ব্রিটিশ সরকারের রাতের ঘুম কেড়েছিল বাংলার যে অগ্নিকন্যা
নিউজ ডেস্কঃ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে পুরুষদের পাশাপাশি অনবরত লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন ভারতীয় নারীরা। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শত অত্যাচারের পরও হার মানেননি ইংরেজদের কাছে। তাদের মধ্যে এই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অকুতোভয় যোদ্ধা ছিলেন কল্পনা দত্ত। কল্পনা দত্ত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় এবং ইংরেজদের কাছে আতঙ্কের একটি নাম ছিল।
১৯১৩ সালের ২৭শে জুলাই চট্টগ্রাম জেলার শ্রীপুর অঞ্চলে বোয়ালখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কল্পনা দত্ত। তার পিতার নাম বিনোদবিহারী দত্ত এবং মাতার নাম শোভন বালা দত্ত। ডাক্তার দুর্গাদাস দত্ত চট্টগ্রামের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি তিনি ছিলেন কল্পনা দত্তের ঠাকুরদা। তাকে যথেষ্ট সম্মান দিতেন ইংরেজ প্রশাসনও। এইকারনে পুলিশের নজরের বাইরে ছিল তাদের বাড়ি। ছোটবেলা থেকে বাকি মেয়েদের থেকে আলাদা ছিল কল্পনা। অত্যন্ত ভাবপ্রবণ এবং স্পর্শকাতর মানসিকতা ছিল তার। তাকে দুঃখী মানুষের দুঃখের কাহিনী ব্যথিত করত। শৈশবকালে স্বপ্ন দেখতেন সকলকে নিয়ে এক সুখী সমাজের।
মাত্র ১২ বছর বয়স থেকে তার মনের মধ্যে জাগ্রত হতে থাকে স্বদেশের ভাবনা। নানা ধরনের স্বদেশী বই পড়তে আগ্রহী ছিলেন তিনি। বিপ্লবীদের জীবনী, ‘পথের দাবী’এই ধরনের স্বদেশী বই পড়তে পড়তে তার মনের মধ্যে জাগ্রত হয় যে দেশকে স্বাধীন করতে হলে সরাতে হবে ব্রিটিশ সরকারকে। তাহলেই দেশ হবে স্বাধীন দূর হবে দেশের দুঃখ। তার ছোট কাকা তাকে সব সময় অনুপ্রেরণা দিতেন একজন আদর্শ দেশ সেবিকা রূপে গড়ে ওঠা। ধীরে ধীরে তার আগ্রহ বাড়ে দুঃসাহসিক কাজের সাথে জড়িত হওয়ার প্রতি।
কল্পনা পড়াশোনায় বেশ মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত ছিলেন। ১৯১৯ সালে চট্টগ্রামের খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ওই সময় মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। আইএ প্রথম বর্ষে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হন কলকাতার ঐতিহ্য সম্পন্ন বেথুন কলেজে। কলেজে পড়াকালীন সময়ে গ্রহণ করেন রাজনৈতিক জীবনকেই তার আদর্শ হিসাবে। কলেজে পড়াকালীন সময়ে জড়িত হন নানা ধরনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সাথে। বিপ্লবের আদর্শ উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বেথুন কলেজে গড়ে ওঠা ছাত্রী সংঘে যোগ দেন। এর ফলে তিনি অংশগ্রহণ করতে বেথুন কলেজে ছাত্রীদের উদ্যোগে সংঘটিত হওয়া হরতাল পালন এবং অন্যান্য আন্দোলনে।
নিজেকে বিপ্লবী হিসাবে প্রস্তুত করার জন্য স্কলারশিপের টাকায় সাইকেল কিনে কারোর ঘুম ভাঙার আগে ভোরবেলায় কলেজে ক্যাম্পাসের মধ্যে শুরু করেন সাইকেল চালানো অভ্যাস। এমনকি প্রতি রবিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এ গিয়ে অভ্যাস করতেন নৌকা চালানো। ওই সময় পুর্নেন্দু দস্তিদার যিনি ছিলেন বিপ্লবী সূর্য সেনের অনুরাগী তার মাধ্যমে তার সাথে সূর্য সেনের পরিচয় হওয়ার পরে তিনি যোগদান করেন মাস্টার দা প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখায়। দলের সদস্য হিসাবে কল্পনা নিজের পড়ার ঘরে বসে বোমার জন্য তৈরি করতেন গান-কটন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার ১৯৩০ সালে ১৮ই এপ্রিল লুণ্ঠন হয়। লুণ্ঠন পরবর্তী সময়ে বিপ্লবী কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন কল্পনা। চট্টগ্রামে চলে আসেন তিনি। তিনি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের মাধ্যমে সূর্য সেনের সাথে সাক্ষাৎ করতে। এরপর কল্পনার সাথে মাস্টার দার সাক্ষাৎ হয় ১৯৩১ সালের মে মাসে।
কল্পনা ডিনামাইট ষড়যন্ত্রে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি কলকাতা থেকে ফেরার সময় কিছু বিস্ফোরক গোপনে নিয়ে আসেন এছাড়াও গোপনে তৈরি করেছিলেন গান কটনও। সেগুলি জেলের ভিতরে চলে যেত। কল্পনা দত্তের মাধ্যমে যোগাযোগ হত চট্টগ্রাম জেলে অনন্ত সিং প্রমুখের সাথে। সেই সময় তিনি বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের বিচার ও সাজা আটকানোর জন্য পরিকল্পনা করেছিলেন কোট এবং জেলে ডিনামাইট দ্বারা বিস্ফোরণের । এর ফলে যেন পালাতে পারে বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ।
তবে ১৯৩১ সালের ফাঁস হয়ে যায় ডিনামাইট ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা। সরকার কল্পনা দত্তকে সন্দেহ করে তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের উপর আদেশ দেয়। সরকার অনুমতি দেয় চট্টগ্রাম কলেজে গিয়ে বিএসসি পড়ার কিন্তু বন্ধ করে তার অন্যত্র যাতায়াত। সেই সময় তিনি অনেক বার রাত্রে পালিয়ে গ্রামে চলে যেতেন এবং দেখা করতেন সূর্যসেন নির্মল সেনের সাথে। সেই সময় মাস্টারদার সাথে গ্রামে ঘুরে ঘুরে খবর নিতেন গ্রামের মানুষের সুখ দুঃখের। শেখেন বন্দুক চালানোও।