কিভাবেই বা ভেঙ্গে গেল শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন?
আজ আমরা বিশ্ব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করব তা হল সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরি হবার ও তার ভেঙে যাবার সম্পর্কে। সময়টা ১৯১৭ এর দিকে যখন রুশ বিপ্লব হয় যার নেতৃত্বে ছিলেন ভ্লাদিমির লেলিন। দশম শতাব্দী থেকে রাশিয়ায় জারের রাজত্ব শুরু হয়। রাশিয়ার সম্রাটকে জার বলা হত। রাশিয়ান সাম্রাজ্য বিশাল বড় ছিল। ১৮৬৮ থেকে রাশিয়ার জার ছিলরোমানোভ ডাইনেস্টির নিকোলাস ২, ১৯১৮ সালে রুশ বিপ্লবে তাকে সহ তার গোটা পরিবারকে মেরে ফেলা হয়। এর সূচনা হয় ১৭৮৩ এর আমেরিকার বিপ্লব থেকে। আমেরিকার সাধারণ মানুষের বিরোধীতা দেখে উৎসাহিত হয়ে ছয় বছর পরে ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে বিপ্লব শুরু হয় কারন মানুষ বুঝে গেছিল জন বিক্ষোভ ছাড়া তারা তাদের অধিকার পাবে না। তবে এর পরেও ফ্রান্সে ছোট খাটো অনেক বিদ্রোহ হয়েছিল। ফরাসী বিপ্লব রেশ গোটা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং রাশিয়াতেও এসে পৌঁছায়।
আঠারো শতকে সুবিশাল সাম্রাজ্য ছিল রাশিয়ার তবে শুধু রাশিয়ায় নয় সেসময় ইউরোপে চারটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি। তবে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল ফ্রান্স। রাশিয়ান সাম্রাজ্যে জমিদারদের হাতে প্রচুর ক্ষমতা ছিল। দেখুন রাশিয়ান সাম্রাজ্য এভাবে বিভক্ত ছিল যে একদম ক্ষমতার শীর্ষে থাকত জার, তারপর জমিদার, তারপর মধ্যবিত্ত, তারপর নিম্নবিত্ত এবং সবশেষে কৃষক। এই কৃষকদের কাছে কোন জমি ছিল না যার জন্য এরা প্রচুর অত্যাচারের স্বীকার হত এরা, অথচ এরাই ছিল রাশিয়ার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ জমির মালিক। এদেরকে নামমাত্র মজুরি তে জমিদারদের জমি চাষ করতে হত প্রতিবাদ করলেই অমানুষিক অত্যাচার করা হত এবং মেরে ফেলা হত। কখনও কখনও তো মজুরি না দিয়ে টোকেন দেওয়া হত যা দিয়ে কৃষকরা অল্প কিছু খাবার নির্দিষ্ট দোকান থেকে কিনতে পারত। প্রায় সাতশো থেকে আটশো বছর ধরে এই অত্যাচারের পর ১৮৬০ থেকে ধীরে রাশিয়ার সাধারন মানুষ ক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। যেকোন বিপ্লবের পেছনে তিনটি প্রধান কারন থাকে আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক। রাশিয়ার ক্ষেত্রে আর্থিক সমস্যা ভয়াবহ ছিল কারন জমিদরদের শোষনের জন্য সমাজের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে ছিল। সেইসময় গোটা ইউরোপ জুড়ে শিল্প বিপ্লব শুরু হয় কিন্তু রাশিয়াতে এই শিল্প বিপ্লব অনেক দেরীতে শুরু হয়। যার জন্য পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় পূর্ব ইউরোপ তুলনামূলকভাবে কম শিল্পোন্নত ছিল তখন। রাশিয়াতে তখন ধীরে ধীরে কলকারখানা শুরু হয়েছিল। এই সময় রাশিয়ার জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি হতে শুরু করে।
১৮৯০ থেকে ১৯১০ এর মধ্যে রাশিয়ার সেন্ট পিটাসবারগ শহরের জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুন হয়ে যায়। একে জনসংখ্যা বৃদ্ধি তার উপর শোষন যার ফলে মানুষের ক্ষোভ আন্দোলনের রুপ নিতে থাকে। তার উপর রাশিয়ায় ঠান্ডা প্রচুর পড়ে যার জন্য চার থেকে পাঁচ মাস পর্যন্ত রাশিয়া পুরো বরফে ঢেকে যায় তাই কাজ কর্ম মোটামুটি বন্ধ থাকে, মানুষের হাতে রোজগার থাকে না সুতরাং সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ঘোরালো হতে শুরু করে।ঠিক এই সময়েই ইউরোপ জুড়ে ক্যাপিটালিজম, কমিউনিজম ও সোশ্যালিজমের বিস্তার হতে শুরু করে। গোটা ইউরোপে এর প্রভাব শুরু হলেও তা সফল হয়েছিল শুধু রাশিয়ায়। সোশ্যালিজমের জনক ছিল কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিক অ্যাংগেলস। এরা ছাড়াও আরও দুইজন ছিল রবার্ট ওয়ান ও লুইস ব্ল্যান্স। এদেরকেই সোশ্যালিজমের চার স্তম্ভ বলা হত। ইংল্যান্ডের বাসিন্দা রবার্ট ওয়ান খুব বিশাল ব্যাবসায়ী ছিল। তিনি কল কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের জন্য স্কুল, হসপিটাল তৈরি করেন। তিনি এক সমাজের স্বপ্ন দেখতেন যেখানে সবাই সমান থাকবেন। তিনি নিউহারমোনি নামে একটি সংস্থা তৈরি করেন কিন্তু পরে তা ব্যার্থ হয়। ফ্রান্সের বাসিন্দা বিখ্যাত ইতিহাসবিদ লুইস ব্ল্যান্সের মতবাদ ছিল এমন এক সমাজ তৈরি হবে যাতে সরকার উদার হবে কিন্তু রবার্ট ওয়ানের মতবাদ ছিল সরকারের দরকারই নেই সব কীছুতে সবার সমান অধিকার থাকবে। কিন্তু কার্ল মার্ক্সের মতবাদ ছিল সাধারণ মানুষের সরকারের থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া উচিত যারজন্য সোশ্যালিজমে সবচেয়ে বেশী কার্ল মার্ক্সের মতবাদ প্রধান্য পায়।
সেইসময় ইউরোপে আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ে এই মতবাদ। দিকে দিকে বিভিন্ন দল তৈরি হয় যেমন ব্রিটেনে লেবার পার্টি, জার্মানিতে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও ফ্রান্সে সোশালিস্ট পার্টি তৈরি হয়। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটা সংস্থাও তৈরি হয়। এর নাম সেকেন্ড রাখা হয় কারন সেসময় প্রথম ছিল ক্যাপিটালিজম মানে মুনাফা। সুতরাং রাশিয়াতেও এর হাওয়া এসে পৌছায়। রাশিয়ার মানুষ জারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ১৯০৫ সালের এক রবিবার জারের প্রাসাদের সামনে এসে জড়ো হয় সেখানে সেনারা নিরস্ত মানুষদের উপর গুলি চালায়, কয়েকশ মানুষের মৃত্যু হয়, ইতিহাসে একে “রক্তাক্ত রবিবার” বলা হয়। সারা রাশিয়ার মানুষ ক্ষেপে ওঠে, রাশিয়ার সমস্ত কারখানায় কাজ করা সাধারণ মানুষ স্ট্রাইক ডেকে দেয়। তখন জার বাধ্য হয়ে সাধারন মানুষদের কথা শোনবার জন্য পার্লামেন্ট তৈরি করে যাকে রাশিয়াতে ডুমা বলা হয়। তবে এটা নামেই ডুমা ছিল এর সব নিয়ন্ত্রণ জারের হাতে থাকত। এইসময় আরও একটা ব্যাপার হয়কী জারের সমস্ত সেনা এমনকী উপর মহলের কর্মচারীরা পর্যন্ত বিনা বেতনে পাচ বছরের মতন কাজ করছিল কারন রাশিয়ার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। অর্থাৎ পুরো সিস্টেম ভেতর থেকে নষ্ট হয়ে যায় । এমন অবস্থায় ১৯০৪-০৫ এ জাপান ও রাশিয়ার যুদ্ধ হয় কোরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আর অদ্ভুত ভাবে রাশিয়া যুদ্ধে হেরে যায়। এত বিশাল সাম্রাজ্য কে একটা ছোট্ট দেশ হারিয়ে দেয় এটা রাশিয়ার ভয়ংকর বেজ্জতি হয়, লোক আরও ক্ষেপে ওঠে।
রাশিয়ার জার আরও একটি বড় ভুল করে বসে ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে। এই সময় সুইজারল্যান্ড থেকে লেলিন চিঠি পর্যন্ত লিখেছিল যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ না নিতে কিন্তু জার শোনে নি। এর ফল হয় কী ১৯১৬ সালে জার্মানি পশ্চিম রাশিয়া দখল করে নেয়, জন বিক্ষোভ বিস্ফোরণে পরিনত হয় এবার এবং প্রথমেই গ্রেগরি রাসপুতিনকে হত্যা করা হয়। গ্রেগরি রাসপুতিন ছিল জারের পরামর্শদাতা, রাসপুতিন একজন বড় জাদুকর হওয়ার পাশাপাশি নেশায় আসক্ত ব্যক্তি ছিল। রাশিয়ার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেবার পেছনে রাসপুতিনের প্রধান ভূমিকা ছিল যার জন্য লোকে প্রথমে তাকেই মেরে ফেলে। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে জারের মহলের সামনে আবার ভিড় জমা হয় লোক খাদ্যের জন্য বিক্ষোভ করতে শুরু করে। জার সেনাকে আদেশ দেয় সবাইকে হত্যা করতে কিন্তু সেনাও বিনা বেতনে কাজ করত যার জন্য সেনা সাধারন মানুষের সাথে মিশে যায় এমনকী জারের রয়্যাল গার্ড পর্যন্ত সাধারন মানুষের সাথ দেয়। যার জন্য বাধ্য হয়ে জার নিজের মুকুট খুলে ফেলে এবং জার সহ জারের পুরো পরিবারকে কিডন্যাপ করা হয়। একে ফেব্রুয়ারি রেভোলিউশন বলে। এরপর রাশিয়ায় নতুন প্রভেশনাল সরকার গঠন কর হয় যার প্রধানমন্ত্রী করা হয় বিখ্যাত আইনবীদ আলেকজান্ডার কীরনস্কি। কিন্তু এখানে ব্যাপার হয়ে যায়।
১৮৯৮ সালে বাকী অন্যান্য দেশের মত রাশিয়াও রাশিয়ান সোশ্যালিস্ট পার্টি নামে একটি দল তৈরি হয় যার প্রধান ছিল ভ্লাদিমির লেলিন। কিন্তু পরে ১৯০৩ সালে এই দল দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় যার একটি হচ্ছে মেনশেভিক এবং আরেকটি বলশেভিক। লেনিন নেতৃত্ব করত বলশেভিকের। মেনশেভিক দলে ছিল মূলত সমাজের উচ্চস্তীয় ব্যাক্তিরা যেমন জমিদার, সেনার জেনারেল এরা তাদের প্রধান শত্রু মনে করত বলশেভিলদের যার জন্য লেলিন সুইজারল্যান্ড পালিয়ে যায়। আলেকজান্ডার কীরনস্কি অনেক আইন বানায় কিন্তু তিনি যে ভুলটা করে বসেন তা হচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়াকে ব্যাস্ত রাখেন এবং দেশের অর্থনৈতিক দিকটা সম্পূর্ণ অবহেলা করেন। যার জন্য লেলিন একটা পরিকল্পনা বানায় লেনিন সাধারন মানুষকে কমিউনিজমের উদাহরণ দিয়ে বোঝাতো শুরু করে এবং বলে সে ক্ষমতায় এলে সাধারন মানুষের সরকার হবে, জমিদারদের কাছ থেকে জমি কেড়ে সাধারন মানুষকে দিয়ে দেওয়া হবে এবং রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেড়িয়ে আসবে। লোক তখন লেনিনের ফ্যান সমর্থক হতে শুরু করে আসতে আসতে। এই সময় লেনিনের দলে লিওন ট্রসকির নেতৃত্বে পেট্রোগাট, যাকে এখন সেন্ট পিটাসবারগ বলে, এবং মস্কো দখল করে নেয়। এই লিওন ট্রসকি ১৯০৩ থেকে মেনসেভিকে ছিল কিন্তু ১৯১৭ সালে তিনি বলশেভিকে চলে আসেন।
বলশেভিকে লেনিনের অনুগামীদের রেড আর্মি বলা হত এবং মেনশেভিক সহ জারের অনুগামীদের হোয়াইট বলা হত। এদিকে লেলিন কার্ল মার্ক্সের সোশ্যালিজম থেকে সরে এসে নিজস্ব মতবাদ প্রচার করেন যাকে লেনিনিজম বলা হয়। তার মতবাদ অনুযায়ী দেশের সবকিছুতে সবার সমান অধিকার তো থাকবে কিন্তু সবকিছু নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন সরকার দরকার তা সে সরকার যতই একনায়কতন্ত্র হোক। এই কারনে বলশেভিক থেকে কিছু লোক আলাদা হয়ে যায় যাদের গ্রিন বলা হত। ১৯১৮ সালে রাশিয়ায় রেড আর্মি, হোয়াইট ও গ্রিনদের মধ্যে ব্যাপক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৯১৮ সালের ১৭ জুলাই জার সহ তার গোটা পরিবারকে হত্যা করে বলশেভিকরা। অবশেষে ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ায় গৃহযুদ্ধ শেষ হয় এবং জোসেফ স্টালিনের নেতৃত্বে রেড আর্মি জয় লাভ করে। ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে ১৫ টি দেশ নিয়ে তৈরি হয় ইউএসএসআর বা ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক, যার প্রধান হয় ভ্লাদিমির লেলিন। ১৯২৫ সালে লেলিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন প্রধান হন জোসেফ স্টালিন।
এত বিশাল সাম্রাজ্য হঠাৎ ই ১৯৯১ সালে ভেঙে গিয়ে ১৫ টি আলাদা দেশ তৈরি হয় যা গোটা বিশ্বের বিগত একশো বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যেতে আমেরিকা সহ পাকিস্তান ব্যাপক খুশি হয়েছিল কারন কোন মিসাইল অ্যাটাক, যুদ্ধ ছাড়াই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায় এবং পৃথিবীতে একটাই সুপার পাওয়ার থাকেনতা হল ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা। পাকিস্তান খুশি ছিল কারন ১৯৭১ এ পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হওয়ার পেছনেও ভারতকে বিশাল সাহায্য করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এদিকে ভারতের জন্য এটা খুবই খারাপ ব্যাপার ছিল কারন স্বাধীনতার পর থেকে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলা স্নায়ুযুদ্ধে ভারত বরাবরই সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশে ছিল। সেইসময় আমেরিকার অনেক সাংবাদিক রীতিমতো সমালোচনা করে ভারতকে বলে ভারতের ব্রেকআপ হয়ে গেছে সোভিয়েতের সাথে, ভারত বিশাল বড় একজন অভিভাবককে হারিয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের একটা বড় কারন ছিল আফগানিস্তান আক্রমণ। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে। এই সময় আমেরিকা ও পাকিস্তান আফগানিস্তানে তালিবান জঙ্গি সংগঠন তৈরি করে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে ছায়া যুদ্ধ করতে থাকে। যার ফলে টানা ১০ বছর যুদ্ধের পর ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাধ্য হয়ে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায় আর ঠিক দুবছর পরই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়ে ১৫ টি দেশ তৈরি হয়। তবে এটাই প্রধান কারন ছিল না। একটা জিনিস দেখবেন যখন কোন দেশ ভাগ হয় যেমন ভারত পাকিস্তান যখন ভাগ হয়েছিল প্রচুর হিংসা, হত্যাকান্ড দেখা গিয়েছিল কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার সোভিয়েত ইউনিয়নের মত এত বিশাল বড় সাম্রাজ্য ভাগ হওয়ার সময় কোন হিংসা ঘটে নি। আসলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরির সময়েই এর পতনের ভীত তৈরি হয়ে যায়। কারন ভ্লাদিমির লেলিন তো ইউএসএসআর তৈরি করে ফেলেন কিন্তু তাকে শাসন করতে পারেননি বেশীদিন কারন সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরির মাত্র দুই বছরের মধ্যে লেনিন মারা যায়। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নের দায়িত্ব পায় জোসেফ স্টালিন। পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র লিডারদের তালিকায় সাত নম্বরে আছে স্টালিন। প্রথমে আছে মাও জে ডং যে নীজের শাসন কালে ৭ মিলিয়ন বা প্রায় সাত কোটি লোককে হত্যা করেছিল। জোসেফ স্টালিন ও অ্যাডলফ হিটলার দুজনকেই সমান হিংস্র বলা হত কারন এদের মধ্যে দয়ামায়া বলে কিছু ছিল না।
স্টালিনের অনেক অদ্ভুত নীতির কারনে বহু মানুষ মারা গেছিল যেমন স্টালিন যে জায়গায় জনসংখ্যা কম সেখানে যে জায়গায় জনসংখ্যা বেশী সেখান থেকে মানুষকে জোর করে নিয়ে যেত যার জন্য অনেক মানুষ মারা যায়। রাশিয়ার দুঃখের দিন যেন শেষ হচ্ছিল না যেন। প্রথমে জারের শাসন, তারপর আভ্যন্তরীণ বিপ্লব, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবার আবার স্টালিন। তবে স্টালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জিতে ছিল। স্টালিন একটা কথা বলত তার মৃত্যুর পর আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়ন কে ভেঙে দেবে তাই সে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কাউকে অবাধে হত্যা করত। তবে এবার মনে হতে পারে যে তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন এত বড় সুপার পাওয়ার কীভাবে তৈরি হয়েছিল যারা আমেরিকার সাথে টেক্কা নিচ্ছিল? ১৯৫৩ সালে স্টালিনের মৃত্যুর পরই ইউএসএসআর আসল সুপার পাওয়ার হওয়া শুরু হয়। এই সময় টেকনোলজি ও মহাকাশের দিক দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যাপক উন্নতি করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম দেশ যারা পৃথিবীর প্রথম স্যাটেলাইট স্পুটনিক -১ লঞ্চ করে। সোভিয়েত প্রথম দেশ যারা মহাকাশে মানুষ পাঠা ইউরি গ্যাগারিন। এই সময় ভারতের সাথেও ব্যাপক ভাল সম্পর্ক তৈরি হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের।
ভারত খাদ্য, লোন, অস্ত্র সবের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভরশীল হতে থাকে। ১৯৬০-৮০ পর্যন্ত সময় কে সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে সোনালী সময় বলা হতে থাকে। কিন্তু এরপরই ১৯৮০ এর পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অগ্রগতি থেমে যেতে থাকে। ১৯৮০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। প্রথমত আফগানিস্তান যুদ্ধে সোভিয়েতের কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচা হয় সেখান থেকে তাদের কোন লাভ হয় নি। অন্যদিকে স্নায়ুযুদ্ধের ফলে আমেরিকার সাথে পাল্লা দিয়ে পরমানু অস্ত্রের সংখ্যা বাড়ানো যার ফলে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের। কারন আমেরিকা অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী দেশ ছিল এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আমেরিকাকে সাহায্য করত। ১৯৮৬ সালে ইউক্রেনের চেরনাবোলে, তখন ইউক্রেন সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল, ভয়ঙ্কর পরমাণু দুর্ঘটনা ঘটে যার ফলে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। সোভিয়েত সরকার এটা লোকানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু তা প্রকাশ হয়ে যায়। গোটা সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে দুর্নীতি ব্যাপক বেড়ে যায়, খাদ্য সংকট দেখা যায়।
১৯৮৯ সালে একটা মজার ঘটনা ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের এক লিডার বরিস ইয়ালসেন আমেরিকা সফরে যান সেখানে সুপার মার্কেট দেখে তিনি চমকে যান কারন সোভিয়েত ইউনিয়নে এমন কোন ধারনাই ছিল না কারন সোভিয়েতে সবকিছু সরকার নিয়ন্ত্রণ করত কিন্তু আমেরিকাতে ক্যাপিটালিজম ছিল অর্থাৎ প্রাইভেট কোম্পানি ছিল। এই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রদেশ যেমন এস্তোনিয়া, লাটাভিয়া সহ কাজাখিস্তান সর্বত্র মস্কোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়, কোথাও কোথাও তো বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। সবার দাবি ছিল রাশিয়া একা সব সুবিধা ভোগ করে তারা স্বাধীনতা চায়। সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেখের সামনে দুটো রাস্তা ছিল এক স্টালিনের মতন যারা দেশের বিরুদ্ধে কথা বলছে তাদের হত্যা করা অথবা প্যারিসস্ত্রোরিকা বা গ্লাসনস্ত। প্যারিসস্ত্রোরিকা ও গ্লাসনস্ত দুটো আলাদা শব্দ। প্যারিসস্ত্রোরিকার মানে সোভিয়েত ইউনিয়ন সব ক্ষমতা রাশিয়ার হাতে না রেখে সব প্রদেশে ক্ষমতা সমান ভাবে ভাগ করে দেবে। গ্লাসনস্তের অর্থ জনগনের মতবাদ গ্রহন করা হবে, অর্থাৎ সবাইকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে আরও। এটা নিঃসন্দেহে ভাল পদক্ষেপ ছিল কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে অন্তত আরও দশ বছর আগে হলে ভাল হত। গ্লাসনস্তের ফলে বিশ্বের সামনে চেরনোবিলের ঘটনা সামনে চলে আসে যা নিয়ে সারা বিশ্বে আলোড়ন পড়ে যায়। মিখাইল গর্বাচেফ কে পরে যখন প্রশ্ন করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার কারন কী উনি বলেন চেরনোবিলের কারনে। অবশেষে ১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়ে পনেরোটি স্বাধীন দেশ তৈরি হয় রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, এস্তোনিয়া, জর্জিয়া, কাজাখিস্তান, কিরগিজস্তান, লাটাভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মলডোভা, তাজাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তান। এরপর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন বরিস ইয়ালসেন কিন্তু তার সময়েও রাশিয়ার অবস্থা আরও খারাপ হয়। তারপর ১৯৯৯ থেকে রাশিয়ার দায়িত্বে আসেন ভ্লাদিমির পুতিন যার হাত ধরো রাশিয়ার উত্থান হয় এবং পুতিনের লক্ষ্য নতুন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরি করা যার জন্য পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করেছে বলে মত অনেক বিশেষজ্ঞদের।
অনেকটা ছোট করে বলার চেষ্টা করা হয়েছে, তবে প্রচুর ভিন্ন মতবাদ রয়েছে এর পেছনে। একাধিক রিপোর্টের উপর বিশ্লেষণ করে এই লেখা। সোভিয়েতের এই ইতিহাস নিয়ে অনেক মতবাদ রয়েছে যদিও।