কাশ্মীরে উত্তেজনার পেছনে শুধু মাত্র পাকিস্তানকে দোষ দেওয়া হয় কেন জানেন?
নিউজ ডেস্কঃ কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ঝামেলা নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই বারংবার ঝামেলায় জড়িয়েছে এই দুই দেশ। কাশ্মীরে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য অবশ্য শুধুমাত্র পাকিস্তানকে দায়ী করা যায়না। খানিকটা দায় অবশ্যই চীনেরও। আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন কাশ্মীর নিয়ে চীনের যাবতীয় উপদেশ মেনে চলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আজ ইতিহাসের সেই অধ্যায়ের গল্পই শোনাবো আপনাদের।
১৯৬৫ সালের মে মাসের শুরুতে, পাকিস্তানের জেনারেল স্টাফের ভাইস চিফ মেজর জেনারেল আবিদ বিলগ্রামী, কর্নেল সৈয়দ গাফফার মেহেদীকে মুরিতে মেজর জেনারেল আখতার মালিকের কাছে এক রিপোর্ট পেশ করার নির্দেশ দেন। পাকিস্তানের সেরা জেনারেলদের মধ্যে একজন হিসাবে পরিচিত জিওসি পরিকল্পনা করেন যে পাকিস্তানি সৈন্য এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সমন্বয়ে মুজাহিদীন নামক একটি দল গঠন করা হবে যাদের এসএসজি (স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ) এক বিশেষ প্রশিক্ষণ দেবে । প্রশিক্ষণ শেষে এই স্বেচ্ছাসেবকরা কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করে এক গণ অভ্যুত্থান তৈরীর চেষ্টা করবে যাতে সামনাসামনি কোনো রকম যুদ্ধ বা প্ররোচনা ছাড়াই ভারত পাকিস্তানের সাথে এক সম্মেলনের টেবিলে বসতে বাধ্য হয়। মালিক ওই একই বছরের জুলাই মাসের শেষের দিকে মুজাহিদিনদের ভারতে পাঠানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বললে তা শুনে সেই সময় বেশ হতবাকই হয়েছিলেন মেহেদি। তার মতে ‘পরিকল্পনাটি এতটাই শিশুসুলভ এবং এতটাই উদ্ভট ছিল যে বিশ্বের যে কোনও জায়গার যৌক্তিক, যোগ্য এবং পেশাগতভাবে শক্তিশালী সামরিক ব্যক্তিদের কাছে তা অগ্রহণযোগ্য বলেই মনে হবে।’
মেহেদী পরবর্তীকালে জানিয়েছেন যে তিনি সেই সময় জেনারেল আখতার মালিককে অকপটে বলেছিলেন অপারেশনটি একেবারেই ননস্টার্টার । একই সাথে তিনি চিফ এবং ভাইস চিফ অফ জেনারেল স্টাফকেও সেই একই পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু মালিক তাকে জোর করছিলেন যাতে তিনি নিজস্ব কিছু SSG অফিসারকে নিযুক্ত করেন “মুজাহেদিন” এর তাৎক্ষণিক কিছু প্রশিক্ষণের জন্য। মেহেদী পরে স্বীকার করেছেন “ব্রিফিংয়ের জন্য সেদিন আমার তিনজন কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়েছিলাম আমি। তাদেরকে আমি জেনারেল মালিকের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং তাদের দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে বাকি চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে তারা যেনো তাদের সেরাটা করে দেখাতে পারে।”
একথা স্পষ্ট যে কচ্ছের রনের ঘটনার পর থেকে আইয়ুব খানের চিন্তাধারায় পরিবর্তন এসেছিল বেশ অনেকটাই। সত্যি বলতে চেইন অফ কমান্ডের কেউই তার বিরুদ্ধে যেতেও রাজি ছিল না। মুসা দাবি করেছেন যে তিনি বারংবার কাশ্মীর উপত্যকায় গেরিলা বাহিনীর অভিযানের বিরোধিতা করে চললেও ‘সর্বোচ্চ কমান্ডার’-এর বিরোধিতা করার বা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস একেবারেই ছিলো না মুসার। তাই আইয়ুব খান যখন সম্মত হন যে কাশ্মীরের গভীরে অভিযান চালানো যেতে পারে এবং তার জন্য তিনি একটি নতুন পরিকল্পনা বা এর ফলে সম্ভাব্য ফলাফল ও পরিস্থিতি সমর্কে জানতে চাইলে মুসা কোনো রকম প্রতিবাদ না করে ১২ ডিভিশনের কমান্ডার, মেজর জেনারেল আখতার হোসেন মালিককে গোটা অপারেশনের পরিকল্পনা সম্পর্কে একটি খসড়া প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন। যার কোডের নাম ঠিক করা হয়- “GIBRALTAR”। এই অপারেশনের যাবতীয় খুঁটিনাটি পর্যালোচনার পর GHQ এর সাথে পরামর্শ করা হলে পরিকল্পনায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনার পর কাশ্মীরে অপারেটনটিকে অনুমোদন প্রদান করা হয়।
১৯৬৫ সালের ১৩ মে আইয়ুব খানের হঠাৎ এই মন পরিবর্তনের কারণ ঠিক কী? উল্লেখ্য কাশ্মীরে অভিযান চালানোর একমাত্র কারণ হিসাবে কচ্ছের রনের ‘সাফল্য’এর দিকে নির্দেশ করা হলে তা হবে মানুষটির বুদ্ধিমত্তাকে সম্পূর্ণভাবে অপমান করা। কারণ রণের যুদ্ধকে কোনো ভাবেই ঠিক সামরিক অভিযান বলা চলে না এবং প্রকাশ্যে তিনি যায় বলুন না কেন একজন প্রাক্তন প্রধান হিসাবে ওই হামলার সত্য তিনি নিজেও খুব ভালো ভাবেই জানতেন। আইয়ুব খানের সামনে অধিকৃত কাশ্মীরে কোনো অভিযান চালানোর প্রস্তাব রাখা হলেই তার প্রথম প্রশ্ন সব সময় ছিলো একটিই। আর তা হলো পাকিস্তানের এই অভিযান কি কোনো ভাবে ভারতকে সরাসরি পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের ময়দানে নামতে বাধ্য করবে? যদি প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হতো তবে পরিকল্পনাটি সঙ্গে সঙ্গে অন্য কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়াই বাতিল করে দিতেন তিনি। উল্লেখ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ২৮ এপ্রিল ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে পাকিস্তান যদি তাদের আগ্রাসী তৎপরতা অব্যাহত রাখে তাহলে ভারতীয়রা এবার পাকিস্তানের কোথায় এবং কখন আঘাত হানবে তা বেছে নিতে বাধ্য হবে।
মার্কিন সূত্রের খবর, কাশ্মীর সেল প্রথম আইয়ুবের কাছে পরিকল্পনাটি উপস্থাপন করেছিল ১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। পরিকল্পনা শোনা মাত্রই তিনি স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সেই পরিকল্পনা। তিনি সরাসরি বলেন “কে পররাষ্ট্র দপ্তর এবং আইএসআই (ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেট) কে এমন একটি পরিকল্পনা তৈরি করার অনুমোদন দিয়েছে? আমি তাদের শুধু কাশ্মীরের পরিস্থিতির দিকে চোখ রাখতে বলেছি। তারা সরকারকে কোনো রকম সামরিক অভিযান চালাতে বাধ্য করতে পারে না।” ভুট্টো এবং তার দল অবশ্য হাল ছেড়ে দেয়নি, কারণ তারা বিশ্বাস করতেন ভারতের ওপর পাকিস্তানের হামলা চালানোর যোগ্য সময় এটাই। পাকিস্তানী সেনার সংখ্যা কম হলেও গত এক দশকে মার্কিন সামরিক সহায়তা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনী আগের তুলনায় যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলো ফলে, তাদের বিশ্বাস ছিলো সংখ্যা কম হলেও ঠিকই এবার জয়লাভ করবে তারা। ভুট্টোও বারবার যুক্তি দিয়েছিলেন যে ভারতের বৃহত্তর অর্থনৈতিক শক্তির সামনে পাকিস্তানের কাশ্মীর পরিকল্পনা ভেঙ্গে পড়া কেবল এক সময়ের অপেক্ষা। মে মাসে, আইয়ুব খানের কাশ্মীরে সরাসরি সশস্ত্র হস্তক্ষেপের বিপক্ষে ভুট্টো পুনরায় তাকে একটি চিঠি লিখে বলেছিলেন, ‘মান ও সরঞ্জামের দিক থেকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বর্তমানে আপেক্ষিক ভাবে আগের চেয়ে উন্নত হলেও ভারতের প্রতিরক্ষা বিল্ড আপের ক্রমশ উন্নতির সাথে সাথে পাকিস্তানের ঝুঁকি ও ক্রমশ বাড়বে’।
এমন এক পরিস্থিতি যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছিলো এক অত্যন্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার সেখানে একবার ভুট্টো আইয়ুব খানকে আশ্বাস দিয়ে জানিয়েছিলেন যে ভারত যুদ্ধ কেবলমাত্র কাশ্মীরেই সীমাবদ্ধ রাখবে ফলে, পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যেতে কোনো রকম সমস্যা হবে না। কিন্তু এক্ষেত্রে ওঠে কতগুলো প্রশ্ন: কে ভুট্টোকে এই গ্যারান্টি দিয়েছিল যে যাই হোক না কেনো, ভারতীয়রা শুধুমাত্র জম্মু ও কাশ্মীরে তাদের যুদ্ধ সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হবে? উত্তরটি সম্ভবত জড়িয়ে চীনের সাথে বা আরও সঠিকভাবে বললে, মাও সেতুং এবং ঝো এনলাইয়ের সাথে। যারা উভয়েই ভারত সম্পর্কে, বিশেষ করে কাশ্মীর সম্পর্কে পাকিস্তানের পদক্ষেপ কি হওয়া উচিত বা ভারতের মোকাবিলা কিভাবে করা সম্ভব তা নিয়ে পাকিস্তানী নেতাদের সাথে নিজেদের অভিজ্ঞতা এবং পরিকল্পনা ভাগ করে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এক বৈঠকে চীনের তৎকালীন চেয়ারম্যান মাও স্পষ্ট জানান: ‘দেখুন, হাতে দশটি আঙুল আছে এবং আপনি যদি দশটি আঙ্গুলের ওপরেই আঘাত করেন তবে সাময়িক কষ্ট হলেও কয়েক মিনিটের মধ্যে তারা আবার নিজেদের পুরোনো স্থিতিতে ফিরে যাবে। কিন্তু, আপনি যদি কেবল একটি আঙ্গুল সম্পূর্ণরূপে কেটে ফেলেন তবে সেই ক্ষতি বাকি সকলের চোখে পড়বে এবং এক দুর্বলতার সৃষ্টি হবে। ভবিষ্যতে, ভারতের দুর্বলতার একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে মনোনিবেশ করুন এবং সেটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে আক্রমণ শুরু করুন। শীঘ্রই দেখবেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যাবে এবং তারা পলাতক হবে। ঠিক যেমন ১৯৬২ সালে, চিনা সেনাবাহিনীর সামনে ভারত ময়দান ছাড়তে বাধ্য হয়।”
ভুট্টোর পিএলএ হ্যান্ডলারদের সঙ্গে মিলিত হয়ে দুই চীনা নেতা তাকে আস্কারা দেওয়ার সাথে সাথে বারংবার এই আশ্বাসও দিচ্ছিলেন যে ভারত যদি কখনো প্রতিশোধ নিতে চায় বা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তবে চীন সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ফ্রন্টে আক্রমণ চালাবে। প্রথম থেকেই চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষকে কেন্দ্র করেই। চিন ও পাকিস্তানের নিজেদের মধ্যেও ছিলো বেশ কিছু সীমান্ত সমস্যা। তবে, ১৯৬২ সালে লাদাখে ভারতের সাথে চীনের সংঘর্ষ এবং NEFA চোখ খুলে দিয়েছিল তাদের। চিন এবং পাকিস্তান বুঝতে পারে যে দুই দেশের মধ্যে এক কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে উঠলে তা উভয় পক্ষের জন্যই হবে মঙ্গলজনক। তাই, নিজেদের সীমান্ত সমস্যা সমাধানের সিদ্ধান্ত নেই তারা। বৈদেশিক নীতির অন্তর্ভুক্ত এটি এমন এক সম্পর্ক যা মূলত গোয়েন্দা পরিষেবাগুলির নজরদারিতে পিএলএ দ্বারা পরিচালিত হয়। সেই সময়ের চীন-পাকিস্তান অক্ষ সম্পর্কিত নথিপত্র অ্যাক্সেস করা এতটা কঠিন ঠিক এই কারণেই।
এত গোপনীয়তা সত্ত্বেও এমন বেশ কিছু মন্তব্য রয়েছে যা সত্যকে আলোয় নিয়ে আসে। কমিউনিস্ট পার্টির ওপর তলার নেতা ঝু, আইয়ুবের ছেলেকে বলেছিলেন “রাষ্ট্রপতিকে বলুন। পাকিস্তানকে যে করেই হোক কাশ্মীর দখল করতে হবে আর সেই জন্য যাবতীয় সমর্থন দিতে প্রস্তুত চিন। কাশ্মীরের উত্তরে মোতায়েন রয়েছে আমাদের সৈন্য। তারা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত এবং কাশ্মীর পুনর্দখলে ব্যবহার করা যাবে তাদের। তবে,প্রথমে গুলি ছুড়বেন না। কাশ্মীরের জন্যে সৈন্যের প্রয়োজন হলে লিখিত ভাবে অনুরোধ করুন।”
আইয়ুব খান, মত পরিবর্তনের পর নিজের সামরিক কমান্ডারদের কথাও শুনতে রাজি ছিলেন না বরং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাশ্মীর সেলের মত মেনে নিয়ে চলাটাই বেশি পছন্দ ছিলো তার। পাকিস্তানের পরিকল্পনায় চীনারা এতটাই আগ্রহী ছিল যে আইয়ুব খান সরাসরি চীনের প্রধানমন্ত্রী ঝো এনলাইয়ের সাথে মিলিত হয়ে ভারতের সাথে যুদ্ধে তিনি ঠিক কি কি কৌশলগত পদ্ধতি এবং উপায় অবলম্বন করতে চান সে বিষয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছুক ছিলেন। জেনারেল মুসা পরবর্তীকালে বেশ নিরুপায় হয়েই স্বীকার করেছেন: ‘আমাকে এই বিষয়ে নিজস্ব মতামত জানানোর কথা বলা হয়েছিল, কারণ প্রেসিডেন্ট তার আসন্ন পাকিস্তান সফরের সময় মিঃ চৌ এনলাইয়ের সাথে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন।’
উক্ত পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে, পাকিস্তান এই পরিকল্পনাকে আকার দেওয়ার জন্য বিশ্বাস রেখেছিলো সেদেশের এক বিশ্বস্ত এবং সাহসী জেনারেলের ওপর। বলা হয়েছিলো: ”কাশ্মীরিও মে আজাদি কি লাগান পয়দা কি জায়ে’ অর্থাৎ কাশ্মীরি জনগণের মনে স্বাধীনতার আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হোক। জেনারেল আখতার হুসেন মালিক এবং তার চারজন সেক্টর কমান্ডার কাশ্মীরে অনুপ্রবেশকারী একটি ‘গোপন বাহিনী’ গঠনের ব্লুপ্রিন্ট তৈরীর কাজ শুরু করে যারা জম্মু – কাশ্মীরে প্রবেশ করে সেখানকার জনগনকে ভারতের বিরুদ্ধে তাতিয়ে তুলে রাজ্যটিকে চিরকালের মতো ভারতের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা চালাবে।