রাশিয়া এবং আমেরিকা কেন তৈরি করেছিল তালিবানদের?
রাজেশ রায়: বর্তমানে পুরো আফগানিস্তান জুড়ে তালিবানের শাসন চলছে। তালিবানের হিংস্রতা গোটা বিশ্ব দেখেছে। কিন্তু জানেন কী তালিবান আদতে কারা? কী করে তৈরি হল এই তালিবান! ইতিহাসের অন্যতম বিপদজনক কূটনৈতিক অপারেশন সাইক্লোনের জন্য কীভাবে একটি জঙ্গি সংগঠন তৈরি হয় সেই কথাই আজ বিস্তারিত আলোচনা করব।
আফগানিস্তানের এই পরিস্থিতির শুরু আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে, ১৯১৯ সালে ব্রিটেন আফগানিস্তান কে স্বাধীন করে দেয়। কারন আফগানিস্তানে বিশাল বড় বড় পাহাড়, ব্রিটিশদের কোন লাভ হচ্ছিল না তাই ব্রিটিশরা আফগানদের স্বাধীনতা দিয়ে দেয়। এরপর আফগানিস্তানে শাহ রাজবংশের রাজত্ব শুরু হয়। শাহ বংশের শেষ রাজা ছিল জাহিদ শাহ, ১৯৭৩ সালে চিকিৎসা করাতে জাহিদ শাহ ইটালি যায়। এই সুযোগে তারই সেনাপতি দাউদ খান ক্ষমতা দখল করে নেয়। দাউদ খান নিজেকে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, রাজা সব হিসাবে ঘোষনা করে। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ দাউদ খানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ১৯৭৮ সালে ঘটা এই আন্দোলন ইতিহাসে শ রেজোল্যুশন নামে পরিচিত। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল নুর মহম্মদ তারিকি, একে সাহায্য করত সোভিয়েত ইউনিয়ন। এরপর নুর মহম্মদ তারিকি আফগানিস্তানে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করে। আর যেখানে কমিউনিজম সেখানে তো সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকবেই কারন সোভিয়েত ইউনিয়নেই প্রথম কমিউনিজমের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। নুর মহম্মদ তারিকি আফগানিস্তানের উন্নতি শুরু করে, স্কুল, কলেজ তৈরি করা হয়, সবচেয়ে বড় কথা মহিলাদের স্বাধীনতা দেওয়া হয়, বোরখা পড়া বাধ্যতামূলক করা হল না, কারন কমিউনিজম কোন ধর্ম মানে না। ঠিক এই খানেই সমস্যা তৈরি হল। আফগানিস্তানের ৯৮% জনসংখ্যা মুসলিম, তারা এর তীব্র বিরোধিতা শুরু করল। নুর মহম্মদ তারিকি এরপর আফগানিস্তানে সোশালিস্ট রিফর্ম নিয়ে আসে মানে যাদের প্রচুর জমি আছে তাদের থেকে কিছু জমি নিয়ে গরীবদের দেওয়া হবে। ঠিক এই খানেই আপত্তি শুরু করে বহু মানুষ।
সেইসময় আমেরিকা বনাম সোভিয়েত ইউনিয়ন ঠান্ডা লড়াই চলছিল সুতরাং সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকা মানেই আমেরিকা আসবেই। ঠিক এইখানেই শুরু হয় অপারেশন সাইক্লোন, যার অর্থ এমন এক ঝড় নিয়ে আসা যা পুরো সোভিয়েত ইউনিয়ন কে ধ্বংস করে দেবে আর বাস্তবে তাই হয়েছিল। এর জন্য আমেরিকা বিপুল অর্থ খরচ, অস্ত্র সাপ্লাই এবং তাদের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ কে ব্যবহার করেছিল। আমেরিকা আফগানিস্তানের সাধারণ মুসলিমদের বোঝাতে শুরু করল যে তোমাদের ধর্ম বিপদে আছে। আমেরিকা আফগানিস্তানে মুজাহিদ্দিন তৈরি করে, মুজাহিদ্দিন শব্দের অর্থ যারা ধর্মের জন্য লড়াই করে। আমেরিকা করল কী নুর মহম্মদ তারিকির বিদেশমন্ত্রী হাফিজ উদ্দীন আমিন কে সিআইএর মারফত নিজেদের পক্ষে করে নেয়। আমেরিকা হাফিজ কে নির্দেশ দেয় আফগানিস্তানের উন্নতি দ্রুত গতিতে করতে, ইসলাম বিরোধী কাজকর্ম করত, বিশেষ করে মুসলিম ভাবাবেগে আঘাত দিতে বোরখা নিষেধ করে দেওয়া হয়। এতে সাধারণ আফগান মুসলিমরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আমেরিকা এই সুযোগে মুজাহিদদের ট্রেনিং দিতে শুরু করে। আমেরিকার ততকালীন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার এই অপারেশন সাইক্লোন শুরু করে। এবার এখানে একটা ব্যাপার হচ্ছে আমেরিকা কিন্তু সরকারি যুদ্ধে নামেনি, আমেরিকা ছায়াযুদ্ধ শুরু করে। আমেরিকা পাকিস্তান কে ব্যবহার করতে শুরু করে। আমেরিকা পাকিস্তান কে অর্থ ও অস্ত্র পাঠাত, সেই সব অস্ত্র করাচি হয়ে আফগানিস্তানে পাঠাত পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। শুধু আমেরিকা না, পাকিস্তান, ব্রিটেন ও সৌদিআরব ও মুজাহিদদের সাহায্য করত ও ট্রেনিং দিত। বলা হয় আমেরিকা সেই সময় প্রায় এক লক্ষ মুজাহিদদের ট্রেনিং দিয়েছিল। শুনে অবাক হয়ে যাবেন আমেরিকাই ওসামা বিন লাদেন কে তৈরি করেছিল। লাদেন কে ছিল? সৌদি আরবের এক অত্যন্ত বড়লোক পরিবারের উচ্চশিক্ষিত যুবক। লাদেনকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে আমেরিকাই পাঠিয়েছিল। শুধু তাই নয় আমেরিকা আফগানিস্তানের ছাত্রদের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে করল, ছাত্রদের আফগান ভাষায় তালিব বলে, এই থেকেই তালিবানের উতপত্তি। এই তালিবদের মধ্যে লিডার ছিল মুল্লা ওমর তাকে আমেরিকা নিজেদের দলে করে।
এবার এখানে একটা ব্যাপার দেখুন ঠিক এই সময়েই ইরানে আমেরিকা গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল ইরানে আমেরিকা সেই গুলোই কটে যে গুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে করেছিল যেমন নারীশিক্ষা ও স্বাধীনতা,মত, উন্নত শিক্ষা ব্যাবস্থা সবকিছু। ব্যাপারটা লক্ষ্য করুন আমেরিকা আফগানিস্তানের মুসলমানদের বোঝায় তাদের ধর্ম নষ্ট হচ্ছে আবার সেই আমেরিকাই ইরানে সেই একই কাজ করছে। এবার সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার মতই ইরানের লোকজনদের বোঝায় তাদের ধর্ম বিপদে আছে। ফলে আফগানিস্তানের লোকদের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইরানের লোকজনদের কাছে আমেরিকা শত্রু হয়ে যায়। যার ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান ও ইরানে দুটি দেশেই ইসলামিক বিপ্লব ঘটে। ঠিক এই সময়ে নুর মহম্মদ তারিকি কে পুরো পরিবার সমেত হত্যা করে হাফিজউদ্দিন আমিন যার নেপথ্যে ছিল সিআইএ। এরপরেই ১৯৭৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন অ্যাটাক করে আফগানিস্তানে হাফিজ উদ্দিন আমিন কে হত্যা করে।
সোভিয়েত ভেবেছিল আফগানিস্তান কে জিতে নেওয়া খুব সোজা কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী আজ পর্যন্ত আফগানিস্তান কে জিততে কেউ পারেনি। সিকন্দর ও তার পুরো সেনা নিয়ে আক্রমণ করেছিল আফগানিস্তান কে তাও পারেনি। আফগানিস্তানের ভূ- প্রকৃতি এমন যে শুধু উঁচু পহাড়ে ভর্তি। এসব পাহাড়ের কোথায় তালিবানরা লুকিয়ে আছে তা জানা অসম্ভব। সোভিয়েতের স্থলসেনা ব্যাপক মার খাবার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের বিমানবাহিনী নামায় যুদ্ধে কিন্তু আমেরিকা তালিবানকে স্ট্রিংগার মিসাইল সাপ্লাই করে যা দিয়ে প্রচুর সোভিয়েত হেলিকপ্টার ধ্বংস করে তালিবানরা। অবশেষে ১৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যায়, এই দশ বছরে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তত ১৫,০০০ সেনা মারা গেছিল।
১৯৭৭-৮৯ পর্যন্ত চলেছিল এই অপারেশন সাইক্লোন। ১৯৮১ সালে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগন নিজে তালিবানদের সাথে বৈঠক করেছিল। আমেরিকা প্রথমে এর জন্য ৫ লাখ ডলার অর্থ সাহায্য করে, ধীরে ধীরে ৩-৪ বছর পর বছরে ২০-৩০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য করতে থাকে। ১৯৮৭ এর দিকে আমেরিকা বছরে ৬০০ মিলিয়ন ডলার বা ৩৮০০ কোটি টাকা সাহায্য করত। ভাবুন আমেরিকা কীহারে অর্থ সাহায্য করেছে।
অপারেশন সাইক্লোন শেষ হবার পর সবচেয়ে বড় বিপদে পড়ে আমেরিকা নিজেই। আফগানিস্তানে অনেক জাতি রয়েছে যেমন পশতুন, পাঠান। এদের নিজেদের মধ্যে কোন ঐক্য নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন চলে যাবার পর এরা নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করে। যারজন্য আফগানিস্তান পুরো নরকে পরিনত হয়। আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই সময় মুল্লা উমরের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে তালিবান সমস্ত গ্রুপ কে শেষ করে নিজেদের শাসন শুরু করে। এইসময় আরও একটা ঘটনা ঘটে। সৌদিআরব ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ওসামা বিন লাদেন সৌদি আরব কে বলে সৌদি আরবের পবিত্র জমি ব্যবহার করে ইরাকে আক্রমণ না করতে কিন্তু আমেরিকার চাপে লাদেন কে সৌদি আরব দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়। যার ফলে ওসামা বিন লাদেন আমেরিকার সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে ওঠে, এর জন্যই লাদেন ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে দেয়। যার ফলে আমেরিকা এবার আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে চলে যায় ঠিক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতন। ভাগ্যের কেমন পরিহাস দেখুন যে তালিবান কে আমেরিকা ট্রেনিং, অর্থ, অস্ত্র সব দিল এবার তাদের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে হচ্ছে আমেরিকাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন চলে যাবার সময় আফগানিস্তানের স্পিন বোলডাজ নামে একটা স্থানে তাদের ওয়েপনস ডিপো তে অনেক অস্ত্র ফেলে যায় এগুলো সব লুট করে তালিবানরা যার ফলে তালিবানরা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
২০০১-২১ পর্যন্ত আমেরিকা ২০ বছর আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে, প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচা হয়ে যায় তাও কোনও লাভ হয় না, শেষে আমেরিকাকেও খালি হাতে ফিরতে হল। তবে আমেরিকা চলে আসবার আগে নিজেদের অনেক ওয়েপনস,গাড়ি সব আফগানিস্তানে ফলে দিয়ে আসে ইচ্ছে করে যাতে তালিবান এগুলো পেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে ও অত্যাচার করে। তাতে গোটা বিশ্বের সামনে আমেরিকা বলতে পারবে আমরাই ভাল ছিলাম। অর্থাৎ নিজেদের পরাজয় এড়াতে আমেরিকা এই চাল চেলে গেল।
এবার সবশেষে একটা কথা জানা যাক আফগানিস্তান কে কেন সবাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। আফগানিস্তানে প্রচুর পরিমানে খনিজ সম্পদ আছে, লিথিয়াম, আয়রন ভর্তি। কয়েকশো বিলিয়ন ডলারের সম্পদ আছে এখানে। কিন্ত তা ব্যবহার করা খুব কঠিন। ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা কেউই পারে নি।