ফিচার আর্টিকেল

আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের গোপন তথ্য জানতে বিরাট অপারেশান করেছিল সোভিয়েত। পোর্টল্যান্ড স্পাইরিং

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা হওয়ার বদলে সমস্যা আরও বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একই পক্ষে থাকা আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন একে অপরকে টেক্কা দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের চেষ্টা শুরু করে, ইতিহাসে এই ঘটনা শীতল যুদ্ধ নামে পরিচিত যা ১৯৯১ সাল পর্যন্ত চলেছিল। এই সময়ে আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের ইনটেলিজেন্স সংস্থার গতিবিধি বৃদ্ধি করেছিল যাতে বিপক্ষের গোপন তথ্য পাওয়া যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তচর সংস্থা কেজিবি ১৯৫০ এর দশকে এমন এক স্পাইরিং তৈরি করে ইংল্যান্ডে যা হতবাক করে দিয়েছিল ব্রিটেন ও আমেরিকাকেও। এই স্পাইরিংয়ে হ্যারি হাউটন, এথেল জি, কোনন মোলোডি, লোনা ও মরিস কোহেন এই পাঁচজন সদস্য ছিল যারা কেজিবির হয়ে কাজ করতো।

কোনন মোলোডি:— সাত বছর বয়স থেকে পরবর্তী নয় বছর আমেরিকাতে পড়ার পর ১৯৩৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিরে যায় কোনন মোলোডি। ১৯৪০ সালে কোনন এনকেভিডি তে (তৎকালীন কেজিবি) যোগদান করে। ১৯৪৯ সালে তাকে কেজিবির এজেন্ট হিসাবে প্রশিক্ষন দিয়ে কানাডার নাগরিক গর্ডন লন্সডেলের পরিচয় দেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে কোনন কনাডা আসে সেলসম্যান হিসাবে কাজ করার জন্য। ১৯৫৫ সালে তাকে আমেরিকা পাঠায় কেজিবি এবং সেখান থেকে ইংল্যান্ড পাঠানো হয়। ব্রিটেনে একটি ছদ্ম পরিচয় তৈরির জন্য লন্ডনের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে একটি চাইনিজ শিক্ষার জন্য ভর্তি হয় কোনন। ১৯৫৬ সাল থেকে ব্রিটেনে ভেন্ডিং মেশিনের ব্যবসা শুরু করে কোনন।

লোনা ও মরিস কোহেন:— মরিস কোহেন ও লোনা দুজনেই আমেরিকান কমিউনিস্ট ছিলেন। মরিস কোহেন স্পেনে থাকার সময়ে কেজিবিতে যোগ দেয়। আমেরিকায় ফিরে আসার পর ১৯৪১ সালে লোনাকে বিয়ে করে মরিস, লোনা জানতো না তার স্বামী একজন সোভিয়েত এজেন্ট। পরে লোনাকে মরিসই জানায় তার পরিচয় এবং লোনাও কেজিবিতে যোগ দেয়। আমেরিকা যখন ম্যানহ্যাটেন প্রজেক্টে পরমানু বোম্ব তৈরি করছিলো সেসময় লোনা কুরিয়ার সার্ভিসে কাজ করতো। লোনা আমেরিকার পরমানু বোম্ব তৈরির সমস্ত ডায়াগ্রাম সোভিয়েত ইউনিয়নকে পৌঁছে দিয়েছিল। আমেরিকার পরমানু বোম্ব পরীক্ষা করার বারো দিন আগেই সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পরমানু বোম্বের সম্পূর্ন ডায়াগ্রাম ছিল। এর সাহায্যেই আমেরিকার পরমানু বোম্ব তৈরির চার বছরের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নও পরমানু বোম্ব তৈরি করে। ১৯৫০ সালের জুন মাসে মরিস ও লোনা গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কায় মস্কো পালিয়ে যায়। সেখান থেকে তারা প্রথমে পোল্যান্ড যায় এবং ১৯৫৪ সালে আবারও ব্রিটেনে ফিরে আসে। তবে এবার মরিস ও লোনা দুজন নিউজিল্যান্ড নাগরিকের ছদ্মবেশে বসবাস শুরু করে, তাদের নতুন নাম ছিল পিটার ও হেলেন ক্রোগার। লন্ডনে তারা পুরোনো বইয়ের ব্যবসা শুরু করে। কিছুদিন পর তাদের সাথে যোগাযোগ হয় কোনন মোলোডির, সেসময় ইংল্যান্ডে তার নাম ছিল লন্সডেল। কোনন ক্রোগার দম্পতিকে রেডিও ট্রান্সমিটার দিয়েছিল যার সাহায্যে তারা মস্কোতে যোগাযোগ করতো।

হ্যারি হাউটন ও এথেল গি:— ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সদস্য ছিল হ্যারি হাউটন, যাকে ১৯৫১ সালে পোল্যান্ড পাঠিয়েছিল ব্রিটেন। সেখানে ক্যাটরিনা নামে এক মহিলার সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে হ্যারি হাউটন। এই ক্যাটরিনা পোল্যান্ড ইনটেলিজেন্স বিভাগের সদস্য ছিল। অতিরিক্ত অর্থের জন্য এইসময়েই হ্যারি হাউটন পোল্যান্ডকে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর গোপন তথ্য দেওয়া শুরু করে। ১৯৫২ সালে হ্যারি হাউটনকে ব্রিটেন দেশে ডেকে আনে এবং পোর্টল্যান্ডে অ্যাডমিরালটি আন্ডারওয়াটার ওয়েপন্স এস্টাবলিশমেন্ট বা এইউডব্লিউইতে পোস্টিং করে দেয়। এখানেই তার সাথে পরিচয় হয় এথেল গির। এইউডব্লিউইতে অত্যন্ত গোপন প্রজেক্টের তথ্যের দায়িত্ব ছিল এথেল গির উপর যার ডাকনাম ছিল বান্টি। হ্যারি হাউটন ও এথেল গির মধ্যে খুব দ্রুতই প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যার কারনে এথেল গি পরে নিজের দেশের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। পোর্টল্যান্ড স্পাই রিং এর প্রধান ব্যক্তি ছিল এই হ্যারি হাউটনই যার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশী তথ্য পেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।

হ্যারি হাউটনকে কেজিবি একটি ছোট মাইনক্স ক্যামেরা দিয়েছিল যা একটি সিগারেট লাইটারের মধ্যেই রাখা যায়৷ এর মাধ্যমে প্রচুর গোপন তথ্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে পাঠাতে শুরু করে সে। ১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালে অন্তত ২,৭০০ পাতার গোপন তথ্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে পাঠায় হ্যারি। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ, প্রপেলার, টর্পেডো, সাবমেরিন সম্পর্কিত যাবতীয় গোপন তথ্য সোভিয়েতকে পাঠাতে শুরু করে হ্যারি। তবে হ্যারির একটা সমস্যা ছিল তা হল অতিরিক্ত বিলাস বহুল জীবন যাপন, যার জন্য তার স্ত্রী প্যাগির সাথে তার বৈবাহিক জীবনও ভালো ছিলনা। অনেকবার ব্রিটিশ নৌবাহিনীর গোপন তথ্য নিজের ঘরেতেই ভুল করে রেখে হ্যারি বাইরে চলে যেত। এসব দেখে সন্দেহ হয় প্যাগির এবং সে এইউডব্লিউইকে এব্যাপারে জানায়। কিন্তু এইউডব্লিউইতে হ্যারি এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে প্যাগির কথাকে কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি প্রথমে। তিনবার অভিযোগ জানানোর পর অবশেষে ব্রিটেনের ইনটেলিজেন্স সংস্থা এমআই৫ কে এই তথ্য জানায় এইউডব্লিউই। এমআই৫ এর মতো সংস্থাও প্যাগির অভিযোগ ততটা গুরুত্ব দেয়নি কারন প্যাগি ও হ্যারির ডিভোর্সের কথা চলছিলো তা সবাই জানতো, তাই এমআই৫ মনে করেছিল প্যাগি ইচ্ছে করেই এমন করছে। তবে এমআই৫ এইউডব্লিউই থেকে হ্যারিকে অন্য বিভাগে সরিয়ে দেয়। নতুন বিভাগে তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ন না হওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন হ্যারিকে অর্থ পাঠানো বন্ধ করে দেয়। ফলে বিলাসবহুল জীবনযাপন করা বন্ধ হয়ে যায় হ্যারির এবং অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয় তার। এরকম পরিস্থিতিতে হ্যারি হাউটন তার প্রেমিকা এথেল গির সাহায্য নেবে ঠিক করে কারন এথেল গি তখনও এইউডব্লিউইতে ছিল এবং গোপন তথ্য বিভাগের দায়িত্বে ছিল সে। কিন্ত হ্যারি হাউটন সরাসরি এথেল গির কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য তথ্য চায়নি, হ্যারি হাউটন একটি বড় পরিকল্পনা তৈরি করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কোনন মোলোডিকে একজন আমেরিকান কম্যান্ডার অ্যালেক্স জন্সটন সাজিয়ে এথেল গির সাথে সাক্ষাৎ করায়। কোনন মোলোডি এথেল গিকে জানায় আমেরিকা জানতে চাইছে ব্রিটেন আমেরিকাকে যেসব তথ্য দিচ্ছে সেসব ঠিক কীনা। যেহেতু সেসময় আমেরিকা ও ব্রিটেন বন্ধু ছিল সেজন্য এথেল গি কীছু সন্দেহ করেনি। এথেল গি ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রথম পরমানু সাবমেরিন এইচএমএস ড্রেডনটের তথ্য সহ ব্রিটিশ নৌবাহিনীর অনেক তথ্য হ্যারি হাউটনকে দিয়ে দেয়। এথেল গি প্রথমে তথ্য দিত হ্যারি হাউটনকে, সেখান থেকে তথ্য যেত কোনন মোলোডির কাছে। কোনন মোলোডি এসব তথ্য পাঠাতো কোহেন দম্পতিকে। কোহেন দম্পতি গোপন ভাবে এসব তথ্য মস্কোতে পাঠাতো। এভাবে নিজের অজান্তেই এথেল গি সোভিয়েত এজেন্ট হয়ে গিয়েছিল। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো আমেরিকা, ব্রিটেন হয়ত জানতেও পারতোনা এই স্পাই নেটওয়ার্ক সম্পর্কে কিন্ত ১৯৬০ সালে পোল্যান্ডের এক গুপ্তচর মাইকেল গোলনিউস্কি আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএকে ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে কাজ করা এক রাশিয়ান গুপ্তচরের সম্পর্কে বলে যে ১৯৫২ সালে পোল্যান্ডে ছিল। মাইকেল এই গুপ্তচরের সঠিক নামটা বলতে পারছিলোনা সে হর্টন বা এরকম কিছু একটা বলে। এই খবর সিআইএ এমআই৫কে জানায়। সাথে সাথে এমআই৫ বুঝে যায় এটা হ্যারি হাউটন। এমআই৫ হ্যারি হাউটন ও এথেল গির উপর নজর রাখা শুরু করে। এমআই৫ এর এজেন্টরা দেখতে পায় একদিন হ্যারি হাউটন লন্ডনে এক ব্যাক্তিকে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ দেয় এবং বদলে সেই ব্যক্তি হ্যারিকে একটি খাম দেয়। এমআই৫ গোপনে সেই ব্যক্তির পিছু নিয়ে জানতে পারে ওই ব্যাগে গোপন ক্যামেরা ও ব্রিটিশ নৌবাহিনীর তথ্য রয়েছে এবং ওই ব্যাগের মালিক কোনন মোলোডি। কোনন মোলোডির উপরও নজর রাখা শুরু করে এমআই৫, এর থেকে এমআই৫ কোহেন দম্পতিকেও খুঁজে পায় রাশিয়ান গুপ্তচর হিসাবে। এরই মধ্যে এমআই৫ সিআইএর থেকে খবর পায় পোর্টল্যান্ড স্পাইরিং ব্রিটেন থেকে পালিয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। এই খবর পাওয়ার সাথে সাথে ১৯৬১ সালের ৭ জানুয়ারি লন্ডনের দি ওল্ড ভিক থিয়েটার থেকে গ্রেফতার করা হয় হ্যারি হাউটন, এথেল গি এবং কোনন মোলোডিকে। সেইদিনই গ্রেফতার করা হয় কোহেন দম্পতিকেও। 

১৯৬১ সালের ১৩ মার্চ এই পাঁচ জনের বিরুদ্ধে কোর্টে বিচার শুরু হয়। বিচারে কোনন মোলোডির ২৫ বছর, কোহেন দম্পতির ২০ বছর এবং হ্যারি হাউটন ও এথেল গির ১৫ বছর করে জেলের সাজা হয়। তবে ১৯৬৪ সালে কোনন মোলোডি এবং ১৯৬৯ সালে কোহেন দম্পতিকে বন্দী বদলের মাধ্যমে সোভিয়েত সরকার ফিরিয়ে নিয়ে আসে। শুধুমাত্র হ্যারি হাউটন ও এথেল গিকে তাদের পূর্ন সাজা ভোগ করতে হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published.