পাকিস্তান কেন সমীহ করে চলত ভারতবর্ষের যুদ্ধজাহাজ আইএনএস বিরাটকে?
অর্পণ সাঁতরাঃ আইএনএস বিরাট হলো ভারতীয় নৌবাহিনীর দ্বিতীয় এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। একই সঙ্গে এটি ভারতীয় নৌবাহিনী ফ্ল্যাগশিপ এর মর্যাদা পায়। আইএনএস বিরাট কেও কেনা হয়েছিল ব্রিটেন থেকে। সেই সময় এর নাম ছিল এইচএমএস হারমেস। ১৯৪৪ সালের ২১ জুন এইচএমএস হারমেসের নির্মাণকার্য শুরু হয়। ৯ বছর পরে ১৬ ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ সালে এই জাহাজকে প্রথমবার জলে নামানো হয়। ২৫ শে নভেম্বর ১৯৫৯ সালে এই জাহাজকে প্রথমবার ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে যোগ করা হয়। এটি ছিল একটি সেনটাউর ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যরিয়ার।
সম্পূর্ণ লোডেড অবস্থায় এই জাহাজের ওজন ছিল ২৮ হাজার টন। ব্রিটেনে থাকাকালীন এর দৈর্ঘ্য ছিল ২২৫.২০মিটার। সেই সময় এটি ছিল ফ্ল্যট ডেকের ক্যরিয়ার। আর ভারতে আসার পর এর ওপর বসানো হয় স্কাই জাম্পার। যাতে হ্যরিয়ার বিমান অপরেট করা যায়। তখন এর দৈর্ঘ্য বেড়ে হয় ২২৬.৯০মিটার।
এটি সর্বোচ্চ ৫২ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় গতিবেগে চলতে সক্ষম ছিল। একবার সম্পূর্ণ জ্বালানি নিলে এটি ১৩ হাজার কিলোমিটারের পথ অতিক্রম করতে সক্ষম ছিল। এটিকে সম্পূর্ণরূপে অপারেট করার জন্য ২১০০ জুনের ক্রু মেম্বার এর প্রয়োজন ছিল। শত্রুর বিমান আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য এতে ছিল ১০টি ৪০মিলিমিটার এর এ্যন্টি এয়ারক্রাফট গান। এতে ১৯৭০সালের পর দুটি সি ক্যট এয়ার ডিফেন্স মিসাইল লঞ্চার বসানো হয়।
এই ক্যরিয়ার ১২টি সি-ভিক্সেন ফাইটার, ৭টি বুকানির্স এ্যটাক এয়ারক্রাফট, ৫টি গ্যনেটস এ্যন্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার বিমান ও ৬টি ওয়েসেক্স হেলিকপটার ক্যরি করতো ব্রীটেনে থাকা কালীন।
এই ক্যারিয়ার ব্রিটেনের নৌ বাহিনীর অন্যতম সেরা ক্যারিয়ার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তৎকালীন সময়ে এই ক্যারিয়ারকে নির্মাণ করতে ১৮ মিলিয়ন ইউরো খরচ হয়েছিল অতিরিক্ত ১ মিলিয়ন ইউরো খরচ হয়েছিল ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা তৈরি করতে এবং ভবিষ্যতে আরও ১২ মিলিয়ন ইউরো খরচ হয়েছিল এই ক্যারিয়ারের বিমান বাহিনীর বিমান কেনার জন্য।
ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় যখন আর্জেন্টিনা ফকল্যান্ড দখল করে তখন আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধজাহাজকে জলে নামানো হয়। ১৩টি সি হ্যারিয়ার ও ১৮টি সিকিং হেলিকপ্টার নিয়ে এটি আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে মোতায়েন করা হয়। ১৯৮২ সালে এটি অবসর গ্রহণের পর ১৯৮৭ সালে ভারতীয় নৌবাহিনীতে এটির আবার সংযুক্তিকরণ ঘটে।
এতে ১২ডিগ্রী কোণের একটি স্কাই জাম্প ইনস্টল করা হয়েছিল যাতে সিহ্যরিয়ার জেট এর থেকে অপারেট করা যায়। সি-হ্যরিয়ার এর সংযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে ভারত এশিয়ার প্রথম দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে যার কাছে “ভার্টিকাল টেক অফ ও ল্যন্ডের” সক্ষম জেট আসলো। অর্থাৎ হ্যরিয়ার হেলিকপটারের মত সোজাসুজি টেকঅফ ও ল্যনন্ড করতে সক্ষম ছিল।
এই ধরনের বিমান গুলোর রানওয়ের প্রয়োজনও হয় না। যদিও টেক অফের সময় এটি রানওয়ে ব্যবহার করতো। এতে ফুয়েল এর ঘাটতি হত না। তবে এগুলো ল্যন্ড করার সময় হেলিকপটারের মত সোজাসুজি ল্যন্ড করতো।
ভারতীয় সি হ্যরিয়ার গুলো সি হ্যরিয়ার এফআরএস .৫১ ভ্যরিয়েন্ট ছিল। এটি পৃথিবীর অন্যতম সেরা সি হ্যরিয়ারের ভ্যরিয়েন্ট ছিল। এই ভ্যরিয়েন্টে ম্যজিক এয়ার টু এয়ার মিসাইল ও ডেরবি বিভিআর মিসাইল ইনস্টল করা হয়েছিল। আর এর সাথে এই বিমান গুলোতে এল্টা ২০৩২ মাল্টি ফাংশানাল রেডার লাগানো হয়েছিল। এই একই রেডার বর্তমানে তেজসে ইনস্টল করা হয়েছে। এ্যন্ট শিপ মিসাইল হিসাবে এগুলো সি ঈগল জাহাজ ধংসকারী মিসাইল বহন করতো।
ফকল্যন্ড যুদ্ধের সময় সি হ্যরিয়ার ছিল সব থেকে ভয়ংকর যুদ্ধ বিমান। একটি সি হ্যরিয়ারও আর্জেন্টিনা শুট ডাউন করতে পারে নি। অন্যদিকে সি হ্যরিয়ারের আক্রমণে আর্জেন্টিনা ২০টি ফাইটার হারায়। মিরাজ-৩ ও ডেগার জেটের তুলনায় সি হ্যরিয়ার অনেক ধীর গতীর হওয়া সত্ত্বেও সি হ্যরিয়ার অত্যন্ত ম্যনুয়েভারেবেল হওয়ার কারনে সি হ্যরিয়ার পুরো যুদ্ধের মোর পালটে দেয়।
সি হ্যরিয়ার ভারতের হাতে আসার কারনে সেই সময় পাকিস্তান যথেষ্ট ভয় পেয়েছিল। কারন পাকিস্তানের নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ গুলো প্রথমে বিক্রান্ত ও তার পর বিরাটের আক্রমনের চিন্তায় থাকতো। আর পাকিস্তান ভালোভাবেই জানতো সি হ্যরিয়ারের সমক্ষ আর ব্যটেল প্রুভেন ফাইটার তাদের কাছে নেই।
বিরাট আপগ্রেডের সময় দুটি একে-২০৩ মিসাইল ধ্বংসকারী ক্যনন, ১৬টি বারাক-১ সার্ফেস টু এয়ার মিসাইল, দুটি ৪০এমএম এর ক্যনন ইনস্টল করা হয়। বিভিন্ন আপডেটের পর এই আইএনএস বিরাট ১০৫০০কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে সক্ষম ছিল। মোট ১০টি হেলিকপটারের মধ্যে ৪টি সি কিং, ৪টি ধ্রুব ও ২টি চেতক ছিল। আইএনএস বিরাট আপগ্রেডের সময় একাধিক নতুন রেডার ও সেন্সারের পরিবর্তন করা হয়েছিল। আইএনএস বিরাটে ভারতের তৈরি অজন্তা ইলেকট্রনিক সাপোর্ট মেজর ইনস্টল করা হয় যা শত্রুর রেডার ও বিভিন্ন সেন্সরের ইনফরমেশান বিশ্লেষণ করতে সক্ষম ছিল। বহু দিন এটি ভারতীয় নৌবাহিনীর ফ্ল্যগশিপের কাজ করে।
কালের নিয়মে ধীরে ধীরে বৃদ্ধ হয় আইএনএস বিরাট। আর একই সঙ্গে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল এই জাহাজের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ। যার ফলে ভারতীয় নৌবাহিনীর স্থির করে এই জাহাজকে অবসরে পাঠানোর।
২০১৬সালের ২৩ শে জুলাই মুম্বাই থেকে কোচিতে যাওয়ার জন্য নিজের ইঞ্জিনে এই জাহাজটি শেষবারের মতো যাত্রা শুরু করে। আইএনএস বিরাট ২২৫০ দিন ভারতীয় নৌবাহিনীর হয়ে ভারতের জলসীমা পাহারা দেওয়ার পাসাপাশি সে মোট ১০,৯৪,২১৫কিমি পথ ভ্রমণ করেছিল। কোচিতে, ডিকমিশনের প্রস্তুতির জন্য বিরাট, এক মাসব্যাপী নিষ্ক্রিয়করণের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এই সময়ের মধ্যে, তার বয়লার, ইঞ্জিন, প্রপেলার এবং রাডারগুলি খুলে নেওয়া হয়েছিল।
নিষ্ক্রিয়করণ হয় ৪ সেপ্টেম্বরে, এবং ক্যারিয়ারটিকে তার আনুষ্ঠানিক ডিকমিশন অনুষ্ঠানের জন্য ২৩শে অক্টোবর মুম্বাইতে ফিরিয়ে আনা হয়। ৬ মার্চ ২০১৭ সালে বিরাটকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করা হয়। তার অস্ত্র এবং অপারেশনাল সরঞ্জামগুলি ২০১৭-এর মাঝামাঝি নাগাদ খুলে ফেলা হয়।
প্রথমে অনেকেই চায়নি আইএনএস বিরাট কে ভেঙে ফেলা হোক। অন্ধ্রপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র সরকার বহু চেষ্টা করেছিলেন জাহাজটিকে একটি সংরক্ষিত জাহাজ বা হোটেলে রূপান্তরিত করার। কিন্তু সমস্ত প্রচেষ্টা বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হয়। শেষে আইএনএস বিক্রান্ত এর মত আইএনএস বিরাট কেও ভেঙে ফেলা হয়। জুলাই ২০২০-এ, গুজরাট-ভিত্তিক শিপিং ফার্ম শ্রী রাম শিপিং মেটাল স্ক্র্যাপ কর্পোরেশন থেকে ₹৩৮.৫৪কোটি টাকায় (US$৫ মিলিয়ন) জাহাজটি কিনেছিল। তারপর বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটিকে ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হয়।
আইএনএস বিরাট ছিল এক সময় পাকিস্তানের ত্রাস। যা আজও তারা ভুলতে পারে না।