ফিচার আর্টিকেল

নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকারের সাগরমালা প্রজেক্ট। লজিস্টিক সমস্যাকে দূর করতে অভূতপূর্ব প্ল্যান

ভারতের কাছে প্রাকৃতিক সামুদ্রিক সুবিধা রয়েছে, ভারতের উপকূল ভাগ ৭,৫০০ কিলোমিটার লম্বা যা তেরোটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বানিজ্যের ক্ষেত্রেও ভারতের উপকূল ভাগের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রয়েছে। বলা হয় যে দেশ এশিয়াতে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চায় তার জন্য আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরে নিজের শক্তিশালী অবস্থান প্রয়োজন। সামুদ্রিক লজিস্টিক ভারতের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ন অংশ যার উপর ভারতের আমদানি ও রপ্তানির ৯০ শতাংশ নির্ভর করে। ২০১৫ সালে ভারতের দুইশোটি বন্দর দিয়ে এক বিলিয়ন টনের বেশী পন্য আমদানি রপ্তানি হয়েছিল। কিন্ত এত বিশাল পরিমান পন্য নিয়ন্ত্রনের জন্য একটি বড় লজিস্টিকস খরচ ভারতের জিডিপি থেকেই যায়। আমদানি ও রপ্তানি বানিজ্যের জন্য কন্টেইনার ভারতে সাতশো থেকে এক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত পরিবহন করা হয়, তারপরেই কোনও পন্য উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বন্দরে বা বন্দর থেকে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছাতে পারে, এই পুরো যাত্রায় সাত থেকে সতেরো দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়। কিন্তু সেই তুলনায় চীনে পন্যকে বন্দর থেকে বা বন্দর থেকে নির্দিষ্ট জায়গায় মাত্র দেড়শো থেকে তিনশো কিলোমিটারই পরিবহন করা হয়, যাতে গড়ে ছয়দিন সময় লাগে। এই কারনে ভারতের আধুনিক পরিকাঠামো দরকার যাতে লজিস্টিকে গতি আসে এবং খরচ কম হয়। এই কারনেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার শুরু করেছে সাগরমালা প্রজেক্ট যা ভারতের লজিস্টিক সমস্যাকে সমাধান করবে।  

ভারতের ৭,৫০০ কিলোমিটার বিস্তৃত উপকূলভাগ জুড়ে ব্যাপক পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পই হচ্ছে সাগরমালা প্রজেক্ট। ৭,৫০০ কিলোমিটার উপকূল ভাগের পাশাপাশি ১৪,৫০০ কিলোমিটার লম্বা নদীপথেরও উন্নয়ন করা হচ্ছে পন্য পরিবহনের জন্য। গুজরাট থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত অঞ্চলে ভারতের সমস্ত গুরুত্বপূর্ন বন্দরগুলি রয়েছে, এগুলো দেখতে পুরো একটা মালার মতো যার কারনে এই প্রজেক্টের নাম রাখা হয়েছে সাগরমালা। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই এই প্রকল্পের সূচনা করা হয়। তবে সাগরমালা প্রজেক্ট সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে, সেসময় ভারতে জাতীয় সড়ক তৈরির জন্যও আরও একটি গুরুত্বপূর্ন প্রজেক্ট শুরু করা হয়েছিল স্বর্নালী চতুর্ভুজ। পরবর্তীকালে এই প্রকল্প আরও বিস্তীর্ন করে ২০১৫ সালে শুরু করা হয়। এই প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য ভারতের গুরুত্বপূর্ন বন্দর সহ আশেপাশের এলাকার উন্নয়ন। সাগরমালা প্রকল্পে অনেক প্রজেক্ট রয়েছে কিন্তু এই প্রকল্পের মূল হচ্ছে বন্দরের আধুনিকরন। যদি ভারতের বন্দরগুলোর কাছেই শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠে তাহলে পরিবহনে খরচ ও সময় অনেক কমে যাবে যার কারনে আন্তজার্তিক বানিজ্যে ভারত চীন সহ অন্যান্য দেশের সাথে আরও বেশী প্রতিযোগিতা করতে পারবে। 

সাগরমালা প্রজেক্টের চারটি গুরুত্বপূর্ন অঙ্গ হচ্ছে লজিস্টিক ব্যবস্থার উন্নতি, বন্দরের আধুনিকরন, নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক বিকাশ। সাগরমালা প্রজেক্টের এই চার প্রধান স্তম্ভের আওতায় ২০১৬ সালে দেড়শো এর বেশী প্রজেক্টের ঘোষনা করা হয় যাতে চার লাখ কোটি টাকা পরিকাঠামো উন্নয়নে খরচ করা হচ্ছে। তবে সাগরমালা প্রজেক্টে সর্বমোট ৫৭৭টি প্রজেক্ট করা হবে ২০১৫ থেকে ২০৩৫ এর মধ্যে যাতে ১১ ট্রিলিয়ন রুপি বা ১৪০ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে।  

যেহেতু এই প্রজেক্টে মূল ভিত্তি বন্দরের উন্নয়ন তাই ভারতের বন্দরগুলোকে বিশেষ উন্নয়ন করা হবে। বর্তমানে ভারতে ১২টি প্রধান বন্দর সহ দুইশোটি অন্যান্য বন্দর রয়েছে, এদের মধ্যে বেশ কিছু বন্দরেরই পন্য পরিবহনের ক্ষমতা খুবই কম। কান্দলা, মুন্দ্রা, মুম্বাই, জওহরলাল নেহেরু পোর্ট ট্রাস্ট, চেন্নাই, বিশাখাপত্তনম, পারাদ্বীপ ভারতের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন বন্দর যেখানে ভারতের আমদানি ও রপ্তানির সিংহভাগ পন্য আসে। 

ভারত সরকার সাগরমালা প্রজেক্টের মাধ্যমে ব্লু রেভোলিউশন বা নীল বিপ্লব আনার চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার ভারতের উপকূল ভাগ অঞ্চল ও সেখানকার মৎস্যজীবি মানুষদের উন্নয়ন এই সাগরমালা প্রজেক্টের সাথেই যুক্ত করেছে যাতে আট লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ আসবে। এই প্রকল্পে চোদ্দটি উপকূলীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হবে। এর ফলে ভারতের উপকূলবর্তী এলাকায় পর্যটনশিল্পেরও বিকাশ ঘটবে। ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করি জানিয়েছিলেন ভারত সরকার সাগরমালা প্রজেক্টে প্রাথমিক ভাবে পনেরো লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা চিন্তা করছে, এছাড়া পুরোনো বন্দরগুলোর উন্নয়নেও চার লাখ কোটি টাকা খরচ করা হবে। ভারতের জিডিপির ১৮ শতাংশই পরিবহনে খরচ হয়ে যায় সেজন্য সাগরমালার মতোন প্রকল্প ভারতের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় যাতে লজিস্টিকসে খরচ কম হয়। সাগরমালা প্রকল্প ২০২৫ এর মধ্যে ভারতের পন্য রপ্তানি ১১০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে এক কোটি নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে যার মধ্যে চার মিলিয়ন বা চল্লিশ লাখ সরাসরি কর্মসংস্থান হবে। চীনের শেনজেন প্রদেশে বন্দর উন্নয়ন প্রজেক্ট ১৯৭৮ সালের পর থেকে ওই অঞ্চলে সাত মিলিয়ন কর্মসংস্থান তৈরি করেছে এবং ওই প্রদেশের জিডিপি ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে, এরকমই ভারতের সাগরমালা প্রকল্পের সাথে হবে, এই প্রকল্পে বিদেশী বিনিয়োগও আসছে। 

সাগরমালা প্রজেক্টের আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল যেকোনও পন্যবাহী জাহাজের ফিরে যাওয়ার সময় দুই দিনের কম করা। যেমন পশ্চিমবঙ্গের একটি বড় বন্দর হল হলদিয়া বন্দর। হলদিয়া বন্দরে যদি কোনও দেশ থেকে পন্যবাহী জাহাজ পন্য নিয়ে আসে তাহলে প্রথমে বন্দরে প্রবেশ করার পর জাহাজটি তার পন্য খালি করে এবং নতুন পন্য ভর্তি করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যায়, এই সময়টাকে জাহাজটির ফিরে যাওয়ার সময় বলা হয়। কোনও জাহাজ যত তাড়াতাড়ি বন্দরে ঢুকে পন্য খালাস করে নতুন পন্য নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবে তত সেই দেশটির আমদানি ও রপ্তানি বানিজ্যে গতি বৃদ্ধি পাবে। একমাত্র বিশ্বমানের বন্দরেই এত দ্রুত জাহাজ থেকে পন্য নামানো ও ওঠানো সম্ভব। 

২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী সাগরমালা প্রকল্পে ছয় বছরে জাহাজের ফিরে যাওয়ার সময় ৩৫ শতাংশ কমে গেছে। আগে ভারতের কোনও বন্দরে জাহাজ আসার পর, জাহাজ বেরিয়ে যেতে তিন থেকে চার দিন সময় লাগতো কিন্তু এখন সেই সময় ৩৫ শতাংশ কমে গেছে। ভারত সরকারের লক্ষ্য এই সময় আরও কমিয়ে দুই দিনেরও কমে নিয়ে আসা। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী সাত বছরে প্রজেক্ট সাগরমালাতে ৪৫,০০০ কোটি টাকায় ২৯ টি প্রজেক্ট সম্পন্ন হয়েছে। তবে সাগরমালা প্রজেক্ট শুরু হওয়ার সময়ে বেশ কিছু বাধাও এসেছিল। ২০১৬ সালে দিল্লিতে বেশ কিছু মৎস্যজীবি সংগঠন সাগরমালা প্রজেক্টের বিরোধীতা করে। তাদের দাবী নতুন বন্দর নির্মানের কারনে সমুদ্রের জলজ জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যার প্রভাব স্থানীয় মৎস্যজীবি মানুষদের জীবিকার উপর পড়ছে কারন উপকূলবর্তী এলাকায় মাছ ধরেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া তামিলনাড়ুতে এনায়াম বন্দর, কামরাজ ইনুর বন্দর, তিরুবান্তপুরামে ভিজহিনজাম বন্দর, কচ্ছ গুজরাটের মুন্দ্রা এলাকায় স্থানীয় মৎস্যজীবি সম্প্রদায় আদানি বন্দর তৈরির বিরোধীতা করেছিল। তবে ভারত সরকার স্থানীয়দের সাথে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে। সাগরমালা প্রজেক্টকে সিকিউরিটি এন্ড গ্রোথ ফর অল ইন দি রিজিওন বা সাগর প্রজেক্টের সাথে তুলনা করা হয় যা ভারত মহাসাগর অঞ্চলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে শুরু করা হয়েছে। সাগরমালা প্রজেক্টের সাথে এই সাগর প্রজেক্ট গভীরভাবে যুক্ত। কারন ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলি বিশেষ করে ওমান, ইরান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, মায়ানমার, সিশিলসের মতোন দেশের সাথে ভারতের খুব ভালো বানিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। সাগর প্রজেক্টে এসব দেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগীতায় বানিজ্য ও উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়েছে। ভারত মহাসাগর ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ন হটস্পট। এখানেই অবস্থিত মালাক্কা প্রনালী যা আন্তর্জাতিক সমুদ্র বানিজ্যের জন্য অন্যতম ব্যস্ত পথ। চীন এই অঞ্চলে তার প্রভাব বিস্তারের জন্য এবং ভারতকে ঘিরে ফেলবার জন্য স্ট্রিং অফ পার্লস নীতি তৈরি করেছে। চীনের এই স্ট্রিং অফ পার্লস নীতির অন্যতম জবাব ভারতের এই সাগর প্রজেক্ট। সাগরমালা প্রকল্পের মাধ্যমে বন্দর গুলোর উন্নয়নের মাধ্যমে ভারত আমদানি ও রপ্তানিতে গতি আনতে চলেছে, সুতরাং সাগর প্রজেক্টের সাফল্যের উপর সাগরমালা প্রকল্প নির্ভরশীল।

Leave a Reply

Your email address will not be published.