ভারত

ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তার করতে পারবেনা চীনা নৌসেনা

১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯, সিআরপিএফের ২,৫০০ সৈনিককে জম্মু থেকে শ্রীনগর নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। জম্মু ও শ্রীনগরকে যুক্ত করা ৪৪ নং জাতীয় সড়ক প্রতিদিনের মতোই ব্যস্ত ছিল। সিআরপিএফের একটি বাস যখনই পুলওয়ামার লেথপোরার কাছে পৌঁছায় তখনই ৩০০ কেজি বিস্ফোরক যুক্ত একটি এসইউভি বাসে এসে আঘাত করে এবং বিস্ফোরনে ৪০ জন সিআরপিএফ জাওয়ান বীরগতি প্রাপ্ত হন। এই আক্রমনের দায়ভার স্বীকার করে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন জইশ ই মহম্মদ। এই ঘটনার বারো দিন পর ভারতীয় বায়ুসেনার যুদ্ধবিমান এলওসি অতিক্রম করে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের বালাকোটে জইশ-ই মহম্মদের ঘাঁটিতে এয়ারস্ট্রাইক করে। এইসময় ভারতীয় নৌবাহিনীও তাদের যুদ্ধজাহাজ আরব সাগরে পাকিস্তান উপকূলের কাছে পাঠিয়ে দেয়। ভারতীয় নৌবাহিনীকে দেখেই পাকিস্তান নৌবাহিনীর জিন্নাহ নেভাল বেসে থাকা সাবমেরিন পিএনএস সাদকে মিশনে পাঠিয়ে দেয় পাকিস্তান। ফ্রান্সের অগাস্টা শ্রেনীর সাবমেরিন এই পিএনএস সাদ এআইপি সিস্টেম যুক্ত যার কারনে এই সাবমেরিন জলের তলায় অনেকদিন থাকতে পারে। জিন্নাহ বেস থেকে এই সাবমেরিন তিন দিনের মধ্যে গুজরাট উপকূলকে এবং পাঁচ দিনের মধ্যে মুম্বাইয়ে নৌবাহিনীর মুখ্য কার্যালয়কে নিশানা করতে সক্ষম। পিএনএস সাদকে খোঁজার জন্য ভারতীয় নৌবাহিনী সাবমেরিন হান্টার পি ৮ আই নেপচুনকে মোতায়েন করে এবং মুম্বাই ও গুজরাট উপকূলে যুদ্ধজাহাজ পাঠানো হয়। পিএনএস সাদের সম্ভাব্য আক্রমনকে প্রতিরোধের জন্য নিউক্লিয়ার সাবমেরিন আইএনএস চক্রকেও পাকিস্তান উপকূলে পাঠানো হয়। ২১ দিন ধরে খোঁজার পর ভারতীয় নৌবাহিনী পিএনএস সাদকে গোয়াদর বন্দরের কাছে খুঁজে পায়, এটা প্রমান করে ভারতীয় নৌবাহিনীর দক্ষতা কতটা। যদি ভারতীয় নৌবাহিনীর কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকতো তাহলে পাকিস্তান সাবমেরিনের মাধ্যমে ভারতে আক্রমন করতে পারতো কিন্ত ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এতটাই শক্তিশালী করা হয়েছে যে শত্রুর আক্রমন ভারত প্রতিরোধ করতে সক্ষম। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে সাবমেরিনের কার্যকারিতা অসাধারন, ঘাতক অস্ত্র হিসাবে নিঃশব্দে শত্রুর উপর আক্রমন করতে সাবমেরিন সবচেয়ে বেশী উপযোগী। 

এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, ডেস্ট্রয়ার, করভেট, ফ্রিগেট সহ বাকী সমস্ত যুদ্ধজাহাজের তুলনায় সাবমেরিন নেভাল ওয়ারফেয়ারে সবচেয়ে বেশী কার্যকরী। শত্রুর জলসীমায় ঢুকে নজরদারি করতে, শত্রুর জাহাজকে আক্রমন করতে, পন্যবাহী জাহাজকে রক্ষা করতে কিংবা পরমানু আক্রমনের বিরুদ্ধে পরমানু মিসাইল ফায়ার করার ক্ষেত্রে সাবমেরিনের কোনও বিকল্প নেই। এই কারনে বর্তমানে প্রতিটি শক্তিশালী দেশই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের থেকেও বেশী সাবমেরিন তৈরিতে বেশী জোর দিয়েছে। এই কারনে ভারতের সবচেয়ে বড় দুই শত্রু দেশ পাকিস্তান ও চীন সাবমেরিন তৈরিতে জোর দিয়েছে। পাকিস্তান নৌবাহিনীতে আটটি সাবমেরিন আছে, চীনের থেকে আরও আটটি হাঙ্গর শ্রেনীর সাবমেরিন কিনছে পাকিস্তান। এই সব কয়টি সাবমেরিনই এআইপি বা এয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রোপালশন সিস্টেম যুক্ত। চীন নিজেও ৭৯ টি সাবমেরিন যুক্ত করেছে তাদের নৌবাহিনীতে যার মধ্যে ছয়টি পরমানু অস্ত্র বহনে সক্ষম। সেই তুলনায় ভারতের নৌবাহিনীর কাছে মাত্র আঠারোটি সাবমেরিন আছে এবং ভারতের কাছে নিউক্লিয়ার এসএসএন সাবমেরিন নেই। এই হিসাবে দেখতে গেলে ভারতীয় নৌবাহিনী সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারে চীনের থেকে পিছিয়ে আছে। তবে তাসত্ত্বেও ভারত মহাসাগরে চীনকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম ভারতীয় নৌবাহিনী। 

ভারতীয় নৌবাহিনীতে বর্তমানে ১৫০ এর বেশী যুদ্ধজাহাজ রয়েছে যার মধ্যে ১৮ টি সাবমেরিন। এই আঠারোটি সাবমেরিনের মধ্যে ১৬ টি সাবমেরিন ডিজেল ইলেকট্রিক অ্যাটাক সাবমেরিন। মূলত তিনটি শ্রেনীর ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিন রয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীর কাছে প্রজেক্ট ৮৭৭ এর আওতায় রাশিয়া থেকে কেনা সাতটি কিলো শ্রেনীর সাবমেরিন যাকে সিন্ধুঘোষ শ্রেনীর সাবমেরিনও বলা হয়, জার্মানির থেকে চারটি শিশুমার শ্রেনীর সাবমেরিন এবং প্রজেক্ট পি ৭৫ এর আওতায় ফ্রান্স থেকে কেনা ছয়টি স্কলপিয়ন বা কালভেরী শ্রেনীর সাবমেরিন এবং দুটি ভারতের নিজস্ব তৈরি আরিহান্ট শ্রেনীর এসএসবিএন সাবমেরিন আইএনএস আরিহান্ট এবং আইএনএস আরিঘাট। ভারতের কাছে পরমানু শক্তি চালিত কোন নিউক্লিয়ার অ্যাটাক সাবমেরিন নেই। আরিহান্ট এবং আরিঘাট নিউক্লিয়ার অ্যাটাক সাবমেরিন নয়, এই ধরনের সাবমেরিন স্ট্রাটেজিক ভাবে ব্যাবহার করা হয় শত্রুর বিরুদ্ধে। যদি ভারতের উপর কোন দেশ পরমানু হামলা করে তখন প্রত্যুত্তরে ভারতও এই এসএসবিএন সাবমেরিন দিয়ে পরমানু মিসাইল ফায়ার করতে পারবে। এই আরিহান্ট এবং আরিঘাট মূলত ভারতের সেকেন্ড স্ট্রাইক সক্ষমতা প্রদান করে। এই সাবমেরিন দিয়ে শত্রুর জাহাজ, সাবমেরিন, বন্দর, গুরুত্বপূর্ন জায়গায় আক্রমন করা সম্ভব নয়। 

পরমানু শক্তি চালিত অ্যাটাক সাবমেরিন ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিনের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিনকে অক্সিজেন নেওয়ার জন্য এবং ডিজেল জেনারেটরের মাধ্যমে ব্যাটারি চার্জ করবার জন্য বারবার জলের উপরে আসতে হয় যার কারনে ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিন শত্রুর রেডারে ধরা পড়বার সম্ভবনা বেশী থাকে। কিন্তু পরমানু শক্তি চালিত সাবমেরিনকে জলের উপরে ওঠবার দরকার হয়না। শুধুমাত্র সাবমেরিনে থাকা ক্রুদের লজিস্টিকের জন্য পরমানু সাবমেরিনকে বন্দরে যেতে হয়। পরমানু সাবমেরিন বহুকাল জলের তলায় থাকতে পারে কিন্ত ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিন এআইপি প্রযুক্তি যুক্ত হলেও খুব বেশীদিন জলের তলায় থাকতে পারেনা। পরমানু সাবমেরিনের অস্ত্র বহন করবার ক্ষমতাও বেশী হয় ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিনের থেকে। তবে পরমানু সাবমেরিন অনেক বেশী দামী হয় ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিনের তুলনায়। একটি আধুনিক পরমানু সাবমেরিনের দাম প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন ডলার হয় কিন্তু একটি ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিনের দাম ৫০০ মিলিয়ন ডলার থেকে শুরু হয়। ভারতের কাছে থাকা কোন ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিনেই এআইপি প্রযুক্তি নেই। 

১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের সময়ই ভারত পরিকল্পনা করে ২০৩০ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীতে ২৪ টি সাবমেরিন যুক্ত করার। এর জন্য দুটি প্রজেক্ট নেওয়া হয় প্রজেক্ট ৭৫ এবং প্রজেক্ট ৭৫ আই। প্রজেক্ট ৭৫ এর আওতায় ফ্রান্স থেকে ছয়টি স্করপিয়ন শ্রেনীর সাবমেরিন কেনা হয়েছে কিন্তু এগুলোতে এআইপি প্রযুক্তি নেই। ভারতের পরবর্তী প্রজেক্ট পি ৭৫ আইতে আরও ছয়টি ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিন কেনা হবে যাতে এআইপি প্রযুক্তি থাকবে। কিন্ত ভারতের এই দুটো প্রজেক্টে যথেষ্ট দেরী হয়েছে। ২০১০ সালে প্রথম পি ৭৫ সাবমেরিন যুক্ত হওয়ার কথা ছিল কিন্ত ২০১৭ সালে প্রথম স্করপিয়ন শ্রেনীর সাবমেরিন যুক্ত হয় ভারতীয় নৌবাহিনীতে। প্রজেক্ট পি ৭৫ আই এখনও শুরুই হয়নি। নেভাল ওয়ারফেয়ারের জন্য শক্তিশালী পরমানু শক্তি চালিত অ্যাটাক সাবমেরিন বা এসএসএন সাবমেরিন দরকার। 

ভারতীয় নৌবাহিনীর কাছে যে সাবমেরিন বহর আছে তা দিয়ে ভারতের উপকূল ভাগ রক্ষা করা সম্ভব ও পাকিস্তানকে হারানো সম্ভব কিন্তু চীনের মতোন শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে ভারত মহাসাগরে আধিপত্যের জন্য আরও শক্তিশালী পরমানু শক্তি চালিত অ্যাটাক সাবমেরিন দরকার ভারতের। চীনের কাছে ৭৯ টি সাবমেরিন রয়েছে যার মধ্যে ছয়টি এসএসবিএন, নয়টি এসএসএন এবং বাকী সব ডিজেল ইলেকট্রিক। চীনের এসএসবিএন সাবমেরিন জেএল ২ পরমানু মিসাইল বহন করে যার রেঞ্জ ৭,২০০ কিলোমিটার। ভারতের আরিহান্ট এবং আরিঘাট সাবমেরিন কে ১৫ সাগরিকা মিসাইল বহন করে যার রেঞ্জ ১,৫০০ কিলোমিটার, এই রেঞ্জ চীনের বিরুদ্ধে খুবই কম। চীনের নৌবাহিনীতে ৫০ এর অধিক এআইপি প্রযুক্তি যুক্ত সাবমেরিন আছে কিন্ত ভারতের কাছে ১৬ টি ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিন রয়েছে যাতে এআইপি প্রযুক্তিও নেই। তবে চীন ভারত মহাসাগরে ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ন শক্তি ব্যাবহার করতে পারবেনা। কারন চীন দক্ষিন চীন সাগর, পূর্ব চীন সাগরে জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিন কোরিয়া, ফিলিপিন্সকে নিয়ে সমস্যায় রয়েছে। এই সমস্ত দেশকে আমেরিকা সমর্থন করছে, দক্ষিন কোরিয়াতে, গুয়ামে আমেরিকার সামরিক বেস রয়েছে, যার কারনে চীনের নৌবাহিনীকে এখানেই ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে চীন জীবুতিতে সামরিক বেস তৈরি করেছে, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা, পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরের মাধ্যমে চীন ভারতকে চাপে রাখার চেষ্টা করছে। তবে ভারত মহাসাগরে ভারতের চীনের বিরুদ্ধে বিশাল ভৌগোলিক সুবিধা রয়েছে। 

চীনের নৌবাহিনী তিনটি পথে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করতে পারে। প্রথমত মালাক্কা প্রনালী হয়ে কিন্ত মালাক্কা প্রনালীর কাছে সিঙ্গাপুরে ভারতীয় নৌবাহিনী রয়েছে। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বেসে ভারতীয় নৌবাহিনীকে লজিস্টিক এবং রিফুয়েলিং এর অনুমতি দিয়েছে সিঙ্গাপুর। মালাক্কা প্রনালীর খুব কাছে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, এখানে ভারতের তিন বাহিনীর যৌথ কম্যান্ড রয়েছে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ প্রাকৃতিক ভাবেই ভারতের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার হিসাবে কজ করে। আন্দামানে ভারতীয় নৌবাহিনীর পিএইট আই নেপচুনও রয়েছে। সুতরাং মালাক্কা প্রনালী দিয়ে ভারতীয় নৌবাহিনীর নজর এড়িয়ে চাইনিজ সাবমেরিন ঢোকা একপ্রকার অসম্ভব। দ্বিতীয়ত সুন্দা প্রনালী হয়ে তবে এই অঞ্চল অগভীর যার কারনে এখান দিয়েও চাইনিজ সাবমেরিন আসতে হলে তাকে জলের উপরে উঠতেই হবে। তৃতীয়ত হচ্ছে লোমবোক প্রনালী এখানে সমুদ্র যথেষ্ট গভীর সাবমেরিন যাওয়ার জন্য। কিন্ত এখান থেকে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করতে তিনদিন বেশী সময় লাগে এবং এই অঞ্চল মাত্র ৪০ কিলোমিটার চওড়া। তবে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার সাহায্যে এই অঞ্চলেও ভারত নজর রাখতে সক্ষম। সুতরাং ভারত মহাসাগরে চীনের আধিপত্য বিস্তার যথেষ্ট সমস্যার। তবে ভারত মহাসাগরে ভবিষ্যতে চীনের আধিপত্য বিস্তার বন্ধ করতে ভারতের এই মহূর্তে দ্রুত পি ৭৫ আই প্রজেক্ট শুরু করে দেওয়া দরকার এবং নিউক্লিয়ার এসএসএন সাবমেরিন প্রজেক্টও শুরু করা দরকার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published.