কলকাতা ক্লাস যুদ্ধজাহাজের মতো বড় যুদ্ধজাহাজ নৌসেনা আগে কখনও ব্যবহার করেনি
রাজেশ রায়: ভারতীয় নৌসেনায় বর্তমানে সার্ভিসে থাকা অন্যতম সেরা ডেস্ট্রয়ার হচ্ছে কলকাতা ক্লাস। কিছুদিন আগে আরও একটি ডেস্ট্রয়ার লঞ্চ করা হয়েছে যার নাম বিশাখাপত্তনম ক্লাস। তবে এটি নৌসেনায় যুক্ত হবে আগামী বছরের শেষের দিকে। আজ আমরা এই কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ভারতের তিনদিকে বিশাল সাগর, বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর ও ভারত মহাসাগর। এই বিশাল সমুদ্রসীমা পাহাড়া দেওয়ার জন্য দরকার ডেস্ট্রয়ারের মতন স্ট্রাটেজিক ওয়েপনস। ১৯৮৬ সালে ক্যাবিনেট কমিটি অন পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স (CCPA) দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের থেকেও শক্তিশালী একটি ডেস্ট্রয়ার তৈরীর সিদ্ধান্ত নেয়। লক্ষ্য ছিল এই নতুন ডেস্ট্রয়ারের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, অ্যান্টি শিপ, ল্যান্ড অ্যাটাক ও অ্যান্টি সাবমেরিন ক্যাপেবিলিটি অনেক শক্তিশালী হবে। যদিও সেই মহূর্তেই এই ডেস্ট্রয়ার তৈরির কাজ শুরু হয় নি, যাস্ট একটা ডিজাইন করা হয়েছিল। ২০০০ সালে ভারতীয় নৌসেনা এই ডেস্ট্রয়ারের নতুন করে ডিসাইন করে আরও অ্যাডভান্সড করে, স্টেলথ ফিচার যুক্ত করা হয়। শেষপর্যন্ত ২০০০ সালের মে মাসে এই কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ার তৈরির কাজ শুরু হয়, যদিও আসল কনস্ট্রাকশন শুরু হয় ২০০৩ সালে। এই প্রজেক্টের নাম দেওয়া হয় “প্রজেক্ট পি -১৫ এ”. মুম্বাইয়ের মাজগাঁও ডক লিমিটেডে এর কাজ শুরু হয়। ২০০৮ সালে এই প্রজেক্টের খরচ ধরা হয় ৫০০ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩৮০০ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১১ আসতে আসতে খরচ অন্তত ২২৫% বেড়ে হয় ১১,৬৬২ কোটি বা ১.৫ বিলিয়ন ডলার। প্রতিটি কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের দাম দাড়ায় ৩৯০০ কোটি বা ৫২০ মিলিয়ন ডলার। তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এ. কে. অ্যান্টনি জানান যুদ্ধজাহাজের জন্য বিশেষ স্টিল পাঠাতে রাশিয়া দেরী করে, তাছাড়া রাশিয়ান স্পেশালিষ্টদের খরচ বৃদ্ধি এবং যুদ্ধাস্ত্র, সেন্সর তৈরি তে ফান্ডিং দেরী হওয়ায় এই প্রজেক্ট দেরী হয় এবংখরচ বৃদ্ধি পায়।
২০১০ সালের অডিট রিপোর্টে নেভিকে সমালোচনা করা হয়, কারন নেভি সারফেস টু এয়ার মিসাইল বারাক মিসাইল দিয়ে রিপ্লেস করতে দেরী করে, হ্যাল ধ্রুব হেলিকপ্টার রাখার জন্য হ্যাংগার মডিফিকেশন করতে দেরী করে। দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের থেকে ২,৩৬৩ টি আপগ্রেডেশন করে কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ার তৈরি করা হয়েছে। কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের মোট ডিসপ্লেসমেন্ট ৭,৪০০ টন। এত বড় ডেস্ট্রয়ার নেভি আগে কোনদিন অপারেট করে নি। কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ার স্টেলথ ফিচার , মর্ডান ওয়েপনস, ইনফরমেশন ওয়ারফেয়ার সুইট, অক্সোলারি কনট্রোল সিস্টেম যুক্ত অ্যাডভান্সড যুদ্ধ জাহাজ। কলকাতা ক্লাসের মোট তিনটি যুদ্ধজাহাজ তৈরি করা হয়েছে, আইএনএস কলকাতা, আইএনএস কোচি ও আইএনএস চেন্নাই। প্রথম কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ার আইএনএস কলকাতা ২০১৪ সালের ১৬ আগস্ট নেভিতে যুক্ত হয়।
কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ার লম্বায় ১৬৩ মিটার, চওড়ায় ১৭.৪ মিটার। কলকাতা ক্লাসে ইঞ্জিন হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে ৪ টি Zorya Mashproekt DT-59 রিভার্সেবল গ্যাস টার্বাইন ইঞ্জিন। যার প্রত্যেকটি ১৬.৫৫ মেগা ওয়াট শক্তি উৎপন্ন করতে পারে। কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের সর্বচ্চ গতি ৩০ নট বা ৫৬ কিমি/ঘন্টা, রেঞ্জ প্রায় ১১,০০০ কিমি। রেডার হিসাবে কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে রয়েছে ইসরায়েলের EL/M – 2248 MF স্টার এস ব্যান্ড এসা মাল্টি ফাংশান রেডার, সাথে সাথে ফ্রান্সের থ্যালসের তৈরি LW-08 এয়ার সার্চ রেডার ও রয়েছে। অস্ত্র হিসাবে কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে রয়েছে একটি ওটো মেলেরা ৭৬ মিমি নেভাল গান রয়েছে। কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে ৩২ টি ভিএলএস বা ভারটিক্যাল লঞ্চ সিস্টেম রয়েছে যা থেকে ৩২ টি বারাক-৮ মিসাইল ফায়ার করা যায়। এছাড়াও ১৬ টি আলাদা ভিএলএস সিস্টেম রয়েছে যা থেকে ১৬ টি ব্রাহ্মস মিসাইল ফায়ার করা সম্ভব। শর্ট রেঞ্জের জন্য চারটি একে- ৬০৩ গান রয়েছে, ২ টি আরবিইউ – ৬০০০ অ্যান্টি সাবমেরিন রকেট লঞ্চার রয়েছে। এছাড়াও কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে ৪ টি ৫৩৩ মি মি টর্পেডো টিউব রয়েছে। কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে ২ টি ধ্রুব হেলিকপ্টার রয়েছে।
একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখবেন কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে অনেক কম মিসাইল সিস্টেম রয়েছে। কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের মতই চীনের টাইপ ০৫২ ডি ডেস্ট্রয়ারে ৬৪ টি ভিএলএস সিস্টেম রয়েছে সেখানে কলকাতা ক্লাসে ৩২+১৬ টি ভিএলএস রয়েছে। যদি কলকাতা ক্লাসের গঠন ভাল ভাবে দেখেন বুঝতে পারবেন সামনে ও পেছনে অনেক ফাঁকা জায়গা রয়েছে, যাতে আরও ভিএলএস সিস্টেম ইনস্টল করা যাবে। বর্তমানে কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে ১৬ টি ব্রাহ্মস টিউব আছে, মডিফিকেশনের পর আরও ১৬ টি টিউব যুক্ত করা সম্ভব। তাহলে কেন এত জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে? দেখুন ভারতীয় নেভির স্ট্রাটেজি হচ্ছে ভবিষ্যতে যখন নতুন টেকনোলজি আসবে তখন এই যুদ্ধজাহাজে সেটা ইনস্টল করা হবে। যেমন দেখুন বর্তমানে কলকাতা ক্লাসে যে ব্রাহ্মস মিসাইল ব্যবহার করা হয় তার রেঞ্জ ২৭০ কিমির মতন, বর্তমানে ব্রাহ্মসের অ্যাডভান্সড ভার্সনের উপর কাজ চলছে যা সাইজে এবং ওজনে বর্তমান ব্রাহ্মসের প্রায় অর্ধেক। এর রেঞ্জ ৬০০ কিমি প্রায়। পুরো আপগ্রেডেশন পর কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে আরও ১৬ টি ব্রাহ্মস মিসাইল টউব যোগ করা যাবে অর্থাত মোট ৩২ টি ব্রাহ্মস টিউব হবে যার প্রতিটি থেকে মোট দুটি করে অর্থাৎ টোটাল ৬৪ টি ব্রাহ্মস এনজি ফায়ার করা যাবে। আবার বর্তমানে কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে বারাক-৮ মিসাইল ব্যবহার করা হয় যার রেঞ্জ ৫০-৬০ কিমি, এক্সটেন্ডেড রেঞ্জের আপগ্রেডেড বারাক-৮ দিয়ে ভবিষ্যতে এগুলো রিপ্লেস করা হবে যার রেঞ্জ প্রায় ১৫০ কিমি। প্রথমেই কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে সমস্ত ভিএলএস সিস্টেম ইনস্টল করা হলে এই আপগ্রেডেশন করা যেত না ভবিষ্যতে। প্রতি পাচ বছর অন্তর কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে আপগ্রেডেশন করা হবে বলে টার্গেট নেওয়া হয়েছে।
কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে চার মিলিয়ন বা চল্লিশ লক্ষ লাইন অফ কোড ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ ব্যাটেল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তৈরির জন্য। এই সিস্টেম আশেপাশের সমস্ত হুমকিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করে তার সম্পর্কে তথ্য পাঠায়। এই স্মার্ট সিস্টেম সেই থ্রেট কাউন্টার করার জন্য কী যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করবে সেই বিষয়েও তথ্য পাঠায়। এই কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ার পুরো পাকিস্তান নেভিকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট।
বর্তামানে কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের থেকেও শক্তিশালী বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ার তৈরি করা হয়েছে।