আন্দামানের এই দ্বীপে ভারতবর্ষের মানুষ এখনও যোগাযোগ করে উঠতে পারেনি
নভেম্বর, ২০১৮ জন অ্যালেন চাও নামে এক ব্যাক্তি অবৈধ ভাবে আন্দামানের সেন্টিন্যাল দ্বীপে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। তিনি স্থানীয় মাঝিদের বলেন এখানে পৌঁছে দেবার জন্য কিন্তু নিষিদ্ধ দ্বীপ হবার কারনে মাঝিরা ওনাকে এখানে যেতে নিষেধ করেন এবং বলেন এখানে যারা যায় তারা কেউ ফিরে আসে না। কিন্তু জন অ্যালেন চাও পঁচিশ হাজার টাকার বিনিময়ে একজনকে এই দ্বীপে তাকে পৌঁছে দেবার জন্য রাজী করান। ১৪ নভেম্বর রাতে ২৬ বছর বয়সী জন এখানে পৌঁছায়। রাতে গেছিল সে কারন যাতে উপকূল রক্ষী বাহিনীর নজর এড়িয়ে যাওয়া,যায়। সেখানে গিয়ে সে দেখে ওখানে যেসব মানুষ আছে তারা কেউই কাপড় পড়ে নেই এবং তিনি যখনই দ্বীপের আরও ভেতরে যাবার চেষ্টা করতে থাকেন তত তার দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর উড়ে আসতে থাকে। কিন্তু জন ছিল জেদী লোক তার লক্ষ্য ছিল এই দ্বীপে খ্রীষ্টান ধর্মের প্রচার যার কারনে সুদূর আমেরিকা থেকে এখানে আসা তার।
জন অ্যালেন চাও একটি ডায়েরী লিখত। সেখানে সে লিখেছিল যে তার যদি মৃত্যুও হয় তবে এখানকার মানুষরা দায়ী নয়, সে যিশুখ্রিষ্টের বানি তাদের মধ্যে পৌঁছে দেবেই এই ছিল তার উদ্দেশ্য। আসলে সে ছিল একজন খ্রিষ্টান মিশনারী। সেই ডায়েরীতে আরও লেখা আছে জন অনেক চেষ্টা করে সেইসব লোকেদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকে শেষমেষ পাঁচজন লোক তার দিকে এগিয়ে আসে এবং জন তাদের দিকে বাইবেল এগিয়ে দেয় কিন্তু ওইসব লোকেরা তার দিকে তীর ছোড়ে। বারবার ডায়োরীর কথা বলা হচ্ছে কারন জন অ্যালান চাও আর ফিরে আসতে পারেন নি। ওখানেই মৃত্যু হয় ওনার এবং ওনার মৃতদেহও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওনার ডায়েরী পরে উদ্ধার করা হয় যাতে ১৩ টি পাতা লেখা ছিল সেখান থেকেই এসব জানা গেছে। পরে আমেরিকাতে জনের মায়ের সাথে যোগাযোগ করে ওনাকে সব জানানো হয়। তবে এটাই প্রথম ঘটনা নয় এর আগেও এমন ঘটেছে এখানে। আসলে আন্দামানের এই উত্তর সেন্টিন্যালিজ বা সেন্টিন্যাল দ্বীপ এমনই আদিম যুগের মানুষে ভর্তি। ভারত সরকার অনেকবার এখানকার লোকেদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল কিন্তু প্রতিবারই তীর দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে। ২০০৬ সালে কীছু মাছুড়ে এখানে আসে, পরে তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। আন্দামানের ভয়ানক দ্বীপ সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে সর্বমোট ৫৭২ টি দ্বীপ রয়েছে এবং মাত্র ৪০ টি দ্বীপেই মানুষ বসবাস করে এবং মাত্র ১২ টি দ্বীপে পর্যটক যেতে পারে কারন এখানে অনেক উপজাতি বাস করে সেজন্য এখানে যাওয়া নিষেধ। ১৯৫৬ সালের উপজাতি আইন অনুযায়ী ভারত সরকার এই দ্বীপ গুলো সংরক্ষন করে। ২০১৮ সালে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের উত্তর সেন্টিনাল দ্বীপ সহ ২৯ টি দ্বীপে ভ্রমন নিষিদ্ধ করেছে। ভারতীয় নেভি এখানে পেট্রোল করে। এই দ্বীপটির ৫ নটিক্যাল মাইল বা প্রায় দশ কিলোমিটার সীমানা অবধি প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মূলত দক্ষিন আন্দামান প্রশাসনের অন্তর্গত এই দ্বীপ পোর্টব্লেয়ার থেকে প্রায় ৫৬ কিলোমিটার দূরে। গোটা দ্বীপটি জঙ্গলে ভর্তি এবং এর আশেপাশে প্রবাল প্রাচীর রয়েছে। দ্বীপটির আয়তন মাত্র ৬০ স্কোয়ার কিলোমিটার। এই দ্বীপে বসবাসকারীদের সেন্টিন্যালজ বলা হয়। ভারত সরকার ২০০০ সাল থেকে অনেকবার এদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এর আগে ব্রিটিশরাও চেষ্টা করেছিল, চোল সাম্রাজ্যও এখানে যোগযাগের চেষ্টা করেছিল কিন্তু ফলাফল কিছুই হয়নি। সেন্টিন্যালদের সম্পর্কে এখনও তেমন কোন তথ্যই পাওয়া যায়নি, এমনকী এদের ভাষাও জানা সম্ভব হয়নি।
মনে করা হয় এখানে ৫০-৫০০ লোক বসবাস করে। তবে এদের ইতিহাস, সংস্কৃতি কিছুই জানা যায়নি। এদের উচ্চতা পাঁচ ফুট, গায়ের রং কালো আফ্রিকানদের মতো, পোষাক পড়ে না এবং বিষাক্ত তীর যুক্ত ধনুক ব্যাবহার করা হয়। যতদূর জানা যায় এরা আফ্রিকান উপজাতি সম্প্রদায় যারা ইয়ামেন থেকে এখানে এসেছে। আজ থেকে প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে আফ্রিকা থেকে কিছু লোক বেড়িয়ে ইয়ামেন হয়ে মায়ানমার, ভারত হয়ে দক্ষিন পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস শুরু করে। একে আউট অফ আফ্রিকা থিওরি বলা হয়। উত্তর সেন্টিনাল দ্বীপে এইসব মানুষগুলো প্রায় ১০-৩০ হাজার বছর আগে বসতি স্থাপন করে। সম্ভবত এরা প্রস্তুর যুগের শেষ কোন উপজাতি কারন এরা আজও শিকার করে খায় এবং কৃষিকাজ জানে না। প্রায় ১২০০০ বছর আগে কৃষিকাজ শুরু হয় এরা সেটাও জানে না। আন্দামান দ্বীপ সম্পর্কে সবচেয়ে প্রথম লিখিত তথ্য পাওয়া যায় দ্বিতীয় শতকে রোমান গনিতবিদ ক্লডিয়াস পটোলেমির থেকে। তিনি আন্দামানকে আইল্যান্ডস অফ ক্যানিবেলস নামে। ৬৭৩ সালে সুমাত্রা থেকে ভারতে সফর করা এক চাইনিজ পর্যটকও বলেন এখানে বাস করা লোকেরা ক্যানিবেলস অর্থাৎ মানুষের মাংস খায়। এরপর আরব পর্যটকরাও একই কথা বলেছে। এগারো শতকে দক্ষিন ভারতের এক মন্দির থেকে জানা যায় চোল রাজা রাজা রাজা ১ এই দ্বীপকে অশুদ্ধ মনে করত এবং এখানে মানুষ খেকো লোকদের বসবাস আছে। মর্কোপোলোও বলেছিলেন এখানের অধিবাসীরা মানুষের মাংস খায় কিন্তু এইসব অধিবাসীদের নরমাংস ভক্ষনের কোন প্রমান এখনও পাওয়া যায় নি, বরং এরা যাদের হত্যা করে তাদের শরীর মাটিতে পুঁতে দেয় না হলে ফেলে রেখে দেয়।
ভারতীয় সরকার অনেকবার এদের অনেক কিছু দিয়েছে কিন্তু এরা কিছুই গ্রহন করেনি কিন্তু যখনই ভারত সরকার এদের নারকেল দিয়েছে এরা খুশি মনেই গ্রহন করেছে। আগেই বলা হয়েছে চোলরা, ব্রিটিশরাও এদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল। ১৭৬৪ সালে বক্সার বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা ভারতে তাদের ক্ষমতা বাড়াতে থাকে। ব্রিটিশদের দরকার ছিল সমুদ্রপথে এমন কোন জায়গা যেখানে সহজে জাহাজ যাতায়াত করতে পারবে। ১৭৭১ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি সার্ভে জাহাজ সার্ভেয়ার জন রিচির নেতৃত্বে হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভের জন্য দ্য ডিলিজেন্ট জাহাজ এখানে এসেছিল। ১৮৬৭ সালে একটি ভারতীয় বানিজ্য জাহাজ নাইনভে এই দ্বীপের কাছে খারাপ হয়ে যায়, জাহাজে থাকা ১০৬ জন যাত্রী এই দ্বীপে নামে কিন্তু সেখানকার অধিবাসীরা তাদের উপর আক্রমন শুরু করে দেয়, কোনও রকমে ব্রিটিশ নেভি তাদের উদ্ধার করেছিল। ১৮৮০ সালের জানুয়ারীতে মৌরাইস ভিদাল পোর্টম্যান নামে এক সরকারী কর্মচারী এখানে আসে এবং তারা কিছু পরিত্যক্ত ছোট গ্রাম খুঁজে পায়। তার জোর করে ছয়জন সেন্টিনালিজকে, যার মধ্যে একজন নারী, একজন পুরুষ ও চারজন বাচ্ছা ছিল, পোর্টব্লেয়ারে নিয়ে আসে কিন্তু কীছুক্ষনের মধ্যে সেই পুরুষ ও মহিলাটি মারা যায়। আসলে প্রায় কয়েকহাজার সাল ধরে এখানকার লোকেরা এভাবেই বসবাস করছে সেজন্য আধুনিক দুনিয়ায় তাদের শরীর মানিয়ে নিতে পারেনি। সেই চারজন বাচ্চাকে আবার ওই দ্বীপে পৌঁছে দিয়ে আসা হয়। এরপর পোর্টম্যান আরও কয়েকবার ওই দ্বীপে গবেষনার জন্য গিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৬৬ সালে ত্রিলোকনাথ পন্ডিত সাথে কীছু সেনা সদস্য নিয়ে নারকেল, বাসন ইত্যাদি নিয়ে এই দ্বীপে যান কিন্তু আবারও সেন্টিনালিজরা আক্রমন করে, তবে তিনি দ্বীপের ভেতর কিছুদূর অবধি গিয়েছিলেন সেখানে তিনি দেখেন কীছু ছোট ছোট ঘর রয়েছে। দুধরনের ঘর ছিল সেখানে, বড় ধরনের ঘর যেখানে অনেক পরিবার একসাথে থাকত এবং ছোট ঘর যেখানে একটিই পরিবার থাকত। তবে তিনি আর বেশী দূর যাননি কারন আরও বেশী আক্রমন হতে পারে। এরপর তিনি আরও একবার গিয়েছিলেন সেখানে কিন্তু আবারও আক্রমন হয়। মোটকথা সেন্টিনালিজদের সাথে যতই ভাল ব্যবহার করার চেষ্টা করা হোক না কেন তারা বাইরের লোক দেখলেই আক্রমন করে মেরে ফেলবে। ১৯৮১ সালে এমভি প্রাইমোরোস নামে একটি জাহাজ এখানে খারাপ হয়ে যায়, যথারীতি সেন্টিনালিজরা আক্রমন করতে আসে তখন জাহাজে থাকা লোকেদের ওএনজিসির হেলিকপ্টারে করে উদ্ধার করে তবে জাহাজটি আজও এখানে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। ১৯৯১ সালে সেন্টিনালিজদের সাথে মোটামুটি একটি যোগাযোগ হয়। মধুবালা নামে একজন মহিলা ন্যাশানাল জিওগ্রাফির তরফে এখানে ডকুমেন্টারি তৈরি করতে উপস্থিত হয়। কিন্তু সেন্টিনালিজদের তীর এসে লাগে ডাইরেক্টারের গায়ে। তবে মধুবালাকে কেই তীর ছোড়ে নি, বরং একজন পুরুষ সেন্টিনালি তার দিকে তীর ছুড়তে গেলে একজন মহিলা এসে বারন করে। যা দেখে এটা মনে হয়েছে এখানকার অধিবাসীরা মহিলাদের সম্মান করে। এরপর অ্যানথ্রপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর ত্রিলোকনাথ পন্ডিত আবারও যান এখানে কিন্তু সেই একই ধাঁচে আক্রমন হতে থাকে। ফলে বাধ্য হয়ে ভারত সরকার এখানে ১৯৯৬ সালের পর থেকে প্রবেশ নিষেধ করে দিয়েছে।
এখানে ২০১৮ সালে জন অ্যালেন চাও এর মৃত্যু ছিল শেষ কোন বড় দুর্ঘটনা। এরপর থেকে এখানে কোন তেমন ঘটনা ঘটেনি। আসলে সেন্টিনালিরা এখনও সেই আদিম যুগে বসবাস করছে এবং তারা তাতেই খুশি আছে। আধুনিক জগতের সাথে তারা মানিয়ে নিতে পারবে না। কারন আধুনিক দুনিয়ায় এমন অনেক রোগ আছে বা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া আছে যার বিরুদ্ধে বিবর্তনের ফলে আমাদের শরীরে সেইসব রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে কিন্তু দীর্ঘকাল আধুনিক জগত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় এইসব মানুষদের শরীরে সেই প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। সেইজন্য তাদের নিজেদের মত ছেড়ে দেওয়াই ভালো। ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষে যখন সুনামী হয় তখন ভারত সরকার এদের সাহায্য করে। ভারতীয় উপকূল রক্ষী বাহিনী এখানে খাবারের প্যাকেট দিয়ে আসে।