চীন থেকে যুদ্ধজাহাজ ক্রয় করেও কেন মিসাইল লঞ্চ করতে পারছে না পাকিস্তান?
রাজেশ রায়:- পাকিস্তান চীন থেকে অস্ত্র কীনে কী পরিমান বিপদে পড়েছে তা আগেও দেখা গেছে এখনও দেখা যাচ্ছে। তা সে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হোক কীংবা যুদ্ধ বিমান বা ড্রোন হোক, এসবই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মাথা ব্যাথার কারন বর্তমানে। এখন আমেরিকার সিকিউরিটি এক্সপার্টরা জানিয়েছে চীনের কাছ থেকে যুদ্ধ জাহাজ কীনেও বিপদে পড়েছে পাকিস্তান। এই জাহাজ গুলো থেকে মিসাইল ফায়ার করতেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে পাকিস্তান নেভিকে। পাকিস্তান চীন থেকে কী ধরনের যুদ্ধ জাহজা কীনেছে, জাহাজটির বিবরন এবং কেন এটি মিসাইল লঞ্চ করতে পারছে না?
সম্প্রতি আমেরিকা জানিয়েছে পাকিস্তান চীন থেকে কেনা চারটি যুদ্ধ জাহজ নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। জিও পলিটিকিয়ার এর ডি ভ্যালেরিও ফ্যাবি এই তথ্য জানিয়েছেন, তিনি এর আগেও একাধিক বার পাকিস্তানের চীনের তৈরি অস্ত্র নিয়ে রিপোর্ট লিখেছিলেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে পাকিস্তান চীন থেকে সম্প্রতি যে চারটি এফ-২২ পি ফ্রিগেট কিনেছিল সে গুলো এখন পাকিস্তান নেভির গলার কাটা হয়ে আছে। পাকিস্তান এখন এই জাহাজ গুলো সমুদ্র তে অপারেট করতেই চিন্তা করছে। এই চারটি জাহাজের তিনটি সরাসরি চীনে তৈরি হয়েছে এবং একটি পাকিস্তানের করাচি শিপইয়ার্ডে তৈরি হয়েছে। পাকিস্তানের ২৫০০০ টন কনভেনশনাল পাওয়ার ফ্রিগেট প্রজেক্টে ২০০৫ সালে চীনের সাথে পাকিস্তান এই চারটি ফ্রিগেটের চুক্তি করে যার মোট মূল্য ছিল ৭৫০ মিলিয়ন ডলার। সেপ্টেম্বর ২০০৯ থেকে এপ্রিল ২০১৩ এর মধ্যে এগুলো পাকিস্তানকে ডেলিভারি দেওয়া হয়। এফ -২২ পি ক্লাস ফ্রিগেট চীনের হুডং- জনগুহুয়া কোম্পানির তৈরি।
পাকিস্তান একে জুলফিকার ক্লাস ফ্রিগেট বলে, উর্দু ভাষায় এর অর্থ তরোয়াল। চীনের টাইপ ০৫৩ এইচ ৩ ফ্রিগেটের উপর বেসড করে এগুলো তৈরি করা হয়েছে। এগুলো পাকিস্তানের তারিক ক্লাস ফ্রিগেটের রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে কেনা হয়েছিল। ১২৩.২ মিটার লম্বা এই জাহাজের ডিসপ্লেসমেন্ট প্রায় ৩১৪৪ টন। এই জাহজে ইঞ্জিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ফ্রান্সের এসইএমটি পাইলস্টিকের চারটি ১৬ পিএ৬এসএসটিসি ইঞ্জিন এবং চারটি জার্মানির এমটিইউ ডিজেল জেনারেটর ৮ভি৩৯৬টিই৫৪ ইঞ্জিন। এর রেঞ্জ ৭,৪০০ কিলোমিটার এবং গতি ২৯ নট বা ৫৪ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। এতে রেডার হিসাবে রয়েছে সার ১৭ / টাইপ ৫১৭ লং রেন্জ এয়ার সারভিলেন্স রেডার, এস আর- ৬০/ টাইপ ৩৬০ এয়ার, সারফেস সার্চ রেডার, কেএইচ ২০০৭ নেভিগেশন রেডার, এটলাস এএসো-৯০ সোনার, ২ টি টাইপ ৩৪৭ ফায়ার কন্ট্রোল রেডার, টাইপ ৩৪৫ স্যাম ফায়ার কন্ট্রোল রেডার। এই জাহাজে অস্ত্র হিসাবে রয়েছে একটি আট শেলের এফ এম ৯০ এন মিসাইল সিস্টেম, দুইটি চার শেলের সি-৮০২ মিসাইল সিস্টেম, একটি ৭৬ মিলিমিটার একে-১৭৬ গান, দুটি চাইনিজ টাইপ ৭৩০ বি ৩০ মিলিমিটার গ্যাটলিং গান, দুটি তিন শেলের টর্পেডো লঞ্চিং টিউব এবং বেশ কীছু অ্যান্টি সাবমেরিন রকেট। এটি একটি জেড-৯ অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার হেলিকপ্টার বহন করে। পাকিস্তান এই ক্লাসের চারটি ফ্রিগেট কিনেছে পিএনএস জুলফিকর, শামসের, সেইফ এবং আসলাত। এর মধ্যে পিএনএস আসলাত করাচিতেই তৈরি করা হয়েছে। পাকিস্তান এগুলোকে তাদের জিন্না ক্লাস ফ্রিগেট দিয়ে রিপ্লেস করবে।
এই জাহজ গুলোকে তৈরি করা হয়েছে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হিসাবে মানে সমুদ্রে অন্য যুদ্ধ জাহাজকে নিরাপত্তা দেবার জন্য একটি পূর্ণ এয়ারডিফেন্স সিস্টেম হিসাবে এগুলো কাজ করবে। কিন্তু এয়ার টু এয়ার লং রেঞ্জ মিসাইল ও এয়ার টু সার্ফেস মিসাইল বর্তমানে দরকার হাইব্রিড যুদ্ধের ক্ষেত্রে, এখানেই পিছিয়ে আছে এই জাহাজ গুলো, পাকিস্তান এই ধরনের মিসাইল এতে ব্যবহার করতে পারছে না। এই জাহাজগুলোতে ব্যবহৃত চাইনিজ এফ এম ৯০ এন মিসাইল সিস্টেমের ইমেজিং ডিভাইসে সমস্যা দেখা গেছে। এই ডিভাইস টার্গেটকে সঠিক ভাবে দেখাচ্ছে না এবং যার জন্য মিসাইল টার্গেটকে লক করতেও পারছে না। যার ফলে পুরো জাহাজের মিসাইল সিস্টেমই বন্ধ হয়ে গেছে। তবে শুধু এটাই সমস্যা নয়। এই জাহজের ইনফ্রারেড সেন্সর আই আর -৭০ এবং এস আর ৬০ এর রেডারও খুবই নিম্নমানের এবং ডিফেক্টিভ। এই দুটি সিস্টেমই জাহজের লং রেঞ্জ এয়ার এবং সারফেস মিশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই জাহজগুলোর সারফেস ট্রাক রেডারও সঠিক ভাবে কাজ করছে না। পাকিস্তান বাধ্য হয়ে আই আর ৭০ সেন্সরকে জাহাজ থেকেই খুলে ফেলেছে। এই জাহাজে যে ইন্জিন ব্যবহার করা হয়েছে তা বেশীদিন একাটানা চললে সমস্যা দেখা দিচ্ছে, কীছুটা পথ অতিক্রম করে জাহাজের গতি কমে যাচ্ছে।
বলা হচ্ছে এই ক্লাসের পিএনএস আসলাত জাহাজে রেডারের সমস্যা রয়েছে যার জন্য জাহাজটিকে বন্দরেই রেখে দিতে বাধ্য হয়েছে পাকিস্তান নেভি। পিএনএস জুলফিকারের ৭৬ মিলিমিটার প্রধান নেভাল গানেও সমস্যা রয়েছে। তবে চীন থেকে অস্ত্র কীনে বিপদে পড়ার ঘটনা এটাই প্রথম। চীনের প্রায় সমস্ত ক্রেতাই এই সমস্যায় পড়েছে। গত ফেব্রুয়ারীতে পাকিস্তান চীন থেকে ভিটি-৪ ব্যাটেল ট্যাঙ্ক ও কীছু আর্টিলারি গান কেনে। এই সবই টেস্টের সময় খুবই খারাপ পারফরম্যান্স দেয়। তবে শুধু পাকিস্তান নয়, জর্ডান চীন থেকে ৬ টি সি এইচ-৪ ড্রোন কেনে, এগুলো এত সমস্যা তৈরি করে যে বাধ্য হয়ে জর্ডান এগুলো বিক্রি করে দেয়। বাংলাদেশ বায়ুসেনা চীন থেকে ২৩ টি পিটি-৬ ট্রেনিং বিমান কিনেছিল, এগুলোতেও সমস্যা রয়েছে। আসলে চাইনিজ অস্ত্র সবচেয়ে খারাপ হবার প্রধান কারন হচ্ছে চীন বেশীরভাগ অস্ত্র আমেরিকা, রাশিয়া থেকে নকল করে তৈরি করে। চীন ডিজাইন তো নকল করে নেয় কিন্তু টেকনোলজির ভিতরে থাকা অনেক লুপ হোল চীন বুঝতে পারে না। রাশিয়া, আমেরিকা যেসব অস্ত্র বানায় তা সব ব্যাটেল টেস্টেড কারন আমেরিকা ও রাশিয়ার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে অনেক। সেজন্য যুদ্ধক্ষেত্রে একটি অস্ত্র কেমন আচরন করতে পারে তারা জানে কিন্তু চীনের কোন যুদ্ধ অভিজ্ঞতা নেই তেমন সেজন্য তারা অস্ত্র তো বানায় কিন্তু প্রকৃত যুদ্ধে তা কেমন আচরন করবে সেটা তারা বুঝতে পারে না। চীনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল তারা পয়সা কম খরচে অস্ত্র তৈরি করে অস্ত্র বাজার দখল করতে চায়, এর জন্য অস্ত্রের কোয়ালিটি খারাপ হয়। ভারতের বড় শত্রু হিসাবে পাকিস্তান যত চীন থেকে এধরনের অস্ত্র কীনবে তা দেশের জন্য ভাল খবর।