চীন

নেপালকেও লোণের শিকার বানাচ্ছে চীন!

রাজেশ রায়:— আধুনিক নেপালের প্রতিষ্ঠাতা রাজা পিথবী নারায়ন সাহ ভারত ও চীন সম্পর্কে বলেছিলেন নেপাল যেন দুই বিশাল পাহাড়ের মাঝখানে ঘাসের মতন। হিমালয়ের কোলে অবস্থিত নেপাল যেন ভারত ও চীনের মাঝে দেওয়ালের মতন রয়েছে। নেপাল ও ভারতের মধ্যে অনেক মিল আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় নেপাল ঘোষিত হিন্দু রাষ্ট্র। উভয় দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতি একই ধরনের। এই জন্য অনেকেই নেপালকে ভারতের অংশই মনে করে। নেপালি ও হিন্দি ভাষার মধ্যে অনেক মিল, উভয় ভাষাই দেবনাগরী স্ক্রিপ্টে লেখা হয়। নেপালের মাদেশ প্রদেশের মানুষের কথা ও সংস্কৃতি উত্তর প্রদেশ ও বিহারের মানুষের মতই। খোলা সীমান্তের কারনে উভয় দেশের মানুষ উভয় দেশে পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই যাতায়াত করতে পারে। দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় বহু বৈবাহিক সম্পর্ক রয়েছে যার জন্য নেপাল ভারতের সম্পর্কে অনেক সময় রুটি বেটি রিলেশনও বলা হয়। অন্যদিকে বৌদ্ধ সন্নাসী ও পরিব্রাজকদের কারনে চীনের সাথেও নেপালের সম্পর্ক রয়েছে। যদিও নেপাল বারবার জানিয়েছে তারা ভারত ও চীনের সাথে একই রকম সম্পর্ক বজায় রাখে কিন্তু ভাল করে লক্ষ করলে বোঝা যাবে এখানে ব্যাপারটা পুরো উল্টো। বিগত কয়েক বছর ধরে নেপাল ও ভারতের সম্পর্ক যেমন খারাপ হয়েছে তেমন উল্টো দিকে চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে নেপালের। নেপালের সংস্কৃতি, রাজনীতি সবেতেই চীনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। নেপালে ভারতের বিরুদ্ধে চীনের কী পরিকল্পনা রয়েছে? পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতন নেপালও কী চীনের ডেব্ট ট্রাপ ডিপ্লোম্যাসির শিকার হবে?? এসব ব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। সাথে এটাও বিশ্লেষন করা হবে চীনের প্রভাবে নেপালে কী সমস্যা দেখা যাচ্ছে। 

স্ট্রাটেজিক অবস্থানের কারনে বহু দশক ধরেই ভারত ও চীনের মত বড় দুই শক্তির কাছে নেপাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বহু শতাব্দী ধরেই চীনের সাথে নেপালের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। নেপাল ও চীনের মধ্যে ১৪১৪ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত। ঐতিহাসিক ভাবেও নেপাল ও চীনের সংস্কৃতি খানিকটা একই ভারতের মতই। বুদ্ধভদ্রার মতন নেপালী সাধু, চীনের জিন রাজত্বের সময়ে ফা সিয়ান এবং তাং রাজবংশের সময়ে জুয়ান জাং এর মতন সাধুরা উভয় দেশে ভ্রমন করেছিল। ১ আগস্ট, ১৯৫৫ নেপাল ও চীনের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হয়। নেপালের সরকারি ওয়েবসাইটে লেখা আছে যে নেপাল চীনের এক চীন নীতিকে সমর্থন করে এবং নেপালের জমি কখনও চীন বিরোধী কাজের জন্য ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। আসলে চীন নেপালকে তাদের পাঁচ আঙুল নীতির অংশ ভাবে। চীনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাও জেডং তিব্বতকে চীনের ডান হাতের তালু মনে করত এবং সিকিম, নেপাল, ভুটান, অরুনাচল প্রদেশ ও লাদাখকে হাতের পাঁচ আঙুল মনে করত। যার জন্য চীন এখনও এই সব অঞ্চলকে নিজেদের মনে করে। কিন্তু তিব্বত দখলের পর বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়া পর মাও জে ডং তার এই পরিকল্পনাকে স্থগিত করতে বাধ্য হয় কিন্তু বর্তমানে চীনের রাষ্ট্রপতি মাও জে ডং এর সেই অপূর্ণ স্বপ্ন পূরন করবার লক্ষ নিয়েছে। এই জন্য জিও পলিটিক্যালি ও জিও স্ট্রাটেজিক্যালি নেপাল চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নেপালে একাধিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্ট শুরু করেছে চীন। ২০১৯ সালে নেপাল ও চীন ২০১৬ সালের ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট চুক্তি সই করে যাতে নেপাল চীনের তিয়ানজিন, লিয়ানউনগাং, জানজিয়াং, সিনেজনে চাইনিজ বন্দর ব্যবহারের অনুমতি পায়। অন্যদিকে লানজাও, লাহাসা ও সিঘাটসে দিয়ে নেপাল চীনে পন্য পরিবহন করছিল। নেপালে পন্য ও পেট্রোলিয়াম পরিববহনের জন্য রোড, ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্ট সহ নেপালের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা খাতে চীন বিনিয়োগ করছে। নেপালের এফডিআই বা বিদেশী বিনিয়োগে চীনের প্রভাব বাড়ছে। ২০১৯ সালে নেপালে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ ভারতের ছিল এবং ৪০ শতাংশ বিনিয়োগ চীনের ছিল, কিন্তু ২০২০ সালে নেপালে ৯০ শতাংশ বিনিয়োগই চীনের থেকে এসেছে। ২০১৭ সালে চীনের বিআরআই প্রজেক্টেও নেপাল যুক্ত হয়েছে, সেই থেকে নেপাল চীনের স্ট্রাটেজিক পার্টনার। বিআরআই এর আওতায় নেপালে চীনের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট হচ্ছে ট্রান্স হিমালিয়ান মাল্টি ডায়মনাশনাল কানেক্টিভিটি নেটওয়ার্ক। যাতে তিব্বতের লাসা থেকে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু পর্যন্ত রেললাইন তৈরি করছে চীন। ২০২৫ সালের মধ্যে এই প্রজেক্ট সম্পন্ন হবার কথা আছে। পরে এই রেললাইন লুম্বিনী পর্যন্ত বাড়ানো হবে। লুম্বিনী গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থানের পাশাপাশি ভারত সীমান্তের কাছে যার জন্য ভারত এই প্রজেক্টের উপর নজর রেখেছে। এছাড়া চীন নেপাল শিল্প পার্কের মাধ্যমে নেপালে ছোট, মাঝারি ও বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরি করবে চীন। মনে করা হচ্ছে এর মাধ্যমে চীন বিহার ও উত্তর প্রদেশের বাজারে নিজের প্রভাব বাড়াতে চেষ্টা করবে। 

নেপালের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে চীনের প্রভাব রয়েছে। ২০১৮ সালে নেপালের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল ইউনাইটেড মার্কিস্ট লেলিনিস্ট এবং কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল মাওয়িস্ট সেন্টার যৌথভাবে একটি জোট তৈরি করে দুই তৃতীয়াংশ ভোট নিয়ে নেপালে সরকার গঠন করে যার প্রধানমন্ত্রী হয় কেপি শর্মা ওলি এবং নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি গঠন হয়। এই দলের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নেপালে ভারত বিরোধী প্রভাব বিস্তার করা। ওলির সময়ে চীনের কমিউনিস্ট দলের সাথে নেপালের কমিউনিস্ট দলের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে যখন শি জিনপিং নেপাল সফরে যায় তখন শি জিনপিং এর বক্তব্য প্রিন্ট আউট করে নেপাল কমিউনিস্ট দলের মধ্যে বিতড়ন করা হয়েছিল। নেপালে ভারতের প্রভাবকে কমাতে নেপালের সাথে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক তৈরি করছে চীন। নেপালের স্কুল গুলিতে মান্দেরিন ভাষার প্রচলন করেছে চীন তাদের অর্থায়নে। এছাড়া চীন নেপলি শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ দেয় এবং চীন নেপাল সাংস্কৃতিক উৎসব চালু করা হয়েছে নেপালে যাতে উভয় দেশ শিক্ষা, ভ্রমন, খাদ্য সব বিষয়ে একে অপরের সংস্কৃতিকে তুলে ধরে।

বিশেষজ্ঞদের ধারনা নেপালের এই অতিরিক্ত চীন প্রীতি ভবিষ্যতে নেপালেরই ক্ষতি করবে। তবে ইদানিং কালে নেপাল ও চীনের মধ্যে একটু ঝামেলা দেখা যাচ্ছে। কোভিড মহামারীর কারনে গত দুই বছর ধরে চীনে কড়াকড়ি লকডাউনের কারনে চীন ও নেপালের সীমান্ত বন্ধ রয়েছে যার জন্য নেপাল চীনে রপ্তানি করতে পারছে না যার প্রভাব পড়েছে নেপালের অর্থনীতিতে। তাছাড়া চীনের সাথে বানিজ্য ঘাটতি ব্যাপক রয়েছে নেপালের। ২০২০-২১ সালের তথ্য অনুযায়ী চীন নেপালে ২৩৩ বিলিয়ন রুপীর জিনিস রপ্তানি করেছে এর বদলে নেপাল চীনে মাত্র ১ বিলিয়ন রুপীর জিনিস রপ্তানি করেছে। এই ব্যাপক বানিজ্য ঘাটতি নেপালের বৈদেশিক মুদ্রা ও অর্থনীতিকে সঙ্কুচিত করছে। চীনের বিরোধীতা সত্বেও নেপাল ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশান বা এমসিসির সহায়তায় আমেরিকান সাহায্য গ্রহন করে যার পর চীন নেপালের উপর তীব্র অসন্তষ্ট হয়। চীন জানিয়েছে তারা নেপালে এমসিসির বিরোধী কারন এটা আমেরিকার ইন্দো প্যাসিফিক নীতিরই একটি অংশ। চীনের ডেব্ট ট্রাপ নীতি ও অর্থনৈতিক সমস্যার কারনে নেপাল চীনের বিআরআই প্রজেক্টে সেভাবে জোর দিচ্ছে না। ভারত তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক রাখে। কিন্তু পাকিস্তান, চীন এমন দুটি দেশ যাদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখা ভারতের সম্ভব হয় নি। 

বহু প্রাচীন কাল থেকেই নেপালের সাথে ভারতের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে যা কোন কমিউনিস্ট দলের পক্ষে ভাঙা সম্ভব নয়। ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতি ও ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসির কারনে দক্ষিন এশিয়াতে ভারতের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।  তবে বিশেষজ্ঞদের ধারনা অদূর ভবিষ্যতে হয়ত ভারত ও নেপালের সম্পর্ক যদি খারাপ হয় তাহলে নেপাল ভারতের মত ভাল বন্ধু তো হারাবেই সাথে ভারতেরও বানিজ্যিক ক্ষতি হবে। নেপালের সবচেয়ে বড় বানিজ্যিক পার্টনার ভারত। নেপাল তার দুই তৃতীয়াংশ কমার্শিয়াল বানিজ্য ভারতের সাথেই করে এবং নেপালে এক তৃতীয়াংশ বৈদেশিক বিনিয়োগ ভারত থেকেই আসে। প্রচুর সংখ্যক নেপালি ভারতে কাজ করে অনেক রোজকার করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নেপালী গোর্খারা কাজ করে। নেপালে চীনা পন্য বাড়তে শুরু করলে ভারতীয় বাজার নষ্ট হবার পাশাপাশি যদি নেপাল পুরোপুরি চীনা প্রভাবে চলে এলে ভারতকে নেপাল সীমান্তেও সেনা মোতায়েন করতে হবে। 

ইতিমধ্যেই পাকিস্তান ও চীন সীমান্তে ভারত দ্বিমুখী লড়াইয়ের জন্য প্রস্তত থাকে। তাছাড়া বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশেও নজর রাখতে হয় ভারতকে, এমন অবস্থায় যদি নেপাল সীমান্তেও সেনা মোতায়েন করতে হয় ভারতকে তাহলে চাপ বাড়বে আমাদের উপর। সার্ক, ব্রিমস্টেকের মত জায়গায় সবসময় ভারত নেপাল এক সাথে কাজ করেছে তবে ভবিষ্যতে এটা হবে কীনা তা সময় বলবে। ২০১৯ সালে ভারত একটি ম্যাপ লঞ্চ করে যাতে উত্তরাখন্ডের পিথারাগড় জেলার লিপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পুয়াধুরা এলাকা ভারতের অংশ হিসাবে দেখানো হয়, এর প্রতিবাদে নেপালও তােদর ম্যাপো এইসব এলাকা নিজেদের বলে দেখায়। আসলে এসব জায়গা দীর্ঘদিন ধরে ভারতেরই অংশ কিন্তু নেপাল দাবি করে ১৮১৫ সালের সাগোলি চুক্তি অনুযায়ী এইসব জায়গা তাদের। গোর্খা যুদ্ধের পর কাঠমান্ডুর গোর্খাদের এই এলাকা দেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। যদিও ভারত এসব যুক্তি মানে নি। 

২০২০ সালে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং যখন ৮০ কিলোমিটার লম্বা দারচুলা লিপুলেখ লিংক রোড উদ্ভোদন করে যার তীব্র বিরোধিতা করেছিল নেপাল। নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির সময়ে নেপালের সাথে সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ হয়েছিল ভারতের। তবে নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দিউবার সময়ে নেপাল ও ভারতের সম্পর্ক উন্নয়ন হয়েছে একটু। ভারত সম্প্রতি র প্রধান সামন্ত গোয়েল, সেনাবাহিনীর প্রধান এম এম নারভানে এবং বিদেশ সেক্রেটারি বিনয় মোহন কায়োটরাকে নেপালে পাঠিয়েছিল বিশেষ বৈঠকে। ২০১৫ সালে নেপালে হওয়া ব্যাপক ভূমিকম্পে ভারত সবচেয়ে প্রথমে নেপালকে সাহায্য করেছিল। নেপালে রেললাইন, হসপিটাল, চেকপোস্ট সহ একাধিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্টে ভারত যুক্ত আছে। নেপালের পশ্চিম সেতি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সহ অনেক হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্টে ভারত যুক্ত আছে। সুতরাং চীন নেপালকে কেন্দ্র করে ভারতকে আরও একটি ফ্রন্টে ব্যস্ত রাখার যে চেষ্টা করে যাচ্ছে ভারত তার কাউন্টার শুরু করে দিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী জিও পলিটিক্স ও বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে ভারতের কুটনৈতিক সাফল্য প্রশংসনীয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.