চীনের কেন এতো সমস্যা রয়েছে তাইওয়ানকে নিয়ে?
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আবারও একটি সমস্যা তৈরি হয়েছে তা হচ্ছে চীন তাইওয়ান ঝামেলা। আমেরিকার স্পীকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে কেন্দ্র করে চীন রীতিমতো যুদ্ধকালীন অভ্যাস শুরু করেছে। চীনের রাস্তায় রীতিমতো ট্যাঙ্ক দেখা যাচ্ছে। তবে যুদ্ধ হবে কীনা তা হয়ত সময় বলবে। যখনই বড় কোন শক্তিশালী দেশের রাজনৈতিক বর্গ চীনের অনুমতি ব্যতিত তাইওয়ানে গেছে তখন চীন ক্ষুব্ধ হয়েছে। চীন সবসময় দাবি করে তাইওয়ান তাদের এবং যেকোনও মূল্যে তারা তাইওয়ানের দখল নেবেই তা সে শান্তিপূর্ণ ভাবেই হোক কিংবা মিলিটারি ক্ষমতার মাধ্যমেই হোক। চীন কেন তাইওয়ানকে নিয়ে এতটা অ্যাগ্রেসিভ, এব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
প্রত্যেকটি দেশের নিজস্ব এডিআইজেড বা এয়ার ডিফেন্স আইডেন্টিফিকেশন জোন আছে। সোজা কথায় এটি একটি দেশের আকাশসীমা যা দেশটির মূল স্থলভাগ ছাড়িয়ে অনেকটা বিস্তৃত হয়। এই এলকার মধ্যে যখন অন্য কোনও দেশের বিমান প্রবেশ করে তখন বিমনাটিকে তার সমস্ত তথ্য সেই দেশটিকে দিতে হয়। যদি এমন না হয় তাহলে সেই দেশটি বিমাটিকে লক্ষ করে মিসাইল লঞ্চ করতে পারে, কারন বিমানটি সেই দেশটির শত্রু দেশেরও হতে পারে। অন্যান্য দেশের মতন তাইওয়ানেরও নিজস্ব একটি এডিআইজেড রয়েছে। যদিও তাইওয়ানের অবস্থান চীনের মূল ভূভাগ থেকে একটু দূরে। চীন ও তাইওয়ানের মাঝে সমুদ্র রয়েছে যাকে তাইওয়ান প্রনালী বলা হয়। কিন্তু চীন বারবার তাইওয়ানের এডিআইজেড লঙ্ঘন করে। চীন প্রায়ই তাইওয়ানের আকাশ সীমায় তাদের যুদ্ধবিমান পাঠায়, জবাবে তাইওয়ানও তাদের যুদ্ধবিমান পাঠায় এবং এরকম চলতেই থাকে। তথ্য অনুযায়ী ২০২০ এর সেপ্টেম্বর থেকে এখনও অবধি ১৭৬৫ বার চীন তাদের যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে, শুধু এবছরই ৬২৩ বার যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে চীন যার কারন চীন তাইওয়ানকে স্বাধীন দেশ হিসাবে মানে না। চীনের দাবি তাইওয়ান তাদেরই একটি প্রদেশ। চীনের প্রায় প্রতিটি দেশের সাথেই সীমান্ত নিয়ে সমস্যা আছে। অন্যের জায়গা নিজেদের বলে দাবি করা চীনের পুরোনো অভ্যাস। চীন তিব্বত দখল করেছে অন্যায় ভাবে।
১৯৬২ তে ইন্দো চীন যুদ্ধের পর চীন আকসাই চীন দখল করে। ভারতের অরুনাচল প্রদেশ, সিকিম, লাদাখ, জাপানের সেনকাকু দ্বীপ চীন নিজের বলেই দাবি করে। এমনকী সমুদ্রকেও বাদ দেয় নি চীন। বিস্তীর্ণ দক্ষিন চীন সাগর নিজেদের বলে দাবি করে চীন। যার কারনে এই এলাকার দেশ গুলোর সাথে চীনের বিরোধীতা রয়েছে। তবে এসবের মধ্যে তাইওয়ান সব থেকে আলাদা। তাইওয়ান চীনের কাছে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। যার কারনে ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ানে পৌঁছানোর পরই খবর আসে চীনের ২১ টি যুদ্ধবিমান তাইওয়ানের আকাশে প্রবেশ করেছে। এবার স্বাভাবিক ভাবেই মনে হবে চীন তাইওয়ানকে নিয়ে এতটা অ্যাগ্রেসিভ কেন!! এর জন্য একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক।
১৯৯৫-৯৬ সালে চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে পুরো যুদ্ধ শুরু হবার সম্ভবনা তৈরি হয়েছিল। সেসময় তাইওয়ান প্রনালীতে চীন রীতিমতো যুদ্ধভ্যাস শুরু করেছিল এবং মিসাইল লঞ্চ করছিল। প্রায় আটমাস এমন চলার পর আমেরিকার হস্তক্ষেপে চীন এসব বন্ধ করে। তখন এমন অবস্থার প্রধান কারন ছিল তৎকালীন তাইওয়ানের রাষ্ট্রপতি লি তেং হুই চীনের একচীন নীতি মানতে অস্বীকার করেছিল। একচীন নীতি অনুযায়ী চীন তাইওয়ানকে নিজের অংশই মনে করে এবং বিশ্বের কোন দেশ চীনকে ছাড়া সরাসরি তাইওয়ানের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবেনা। এমনকী চীনে ব্যাবসা করতে গেলেও বিদেশী সংস্থা গুলোকো একচীন নীতি মানতে হয়। বিশ্বের খুব কম দেশই একচীন নীতি না মেনে সরাসরি তাইওয়ানের সাথে যোগাযোগ করে। ১৯৯৫-৯৬ এর দিকে তাইওয়ানের নির্বাচনেও চীন প্রভাব খাটাত। কিন্তু রাষ্ট্রপতি লি তেং হুই আবারও সাধারন নির্বাচনের আয়োজন করে এবং চীনের প্রভাব ছাড়াই তিনি ৫৪ শতাংশ ভোটে জয়লাভ করেন। তাইওয়ানে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে ওনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল যার জন্য ওনাকে মিঃ গনতন্ত্র বলা হত। এই জন্য সেসময় চীন ক্ষুব্ধ হয়েছিল।
এর প্রায় ২৫ বছর বর্তমান তাইওয়ানিজ রাষ্ট্রপতি তাই ইং ওয়েন চীনের বিরুদ্ধে কাজ করছে। যার ফলে আবারও ক্ষুব্ধ চীন। তাই ইং ওয়েন ২০১৬ সালে যখন তাইওয়ানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তখন তিনি সরাসরি ঘোষনা করেন তাইওয়ান তার সার্বভৌমত্ব এবং এলাকা রক্ষা করতে প্রস্তত। ২০২০ সালে তিনি আট মিলিয়ন ভোট পেয়ে আবারও তাইওয়ানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এর আগে তাইওয়ানের কোন লিডার সরাসরি চীনের বিপক্ষে কোন কথা বলত না কিন্তু তাই ইং ওয়েন দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েই ঘোষনা করেন বেজিং এর নিয়ম এবং এক চীন নীতি তিনি মানবেন না কারন তাইওয়ান একটি স্বাধীন দেশ। এর জবাবে চীনের কমিউনিস্ট দলের মিডিয়া গ্লোবাল টাইমস বলে তাইওয়ানের রাষ্ট্রপতি তাইওয়ানকে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু এখন তাইওয়ানের জনতা তাদের রাষ্ট্রপতিকে সমর্থন করে। ১৯৯০ এর দিকে তাইওয়ানে প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ লোক চীনকে সমর্থন করত এবং মাত্র ১৮ শতাংশ লোক তাইওয়ানকে সমর্থন করত কিন্তু গত ৩০ বছরে ছবিটা পরিবর্তন হয়েছে এখন তাইওয়ানে নিজের দেশের প্রতি সমর্থনের হার ৬৪ শতাংশ এবং মাত্র ২ শতাংশ লোক চীনকে সমর্থন করে। আর আগুনে আরও ঘি ঢেলেছে ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর।
আমেরিকা বহুদিন ধরেই তাইওয়ানকে রক্ষা করে আসছে। তবে এই আমেরিকাও ১৯৭৯ সাল থেকে এক চীন নীতি অনুসরন করত কিন্তু প্রাক্তন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকে তাইওয়ানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ শুরু হয় আমেরিকার। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি যে সরাসরি কথা বলে তাইওয়ানের রাষ্ট্র প্রধানের সাথে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাইওয়ানকে প্রচুর অ্যাডভান্সড অস্ত্র বিক্রি করে। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট শপথ নেবার সময় তাইওয়ানের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রন করেছিল। যা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় আমেরিকা তাইওয়ানকে সমর্থন করছে। ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের কীছুদিন আগেই আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন এবং চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এর ফোনে কথা হয় যাতে শি জিনপিং স্পষ্ট জানায় আগুন নিয়ে খেললে নিজেকে পুড়তে হবে অর্থাৎ যাতে তাইওয়ান সফর না হয় কিন্ত তা সত্বেও ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর করে বুঝিয়ে দেন আমেরিকা এখনও বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার। চীনের তাইওয়ানকে দখল করার আরও একটা বড় কারন সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি।
তাইওয়ানের সংস্থা টিএসএমসি বিশ্বের সবচেয়ে বড় চীপসেট উৎপাদন কারী সংস্থা। ২০২০ সালে বিশ্বে সেমিকন্ডাক্টরের ব্যাবসা হয় ৬৭০ বিলিয়ন ডলারের যার ২০ শতাংশ একা তাইওয়ানের ছিল। ২০১৫-২০ থেকে সেমিকন্ডাক্টর ব্যাবসা তাইওয়ানে ৭৯ শতাংশ বেড়েছে। চীন তাইওয়ান থেকে ৩০ শতাংশ চীপ সেট কেনে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন তাইওয়ান কত বড় বাজার, সুতরাং চীন কখনওই চাইবেনা তাইওয়ান তাদের হাত থেকে বেড়িয়ে যাক। তাইওয়ানের মোট বানিজ্যের ২৮ শতাংশ চীনেই যায়। সুতরাং চীন তাইওয়ানকে দখল করতে খুবই আগ্রাসী ভূমিকা নিচ্ছে। চীনের লক্ষ সুপার পাওয়ার হওয়া। সেখানে চীনের হুমকী সত্বেও ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর বিশ্বে চীনের জন্য লজ্জা। এবার চীন যদি যুদ্ধও করে তাহলে তার উপর প্রচুর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে ফলে চীনের অর্থনীতি হোঁচট খাবে আবার যুদ্ধ না করলেও চীনের এত সামরিক ক্ষমতা নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাঙ্গ হবে চীনকে নিয়ে। সুতরাং এটাই দেখার চীন কী করে।