তেলে নয় গাড়ি চলবে এবার জলেই
রাজেশ রায়: সম্প্রতি আপনারা খবরে পড়ে থাকবেন আমাদের রোড ট্রান্সপোর্ট ও হাইওয়ে মিনিস্টার নীতিন গড়করি একটি গ্রীন হাইড্রোজেন পাওয়ার গাড়িতে করে সংসদে আসেন। যখন এই ব্যাপারে ওনাকে জিজ্ঞেস করা হয় উনি বলেন এই গাড়িটির নাম মিরাই যার অর্থ ভবিষ্যত, ওনি বলেন ভবিষ্যতে হাইড্রোজেন ফুয়েল গাড়ির ব্যাবহার বাড়ানোই লক্ষ। একটি তথ্য অনুযায়ী আগামী দুই দশকে বিশ্বে আরও দুই বিলিয়ন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে অর্থাৎ ২০৪০ আসতে আসতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৯ বিলিয়ন বা ৯০০ কোটিরও বেশী হবে। এই বিপুল জনসংখ্যার কারনে শক্তির সংকট তৈরি হবে কারন আমরা এখনও শক্তির জন্য সেই পুরোনো পদ্ধতি ব্যবহার করি অর্থাৎ কয়লা ও ফসিল ফুয়েল। যার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন ব্যাপক আকারে দেখা যাচ্ছে যার মোকাবিলা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ১৯৯২ এর রিও সামিটই হোক বা ২০১৫ এর প্যারিস জলবায়ু চুক্তি, সব জায়গায় এটাই জোর দেওয়া হয়েছে কার্বনের ব্যবহার কীভাবে কমানো যাবে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য অনুযায়ী এই জলবায়ু পরিবর্তন রোধের জন্য পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশী বাড়তে দেওয়া যাবে না এবং এর জন্য প্রচলিত শক্তি কয়লা, ফসিল ফুয়েলের বিকল্প উৎস খুজতে হবে যাতে কার্বন নির্গমন কম হয়। এমনই এক বিকল্প শক্তি উৎস গ্রীন হাইড্রোজেন। গ্রীন হাইড্রোজেন কী? কেনই বা ভারত সরকার গ্রীন হাইড্রোজেন ব্যবহারের উপর এত জোর দিচ্ছে? কীভাবে গ্রীন হাইড্রোজেন বিকল্প শক্তির উতস হয়ে উঠবে এবং কীভাবেই বা ভবিষ্যতে ভারতে শক্তির সরবরাহ করবে এটি? আজ এবিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করব।

গ্রীন হাইড্রোজেন কী সেটা জানবার আগে জানতে হবে ইলেকট্রোলাইসিস কী? এই পদ্ধতিতে কোন নির্দিষ্ট তরলে ইলেকট্রিক প্রয়োগ করা হয় যাতে তরলে একটি পতিক্রিয়া তৈরি হয় যাতে ওই তরলে থাকা পরমানু আয়োনিত হয়ে যায়। যখন জলকে ইলোকট্রলাইসিস করা হয় তখন জল আয়োনিত হয়ে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন তৈরি হয়। গ্রীন হাইড্রোজেন এভাবেই তৈরি হয় কিন্তু এখানে একটা নিয়ম আছে, যে ইলেকট্রিসিটি এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় তা অপ্রচলিত শক্তি উৎস যেমন সৌরবিদ্যুত বা জল বিদ্যুৎ থেকে তৈরি করা হয়। এবার একটা প্রশ্ন মনে হতে পারে জল থেকে থেকে হাইড্রোজেন আলাদা করবার দরকারই বা কী!! এর উত্তর হাইড্রোজেন ফুয়েল। নীতিন গড়করি ছাড়াও বিশ্বের বহু বিশেষজ্ঞরা গ্রীন হাইড্রোজেন নিয়ে বিশেষ আগ্রহী। গ্রীন হাইড্রোজেন থেকে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয় যার জন্য একে ভবিষ্যতের ফুয়েল আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এমনকী এটাও বলা হয়েছে অপ্রচলিত শক্তি গুলোর মধ্যে গ্রীন হাইড্রোজেন সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। এর সবচেয়ে বড় দিক হল গ্রীন হাইড্রোজেন জিরো কার্বন এমিশন করে অর্থাৎ গ্রীন হাইড্রোজেন থেকে ১ শতাংশও কার্বন উৎপন্ন হয় না, এরজন্য এটি পরিবেশের জন্য বিশেষ উপযোগী। তবে এবার আরেকটা কথা মাথায় আসবে তাহলে বর্তমানে যে গোটা বিশ্ব জুড়ে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ব্যবহার চলছে, এটাও তো কার্বন নির্গমন করে না তাহলে গ্রীন হাইড্রোজেনের কেন প্রয়োজন। দেখুন নিঃসন্দেহে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ভাল কিন্তু ব্যাটারি একটা সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি যুক্ত গাড়ি সর্বোচ্চ ৬০০-৮০০ কিলোমিটার যেতে পারে হয়ত, এরপর আবার চার্জ করতে হবে। কিন্তু আজও বেশী দূর যাত্রার ক্ষেত্রে যেমন, মুম্বাই থেকে চেন্নাই বা দিল্লি থেকে জাপান পর্যন্ত যাত্রার ক্ষেত্রে বিমান বা জাহাজই ভরসা। বিমানে যে জেট ফুয়েল ব্যবহার করা হয় তা ক্রুড অয়েল যা পরিবেশ দূষন ঘটায়। এখানেই দরকার গ্রীন হাইড্রোজেন যা প্রচুর শক্তি উৎপন্ন করে। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ওজন কয়েক টন অবধি হয়। টেসলা গাড়িতে ব্যবহৃত সবচেয়ে হালকা লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ওজনও হাফ টন্ সেখানে মাত্র কয়েক কিলোগ্রাম গ্রীন হাইড্রোজেন দিয়ে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন করা সম্ভব হবে। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ভারতে তৈরি খুব ঝামেলা জনক কারন এই ব্যাটারি তৈরির প্রধান চারটি উপাদান হচ্ছে লিথিয়াম, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ ও গ্রাফাইট যার মধ্যে লিথিয়াম প্রধান উপাদান। কিন্তু ভারতে লিথিয়াম তেমন পাওয়া যায় না। বিশ্বের সবচেয়ে বেশী লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি প্রস্তত কারক চীন এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশী লিথিয়ামের ভান্ডার আছে চিলিতে। তাই ভারতকে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির জন্য চীন ও চিলির উপর নির্ভর থাকতে হয়। সেখানে গ্রীন হাইড্রোজেন তৈরি অনেক সুবিধা জনক কারন এর প্রধান উপাদান জল। এছাড়াও লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির জীবনকাল সীমিত, একটি লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির গড় জীবনকাল ৬-৭ বছর যেখানে গ্রীন হাইড্রোজেন বহুদিন চলে। তাপমাত্রার পরিবর্তন এই ধরনের ব্যাটারির কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন গ্রীন হাইড্রোজেন ভারতের জন্য কতটা দরকারী।
এবার জানা যাক গ্রীন হাইড্রোজেন ভারতের জন্য কতটা দরকারী। এতক্ষন বলা হল গ্রীন হাইড্রোজেন কতটা স্বচ্ছ ও বিশাল শক্তির উৎস। এজন্য ভারত সরকার ভারতকে হাইড্রোজেন পাওয়ার দেশ হিসাবে তৈরি করার জন্য অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট গ্রীন হাইড্রোজেন পোগ্রাম শুরু করা হয়। বিশ্বের ১৮ তম দেশ হিসাবে ২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে গ্রীন হাইড্রোজেন পলিসি লঞ্চ করে ভারত, যার লক্ষ ভারতকে গ্রীন হাইড্রোজেন পাওয়ার হাউস তৈরি করা। ২০৩০ এর মধ্যে ভারত লক্ষ নিয়েছে ৫০ লাখ টন গ্রীন হাইড্রোজেন তৈরি করার। ইতিমধ্যেই গ্রীন হাইড্রোজেন ফিল্ডে গবেষনার জন্য ৮০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ভারত। বিশ্বের শক্তির অন্যতম বড় উৎস হচ্ছে ক্রুড অয়েল এবং দিনকে দিন ক্রুড অয়েলের দাম বেড়েই যাচ্ছে। সে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধই হোক কিংবা মধ্য প্রাচ্যে রাজনৈতিক সংকট, সবার প্রথমে প্রভাব পড়ে তেলের উপরেই। ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ক্রুড অয়েল আমদানি কারক দেশ। ভারত তার দরকারি ৮৪ শতাংশ তেলই বাইরে থেকে কেনে।
২০২১ এর ডাটা অনুযায়ী ভারত প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের তেল কিনেছে যা ২০২০ সালের তুলনায় দ্বিগুন। ২০২০-২১ এ ভারত সহ গোটা বিশ্ব করোনা মহামারীর সাথে লড়াই করছিল তা সত্বেও এত বেশী তেলের চাহিদা সত্যিই ভাববার বিষয়। প্রতি বছর তেল কেনবার জন্য আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যায় হয় যা আমাদের অর্থনীতির উপর চাপ বাড়ায়। ইতিমধ্যেই ভারতের লোন রয়েছে ২৩ বিলিয়ন ডলার যা মোট জিডিপির ২.৭ শতাংশ। তবে এভাবে তেল কিনতে থাকলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে যা আমাদের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করবে। ঠিক এই কারনেই ১৯৯১ সালে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল।
২০১৫ এ প্যারিস জলবায়ু চুক্তি সই করে ভারত যাতে বলা হয় ভারত ২০৩০ এর মধ্যে ৫০০ গিগা ওয়াট শক্তি অপ্রচলিত শক্তি থেকে উৎপন্ন করবে এবং ১ বিলিয়ন টন কার্বন নির্গমন কম করবে। ২০২১ এর গ্লাসগো সামটি ভারত জানায় ২০৭০ এর মধ্যে জিরো কার্বন এমিশন দেশ হওয়ার। এসবের জন্য গ্রীন হাইড্রোজেন খুব বেশী দরকারী। বিশ্ব এনার্জি সংস্থার দাবি অনুযায়ী এক কিলো গ্যাসোলিনের তুলনায় এক কিলো গ্রীন হাইড্রোজেন তিন গুন বেশী শক্তি উৎপন্ন করে এবং ১ এক কিলো প্রাকৃতিক গ্যাসের তুলনায় এক কিলো হাইড্রোজেন ২.৫ গুন বেশী শক্তি উৎপন্ন করে। তথ্য অনুযায়ী ২০৫০ এ ভারতের জনসংখ্যা হবে প্রায় ১.৬৪ বিলিয়ন এবং এনার্জির চাহিদা বাড়বে ১৪৫০০ টেরাওয়াট। সুতরাং এই বিশাল এনার্জির জন্য গ্রীন হাইড্রোজেন গ্যাসের বিকল্প নেই। তবে এই হাইড্রোজেন ব্যবহারের কীছু অসুবিধা আছে। প্রথমত গ্রীন হাইড্রোজেন অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ। যদি একটু অসাবধান হন গ্রীন হাইড্রোজেন সবকীছু ধ্বংস করে দেবে। যার সবচেয়ে বড় উদাহারন জাপান। ২০১১ সালে জাপানে বিশাল ভূমিকম্প হয় যাতে জাপানের ফুকোশিমা পারমানবিক কেন্দ্রে হাইড্রোজেন স্টোরেজে লিকেজ হয়ে যায় সাথে সাথে পাওয়ার প্ল্যান্টে ভয়ানক বিস্ফোরন হয় এবং চারপাশে রেডিয়েশন ছড়িয়ে পড়ে যার ফলে জাপান সরকারকে রাতারাতি কয়েক লাখ লোককে অন্যত্র সরাতে হয়। বিশেষজ্ঞরা একে ১৯৮৯ সালে হওয়া চেরনোবিল দুর্ঘটনার সাথে তুলনা করে। অর্থাৎ একটু অসচেতন হলেই গ্রীন হাইড্রোজেন আশীর্বাদ থেকে অভিশাপে পরিনত হবে। দ্বিতীয় কারন হচ্ছে হাইড্রোজেনের স্বল্পতা এবং খরচ। পৃথিবীতে হাইড্রোজেন অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আমাদের বায়ুমন্ডলে হাইড্রোজেনের পরিমান অত্যন্ত কম প্রায় ০.০৫ শতাংশ। সুতরাং বাতাস থেকে হাইড্রোজেম নেওয়া সম্ভব নয়। বাকী রইল জল, এক কিলো গ্রীন হাইড্রোজেন তৈরি করতে ৫০ কিলো ওয়াট শক্তি লাগে যার জন্য গ্রীন হাইড্রোজেন অত্যন্ত দামি। যতক্ষননা মনুষ্য জাতি সূর্যের মত অন্তত শক্তির উতস খুজে পাচ্ছে ততক্ষন অবধি গ্রীন হাইড্রোজেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে। পরিবেশবিদ বব ব্রাউনের মতে পৃথিবীর ভবিষ্যত হয় গ্রীন না হয় ধ্বংস। তার মতে বিশ্বের সকল দেশকে অপ্রচলিত শক্তির উতসের উপর জোর দিতে হবে।