মহাদেব ষাঁড়ের রুপ ধরে থাকেন। কেদারনাথ মন্দিরের অবাক করা রহস্য
হিন্দু ধর্মের অন্যতম জনপ্রিয় তীর্থস্থান কেদারনাথ মন্দির। উত্তরাখন্ড রাজ্যে গাড়োয়াল হিমালয় রেঞ্জে মন্দাকিনী ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলে কেদারঘাটিতে অবস্থিত এই কেদারনাথ মন্দির বহু যুগ ধরে হিন্দু ধর্মের পীঠস্থান। ভগবান শিবের বারোটি জ্যোতিলিঙ্গের একটি এই কেদারনাথ ধাম। বলা হয় এখানে ভগবান শিবের নাম নেওয়া মাত্র আত্মার মুক্তি ঘটে। সমুদ্র পিষ্ট থেকে ৩,৫৮৩ মিটার উচ্চতায় উত্তরাখন্ডের রুদ্রপ্রয়াগ জেলায় অবস্থিত এই এই মন্দির হরিদ্বার শহর থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সংস্কৃত শব্দ কেদার এবং নাথা এই দুই শব্দ থেকে কেদারনাথ কথাটি এসেছে যার পূর্ন অর্থ এই জায়গার অধিপতি। কেদারনাথ মন্দির কবে তৈরি হয়েছিল তার কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই তবে বিশ্বাস করা হয় এই ক্ষেত্র প্রায় ৫০০০ বছরের পুরোনো। দ্বাপর যুগের শেষের দিকে পান্ডবরা এই কেদারনাথ মন্দির তৈরি করেছিল। মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের হারিয়ে জয় লাভ করে পান্ডবরা। কিন্তু কৌরবরা সম্পর্কে ছিল পান্ডবদের ভাই, সাথে সাথে যুদ্ধে ভীষ্ম পিতামহ সহ তাদের গুরু দ্রোণাচার্যের মত ব্রাহ্মন এবং অনেক আত্মীয় স্বজন নিহত হন। তখন সেই স্বজন হত্যা ও ব্রাহ্মণ হত্যার পাপ থেকে মুক্তি পাবার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে পান্ডবরা ভগবান শিবকে খুঁজতে বের হন। পান্ডবরা প্রথমে আসেন হিন্দুদের পবিত্র শহর বেনারসে, কারন বলা হয় বেনারস মহাদেবের অনেক প্রিয় একটি স্থান যেখানে মহাদেবের দ্বাদশ জ্যোতিলিঙ্গের একটি কাশী বিশ্বনাথ রয়েছেন। এটাও বিশ্বাস করা হয় বেনারস শহরকে মহাদেব নিজের ত্রিশূলে ধারন করেন। কিন্তু পান্ডবদের উপর অখুশি মহাদেব পান্ডবদের দর্শন না দিয়ে গাড়োয়াল এলাকায় এসে লুকিয়ে পড়েন। মহাদেব এখানে একটি ষাঁড়ের রুপ ধরে ঘুরে বেড়ান।
পান্ডবরা বেনারসে মহাদেবকে খুঁজে না পেয়ে গাড়োয়াল হিমালয়ে এসে তপস্যা শুরু করে। দ্বিতীয় পান্ডব ভীম হঠাৎ লক্ষ করেন গুপ্তকাশী নামক জায়গায় (যেহেতু এখানে মহাদেব লুকিয়ে ছিলেন তার জন্য এই জায়গাকে গুপ্ত কাশী বলা হয়) একটি অদ্ভুত দর্শন ষাঁড় ঘোরাফেরা করছে। ভীম সাথে সাথে বুঝতে পারে এটি স্বয়ং মহাদেব। ভীম পেছন থেকে ষাঁড় রূপী মহাদেবের লেজ ও পা জড়িয়ে ধরেন কিন্তু মহাদেব মাটির তলায় ঢুকে যান পরে পান্ডবদের কোঠোর তপস্যায় খুশি হয়ে মাটি ভেদ করে পাচ জায়গায় আবির্ভূত হন। ষাঁড় রুপি মহাদেবের কুজের অংশ প্রকাশিত হয় কেদারনাথে, পা প্রকাশিত হয় তুঙ্গনাথে, মুখ বের হয় রুদ্রনাথে, নাভি ও পেট প্রকাশিত হয় মধ্যমাহেশ্বরে এবং চুল প্রকাশিত হয় কল্পেশ্বরে। এই পাচ স্থানকে একত্রে পঞ্চ কেদার বলা হয়। পান্ডবরা এই পাঁচ স্থানেই মন্দির তৈরি করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর ৩৬ বছর পর হস্তিনাপুরে রাজত্ব করেন পান্ডবরা। এরপর কালচক্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার মানবলীলা সম্পন্ন করে পরমধাম বৈকুন্ঠলোকে ফিরে যান তখন পান্ডবরাও অভিমন্যু পুত্র পরীক্ষিতের উপর হস্তিনাপুরের শাসনভার দিয়ে স্বর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। গাড়োয়াল হিমালয়ে মহাদেবকে সন্তষ্ট করে পাপ মুক্ত হয়ে তারা স্বর্গারোহন শুরু করেন। তবে মহাভারতে কিন্তু কেদারনাথে উল্লেখ পাওয়া যায়না। সপ্তম থেকে অষ্টম শতকে স্কন্দ পুরানে প্রথম কেদারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১২ শতক থেকে কেদারনাথে পুণ্যার্থী দের যাতায়াত শুরু হয় যার উল্লেখ পাওয়া যায় ভট্ট লক্ষীধারার লেখা কীর্তি কল্পতরুতে। কেদারনাথ মন্দিরের যে প্রধান পুরোহিত তার আদি বংশ ভগবান নর নারায়নের সময় থেকে শিবের উপাসনা করত। এই বংশের ব্রাহ্মণদের কেদারনাথের পূজো করবার দায়িত্ব দিয়েছিলেন পান্ডবদের নাতি রাজা জন্মজয়। কর্নাটকের ভীরাসাভিয়া সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মনরাই এই মন্দিরে পূজো করেন।
১৯২৬ সালে ব্রিটিশ পর্বতারোহী এরিক শিপটোন তার লেখা “মেনি হান্ডরেডস অফ ইয়ারস এগো” তে জানিয়েছেন তখন কেদারনাথ মন্দিরের পুরোহিতই বদ্রীনাথ ধামের পুজো করতেন এবং তিনি প্রতিদিনই কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ যাতায়াত করতেন। পান্ডবদের তৈরি কেদারনাথ মন্দির পরে সংস্কার করেন তাদেরই উত্তরসুরি রাজা জন্মজেয়। বলা হয় অষ্টম শতকে এই মন্দির সংস্কার করেন জগত গুরু শঙ্করাচার্য। দশম শতকে এই মন্দির সংস্কার করেন মালওয়াট রাজা ভোজ। ৮৫ ফুট লম্বা, ১৮৭ ফুট চওড়া ও ১২ ফুট মোটা দেওয়াল বিশিষ্ট কেদারনাথ মন্দির বড় বড় পাথর দিয়ে ইন্টারলকিং সিস্টেমে তৈরি। এত উচ্চতায় এমন বড় বড় পাথর কী করে আনা হলতা সত্যিই অবাক করার মতন। কেদারনাথ আসতে হলে হরিদ্বার বা রিষিকেষ থেকে গাড়ি বা বাসে গৌরিকুন্ড আসতে হয়, এখান থেকে ২২ কিলোমিটার ট্রেক করে কেদারনাথ মন্দিরে পৌঁছাতে হয়, হেলিকপ্টার সার্ভিস ও পনি সার্ভিস ও পাওয়া যায়। প্রতি বছর এপ্রিল মে মাসে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন এই মন্দি ভক্তদের জন্য খোলা হয় এবং কার্তিক পূর্নিমার সময় নভেম্বরে এই মন্দির বন্ধ হয়ে যায় অতিরিক্ত ঠান্ডা ও বরফ পাতের কারনে, এভাবে মন্দির ছয় মাস খোলা থাকে ও ছয় মাস বন্ধ থাকে। তখন ভগবান কেদারনাথ কে উখিমঠে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়।
বলা হয় কেদারনাথে ছয় মাস মানুষে পূজো করে এবং ছয় মাস দেবতারা পূজো করে। ১৩ থেকে ১৭ শতকে এই মন্দির প্রায় ৪০০ বছর বরফের তলায় ছিল কিন্তু অবাক করার মত বিষয় যখন ৪০০ বছর পর যখন বরফের তলা থেকে এই মন্দির বেরোয় তখন মন্দির একদম ঠিক ছিল। তবে আজ যাকে আমরা কেদারনাথ বলি সেটা কিন্তু আসল কেদারনাথ নয়। আজ যাকে কেদারমাথ বলা হয় তা তৈরি করেছিল পান্ডবরা কিন্তু আদি কেদারনাথ বলা হয় বদ্রীনাথকে। বলা হয় ভগবান বিষ্ণুর অবতার নর ও নারায়ন মহাদেব সন্তষ্ট করে আদি কেদারনাথ প্রতিষ্ঠা করেন। একদিন ভগবান বিষ্ণু কঠোর তপস্যার জন্য বর্তমান বদ্রীনাথে উপস্থিত হন কিন্তু সেই স্থান তখন ছিল ভগবাম শিবের। তখন বিষ্ণু একটি ছোট বাচ্চার রুপ নিয়ে সেখানে আবির্ভূত হন। সেসময় পাশেই একটি উষ্ণকুন্ডে স্নান সেরে উঠে আসছিলেন মহাদেব ও দেবী পার্বতী। পথে একটি ছোট বাচ্চাকে পড়ে থাকতে দেখে দেবী পার্বতী মমতা স্নেহে বাচ্চা টিকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে আসেন। মহাদেব কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন এটি বাচ্চা রূপে স্বয়ং নারায়ন। মহাদেব পার্বতীকে বারনও করেছিলেন বাচ্চাটিকে না নিয়ে আসতে কিন্তু দেবী পার্বতী শোনেননি। বাচ্চাটিকে ঘরে রেখে আবারও একদিন স্নানে যান মহাদেব ও পার্বতী, তখন নারায়ন তার আসল রূপ ধরে ঘর ভিতর থেকে বন্ধ করে দেন। মহাদেব ও দেবী পার্বতী স্নান সেরে ফিরে আসার পর দেখেন ঘর ভিতর থেকে বন্ধ কীছুতেই দরজা খোলা যায় না। তখন মহাদেব হেসে পার্বতীকে বলেন এবার বুঝলে আমি কেন বারন করেছিলাম। এবার ওই স্থান নারায়নকে দিয়ে মহাদেব ও পার্বতী বর্তমান কেদারনাথ ধামে চলে আসেন। এজন্য বদ্রীনাথকে আদি কেদারনাথও বলা হয়। কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ সম্পর্কে একটি ভবিষ্যত বানী আছে, বলা হয় কলি যুগে পাপ যখন চরম সীমায় আসবে, মানুষ লোভ, কাম, লালসায় ডুবে যাবে, পৃথিবীতে ভক্তের সংখ্যা কমে যাবে তখন বদ্রীনাথ ও কেদারনাথ মন্দির আবারও হিমালয়ের কোলে লুপ্ত হয়ে যাবে।
হিমালয়ের কোলে দেব কা দেব মহাদেবের পরমস্থান কেদারনাথ চীরকালই রহস্যময়। বাবা কেদারনাথের তার এক পরম ভক্তের উপর অপরিসীম দয়ার একটি ঘটনা বলি। সময়টা ইংরেজ শাসনের সময়কার। তখন ট্রেন, বাসের সুবিধা ছিল না। সেসময় এক গরীব শিব ভক্ত পায়ে হেঁটে কেদারনাথ যাত্রা শুরু করে। অনেক কষ্ট করে দুই মাস যাত্রার পর সে কেদারনাথ পৌঁছায়। কেদারনাথে তখন প্রচন্ড ঠান্ডা, বরফ পড়ছে। সে মন্দিরে কাছে পৌঁছোয় এবং দেখে মন্দিরের পুরোহিত মন্দিরের দরজায় তালা দিচ্ছে। সেই ভক্ত পন্ডিতজীকে জিজ্ঞেস করেন মন্দির কখন খুলবে? জবাবে সেই পন্ডিতজী বলেন মন্দির আবার ছয় মাস পর খুলবে কারন প্রবল তুষারপাতের কারনে মন্দির বন্ধ হয়ে যায়। যা শুনে দুঃখে কেদে ফেলে ওই ভক্ত। পন্ডিতজী ওনাকে বলেন ফিরে যেতে আবার ছয় মাস পর আসতে। কিন্তু সেই ভক্ত কেদারনাথেই থাকবার সিদ্ধান্ত নেয়। তীব্র তুষারপাত ও ঠান্ডায় সেই ভক্ত শিবের ধ্যান করতে থাকে। ঠান্ডা এত বাড়তে থাকে মনে হয় পুরো শরীর জমে যাবে, এমন সময় দূর থেকে একটা আলো দেখা দেয়। এক অঘোরী বাবা আসতে আসতে এগিয়ে আসে এবং সেই লোকটিকে কীছু খাবার দিয়ে বলে খেয়ে নিতে এবং ঘুমাতে, তিনি সেই লোকটির জন্য একটু আগুন জ্বালিয়ে দেন এবং বলেন চিন্তার কারন নেই কাল সকালেই মন্দির খুলে যাবে। প্রচন্ড ক্লান্ত লোকটি কোনও চিন্তা না করেই ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম ভেঙে সে দেখে চারপাশে বরফ নেই বললেই চলে, ঠান্ডা অনেক কম। সে আশেপাশে খুঁজে সেই অঘোরী বাবাকে আর দেখতে পায় না। হঠাৎ দেখে দূরে মন্দিরের পুরোহিত তার সঙ্গী সাথিদের নিয়ে এগিয়ে আসছে, মন্দির খুলতে। সেই লোকটি পুরোহিতকে বলে আপনি যে বলেছিলেন মন্দির ছয় মাস বাদ খুলবেন তাহলে আজ খুলছেন!! পন্ডিতজী অনেকক্ষন তাকিয়ে চিনতে পেরে লোকটিকে বলেন আপনি তো সেই ব্যক্তি যিনি ছয় মাস আগে এসেছিলেন কিন্তু সেসময় মন্দির বন্ধ থাকার কারনে দর্শন করতে পারেননি। জবাবে লোকটি বলে আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে আমি গতকালই আপনার সাথে কথা বললাম, আপনি কী করে বলছেন আমি ছয় মাস আগে এসেছিলাম। পন্ডিতজী কীছুক্ষন চিন্তা করে বলেন কী হয়েছিল আপনার সাথে, আপনি কোথায় ছিলেন একটু বলুন। সেই শিব ভক্ত সমস্ত কথা পণ্ডিতজী কে বলেন যা শুনে চোখে জল গড়িয়ে পড়ে পন্ডিতজীর। তিনি বুঝতে পারেন ভক্তকে দেখা দিতে স্বয়ং কেদারনাথ মন্দিরের বাইরে এসেছিলেন এবং তিনি যোগ মায়ায় ছয় মাসকে এক রাত্রে বদলে দিয়েছিলেন যাতে সেই ভক্ত নভেম্বরে কেদারনাথে ঘুমিয়েছিলেন এবং এপ্রিলে ঘুম থেকে ওঠেন। আসলে মহাদেব এমনই, কালখন্ডকে ভক্তের জন্য বদলাতে পারেন তিনি কারন তিনিই মহাকাল। হর হর মহাদেব।
একাধিক সুত্র থেকে নিয়ে গবেষণা ভিত্তিক লেখা। তথ্য নিয়ে একাধিক মতামত রয়েছে।