অ্যামেরিকা

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি। তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের রূপ নিতে পারত। কত সালে এমন ঘটেছিল জানেন?

রাজেশ রায়:— ১৯৬২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর এই ১৩ দিন বিশ্ব এমন এক ভয়ানক ঘটনার সাক্ষী ছিল যা হয়ত ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনত। এই ১৩ দিনে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল যা নিশ্চিত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের রুপ নিতে চলেছিল, তবে এই বিশ্বযুদ্ধ হলে নিশ্চিত ভাবেই পরমানু অস্ত্র ব্যবহার হত। ১৯৬২ সাল মনে হলেই হয়ত ভারত চীন যুদ্ধের কথা মনে হবে কিন্তু এর থেকেও বড় ভূরাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল। ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের একটি ছোট দেশ কিউবাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সময়ের দুটি সুপার পাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল যা তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের রূপ নিচ্ছিল। 

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর ব্রিটিশদের ক্ষমতা অনেক কমে যায় কারন যুদ্ধে ব্রিটেন পুরো বিধ্বস্ত হয়ে গেছিল। সেসময় বিশ্বে দুটি সুপার পাওয়ার থাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, এদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়। দুই দেশই পরমানু শক্তিধর হওয়ায় সরাসরি যুদ্ধ সম্ভব নয় সেজন্য অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা, মহাকাশ সব সেক্টরে দুই দেশ একে অপরকে টেক্কা দেবার চেষ্টা করত। দুই দেশই বিশ্বের বাকী দেশ গুলোর উপর প্রভাব বিস্তার করতে চেষ্টা করত। ভারত সহ বেশ কীছু দেশ কোন জোটেই যোগ না গিয়ে নিরপেক্ষ ছিল। যদি কিউবার অবস্থান লক্ষ করা হয় তাহলে উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিন আমেরিকার মধ্যে একটি ছোট দ্বীপ হচ্ছে কিউবা। আমেরিকার ফ্লোরিডা থেকে কিউবার দুরত্ব মাত্র ৯০ মাইল। আমেরিকার এত কাছে অবস্থিত হয়েও কিউবাকে সমর্থন করত সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৬২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিল নিকিতা খ্রুশেভ, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিল জন এফ কেনেডি এবং কিউবার প্রধান ছিল ফিদেল কাস্ত্রো। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাকে সমর্থন করত কারন কিউবাতে কমিউনিজম ছিল। আমেরিকা প্রথম থেকেই গনতন্ত্রের সমর্থক সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিজম সমর্থন করে। আমেরিকা প্রথম থেকেই কমিউনিজমের বিরোধী সুতরাং কিউবা নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়। যখন ইউরোপীয়ানরা গোটা বিশ্বে নিজেদের কলোনী তৈরি করছিল তখন কিউবাও বাদ যায়নি। কিউবা স্পেনের অধীনে চলে যায়। পরে বিদ্রোহের কারনে স্পেন কিউবা ছেড়ে দেয় এবং কিউবার দায়িত্ব আমেরিকাকে দিয়ে যায় ১৮৯৮ সালে। শেষ পর্যন্ত ১৯০২ সালে কিউবা পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু ১৯৫৩ আসতে আসতে কিউবার পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। 

কিউবাতে ১৯৫৩ সালে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। মূলত কিউবাতে গনতন্ত্র থাকবে নাকী কমিউনিজম থাকবে সেই নিয়ে লড়াই শুরু হয়। ফিদেল কাস্ত্রো ছিল কমিউনিজমের সমর্থক। গনতন্ত্রপন্থীদের আমেরিকা সহায়তা করছিল। আমেরিকা বারবার কিউবাতে আক্রমন করছিল কিন্তু প্রতিবার তা ব্যার্থ হয়ে যাচ্ছিল কারন ফিদেল কাস্ত্রোর মজবুত সেনা ছিল এবং কিউবার অধিকাংশ মানুষ ফিদেল কাস্ত্রোকে সমর্থন করত। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ শেষ হয় ১৯৫৯ সালে এবং ফিদেল কাস্ত্রো কিউবার প্রধানমন্ত্রী হয়। ১৯৫৯-৭৬ অবধি ফিদেল কাস্ত্রো কিউবার প্রধানমন্ত্রী ছিল। ১৯৭৬ সালে কিউবাতে নতুন সংবিধান আসে এবং ১৯৭৬-২০০৮ অবধি ফিদেল কাস্ত্রো কিউবার রাষ্ট্রপতি হয়। 

ফিদেল কাস্ত্রোর প্রধানমন্ত্রী হবার পরও ১৯৬১ আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ এর নেতৃত্বে কিউবাতে পিগস ইনভেশন নামে একটি বিদ্রোহ করা হয় কিন্তু তাও ব্যার্থ হয়ে যায়। তবে আমেরিকা কিউবাতে কখনও সরাসরি আক্রমন করেনি, যদি করত তাহলে হয়ত কিউবার পতন হয়ে যেত। এখানে আরও একটি কথা বলা দরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হবার পর জার্মানিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। পূর্ব জার্মানি যা সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে চলে যায় এবং পশ্চিম জার্মানি আমেরিকার অধীনে আসে। জার্মানির রাজধানী বার্লিনে একটি দেওয়াল তৈরি করা হয় যাকে বার্লিন প্রাচীর বলা হয়। স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব জার্মানিতে কমিউনিজম এবং পশ্চিম জার্মানিতে গনতন্ত্র ছিল। ১৯৫৩ সালে জোসেফ স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন রাষ্ট্রপতি হয় নিকিতা ক্রুশ্চেভ এবং ১৯৬১ সালে জন এফ কেনেডি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হয়। নিকিতা ক্রুশ্চেভের মনে হয়েছিল কেনেডি একটু দুর্বল প্রকৃতির মানুষ সেজন্য কিউবা সমস্যা সমাধানের এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। আগেই বলেছি কিউবা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অনেক দূরে বরং আমেরিকার কাছে অবস্থিত। সেজন্য সরাসরি আমেরিকার কিউবাতে আক্রমনে সম্ভবনা ছিল। সেজন্য নিকিতা ক্রুশ্চেভ দুটি পরিকল্পনা ঠিক করে। প্রথমত কিউবাতে মিসাইল মজুত রাখবে যাতে আমেরিকা চাপে থাকবে এবং পশ্চিম জার্মানিও নিজেদের অধিকারে নিয়ে নেবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সেসময় নিজেদের অস্ত্র সম্পর্কে অনেক বাড়িয়ে প্রচার করত কিন্তু আদতে তাদের মিসাইল এতটাও শক্তিশালী ছিলনা। পরমানু মিসাইলের একটি ভার্সন হচ্ছে আইসিবিএম বা ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল যার অর্থ এক দেশ থেকে অন্য দেশে পরমানু হামলা। যেমন ভারতের আছে অগ্নি ৫ মিসাইল। আইসিবিএম তিন ধরনের হয় স্বল্প দূরত্বের, মাঝারি দূরত্বের এবং দীর্ঘ দূরত্বের। নিকিতা ক্রুশ্চেভ জানত তাদের দীর্ঘ দূরত্বের আইসিবিএ ততটা কার্যকারী নয়, হয়ত সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে লঞ্চ করলে আমেরিকা অবধি পৌঁছাবেইনা। সেজন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন মাঝারি দূরত্বের আইসিবিএম কিউবাতে রাখার পরিকল্পনা করে।

আমেরিকাও সোভিয়েত ইউনিয়নকে কাউন্টার করার জন্য তুরস্ক ও দক্ষিন ইটালিতে তার মিসাইল রেখেছিল, তাই এর বদলা নিতে সোভিয়েত ইউনিয়নও কিউবাতে মিসাইল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৬২ সালের মে মাসে ফদেল কাস্ত্রো ও নিকিতা ক্রুশ্চেভের মধ্যে এব্যাপারে আলোচনা হয়। নিকিতা ক্রুশ্চেভ চাইছিল যাতে এব্যাপারে আমেরিকা যেন জানতে না পারে কিন্তু ২৯ আগস্ট আমেরিকার ইউ ২ গোয়েন্দা বিমান এব্যাপারে পুরো রিপোর্ট দেয় আমেরিকাকে। ১৯৬২ সালের ১৪ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবার নয়টি জায়গায় তাদের পরমানু মিসাইল ইনস্টল করে। ছয়টি জায়গায় আর-১২ এবং তিনটি জায়গায় আর-১৪ মিসাইল ইনস্টল করা হয়। এরপর আমেরিকার কাছে তিনটি পথ খোলা ছিল প্রথমত কোন কীছুই না করা, দ্বিতীয়ত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে কুটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে মিসাইল সরিয়ে নেওয়া এবং তৃতীয়ত পুরো কিউবাতে আক্রমন করা, এয়ার স্ট্রাইক করা। কিন্তু জন এফ কেনিডি জানত তৃতীয় পথ অবলম্বন করলেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। বলা হয় ফিদেল কাস্ত্রো রাজি ছিলনা সোভিয়েত ইউনিয়নের এই প্রস্তাবে। ফিদেল কাস্ত্রো চাইত বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক, শেষ অবধি আমেরিকার আক্রমনের ভয়ে ফিদেল কাস্ত্রো রাজি হয়।

সেপ্টেম্বরেই আমেরিকা সন্দেহ করছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন কীছু করতে চলেছিল কারন সোভিয়েত জাহাজ প্রায়ই কিউবাতে আসছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন বারবার জানাচ্ছিল তারা কিউবাতে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করছে কিন্তু আদতে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাহাজে করে মিসাইল নিয়ে আসছিল। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন জাহাজকে আটকে যদি আমেরিকা তল্লাশি করত তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত। ১৫ অক্টোবর আমেরিকা নিশ্চিত হয়ে যায় কিউবাতে পরমানু মিসাইল রাখা হয়েছে। জাতিসংঘেও এই কথা বলা হয় কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন শেষ অবধি এই তথ্য স্বীকার কর ছিলনা।

১৬ অক্টোবর কিউবা মিসাইল সংকটের উপর বিশেষ এক বৈঠক হয় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির নেতৃত্বে। সেখানে প্রস্তাব দেওয়া হয় আটলান্টিক মহাসাগর হয়ে কিউবাতে আসা সোভিয়েত জাহাজকে আটকে দেবার জন্য কিন্তু জন এফ কেনেডি প্রস্তাবে না করে দেয় কারন এর অর্থ ছিল যুদ্ধ। ১৮ অক্টোবর আমেরিকার অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডি সোভিয়েত বিদেশমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমেইকোর সাথে বৈঠক করে। ১৯ অক্টোবর আবারও একটি বৈঠকে ব্লকেড মানে সোভিয়েত ইউনিয়নের জাহাজকে আটকাবার কথা বলা হয়। ২২ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি কেনেডি একটি বিখ্যাত ভাষনে বলে সোভিয়েত জাহাজ কিউবাতে আসতে দেওয়া হবেনা, সাথে এটাও বলে কিউবা থেকে পশ্চিমা দেশ গুলোর উপর কোন মিসাইল হামলা হলে তা আমেরিকার উপর হয়েছে বলে ধরা হবে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেওয়া হবে। এই কথা শুনে নিকিতা ক্রুশ্চেভ কিছুটা ঘাবড়ে গেছিল। ২৩ অক্টোবর কিউবা থেকে ৭৫০ মাইল দূরে সোভিয়েত জাহাজকে আটকে দেওয়া হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকিতা ক্রুশ্চেভও জাহাজ গুলোকে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়। এদিকে আমেরিকা তার একের পর এক বিশেষ বিমান কিউবায় পাঠাতে থাকে এবং আমেরিকার মিলিটারি হেডকোয়ার্টারে কিউবা আক্রমনের পরিকল্পনা তৈরি করা হতে থাকে। এর মধ্যে কুটনৈতিক ভাবে সমস্যা সমাধানের অনেক চেষ্টা করা হয় কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনও স্বীকার করেনি মিসাইল আছে। তবে আমেরিকার যুদ্ধ প্রস্ততি দেখে নিকিতা ক্রুশ্চেভ আমেরিকার সামনে মিসাইল সরানোর জন্য  দুটো প্রস্তাব রাখে প্রথমত কিউবাতে কখনও আক্রমন করবেনা আমেরিকা এবং দ্বিতীয়ত আমেরিকাকে তুরস্ক ও দক্ষিন ইটালি থেকে মিসাইল সরাতে হবে। জন এফ কেনেডি প্রথম প্রস্তাব মেনে নিলেও দ্বিতীয় প্রস্তাব মানেনি। তবে বলা হয় গোপন ভাবে আমেরিকা এই প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল যার জন্য ২৮ অক্টোবর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসাইল কিউবা থেকে সরাতে শুরু করে, অন্যদিকে আমেরিকাও তুরস্ক ও ইটালি থেকে তাদের মিসাইল সরিয়ে নেয়। কিউবার এই মিসাইল সংকটে চীন পুরোপুরি সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমর্থন করেছিল কারন চীন নিজেও কমিউনিস্ট দেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.