অন্তর্ভুক্ত করার যাতে জি-৪ দেশ গুলো সহ দক্ষিন আফ্রিকাকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে যাতে বিশ্বে সমতা বজায় থাকে। জাতিসংঘের প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনান বলেছেন যদি এখন জাতিসংঘ নিজেকে সংশোধন না করে তাহলে হয়ত ভবিষ্যতে এর অস্তিত্ব নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যদি ভবিষ্যতে জাতিসংঘে সংশোধন হয় তাহলে ভারত অবশ্যই স্থায়ী সদস্য পদ পাবে।