১৯৬২ সালের চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মেননের ভূমিকা এত রহস্যময় হওয়ার পেছনে কি কারন রয়েছে?
নিউজ ডেস্কঃ ভি.কে.কৃষ্ণ মেনন এমন এক ব্যক্তিত্ব যাকে ঘিরে গল্পকথার নেই কোনো অভাব। ১৯৫০-৬০ দশকের ভারতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন এই মেনন। ভারতের দ্বিতীয় সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনীতিবিদ হিসাবে পরিচিত ছিলেন তিনি। অনেকের কাছে সাক্ষাৎ দেবদূতের থেকে কিছু কম নন তিনি আবার অনেকের কাছে তিনি ছিলেন এক অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং দানবীয় ব্যক্তি। বিশেষত বিজেপি-আরএসএস তো তাকে সরাসরি” ১৯৬২ সালের ভিলেন”এরই তকমা দিয়ে দিয়েছে। তবে, কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা? কে এই মেনন, যাকে ঘিরে এতো রহস্য? তা বুঝতে গেছে আমাদের একমাত্র ভরসা কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের লেখা মেননের জীবনী।
মেননকে নিয়ে চমৎকার ভাবে গবেষণা করে তার লেখা ৭২৫ পাতার “এ চেকার্ড ব্রিলিয়ান্স’ পড়লে বোঝা যায় দেবদূত বা দানব কোনোটাই বলা চলে না তাকে। একদিকে তিনি যেমন ভারতের হয়ে জাতিসংঘে কাশ্মীর ইস্যু এক হাতে সামলেছেন তেমনি ১৯৫৫ সালে চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাইকে কোরিয়ান যুদ্ধের আমেরিকান বিমান বাহিনীর বন্দীদের ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করে নিজের দক্ষতার পরিচয় ও দিয়েছেন। অথচ ওই একই ব্যক্তি অপরদিকে ভারতের সবচেয়ে বিতর্কিত প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসাবে পরিচিত। যার নিকৃষ্ট মনোবৃত্তির পরিচয় সেনা জেনারেলদের সাথে তার আচরণেই বারংবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
চরম অহংকারী, ইন্সিকিওর এই ব্যক্তিই ১৯৩০ এর দশকে প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর পরম আত্মীয়তে পরিণত হয়ে ছিলেন।
তারা একে অপরের ঠিক কতটা কাছের মানুষ ছিলেন তা জানা যায় নেহেরুর মেননকে লেখা চিঠি থেকেই। চিঠিতে তিনি নিজের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে অনুযোগ করে মেননকে লিখেছিলেন, শারীরিক অসুস্থতার থেকে নিজের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েই সবথেকে বেশি বিচলিত তিনি। রমেশ অনুমান করেন সেই সময় নিশ্চয়ই ইন্দিরা গান্ধী তার কাছে ফিরোজ গান্ধীকে বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
মেননের গোটা রাজনৈতিক ক্যারিরারই আকর্ষণীয় হলেও ১৯৫৭-১৯৬২ সাল অব্দি যে পাঁচ বছর তিনি নেহেরুর মন্ত্রিসভায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে কাজ করেছেন তা আলাদা ভাবে উল্লেখিত হওয়ার দাবি রাখে। এই পাঁচ বছর একদিকে তিনি যেমন ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তেমনি অপরদিকে অসংখ্য বিতর্কের সঙ্গেও জড়িয়েছিলেন তিনি।
রমেশ মেননের “সবচেয়ে তুচ্ছ এবং নিকৃষ্ট” ব্যবহারের উদাহরণস্বরূপ তুলে ধরেছেন কিভাবে মেনন তৎকালীন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল পি.এন. থাপারকে তার নিজেরই প্রধান জেনারেল কে.এম. থিমাইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে বাধ্য করেছিলেন। থিমাইয়ার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস, প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য, অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সাথে বেআইনি যোগাযোগ সহ মোট ১৩ টি অভিযোগ এবং তার পছন্দের উত্তরসূরী হিসাবে পরিচিত লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস.পি.পি এর বিরুদ্ধে আরও পাঁচ দফা ‘চার্জ-শিট’ পেশ করা হয়।
নিজের ঊর্ধ্বতন এক অফিসার এবং নিজের সমকক্ষ এক সেনা অফিসারের কাছে লেখা চিঠিতে থাপার উল্লেখ করেছেন যে থিমাইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার বিষয়টি নিয়ে আগে থেকেই সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু। রমেশ সব দিক পর্যলোচনা করে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে এসেছেন যে মেনন থিমাইয়াকে মনে প্রাণে ঘৃনা করতেন আর তাকে নিজের পথ থেকে সরানোর প্রচেষ্টা স্বরূপ গোটা ঘটনায় তিনি জড়িয়ে নিয়েছিলেন নেহেরু এবং থাপারকেও।
তার বিরুদ্ধে ঘোরতর কোনো ষড়যন্ত্র চলছে সন্দেহে থিমাইয়া সঙ্গে সঙ্গে সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে সরাসরি রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের কাছে এক চিঠি লেখেন। তিনি ভালো ভেবেই জানতেন মেনন সুযোগ পেলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার পছন্দের থোরাতকে ভেটো দেবেন। থিমাইয়ার চিঠি পেয়ে রাষ্ট্রপতি তাৎক্ষণিক অনুমোদন করেন ঠিকই কিন্তু, সদ্য প্রতিষ্ঠিত দেশে তখনও কেওই সঠিক ভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। এমনকি প্রসাদ নিজেও। অপরদিকে নেহেরু ও মেনন বদ্ধপরিকর ছিলেন রাষ্ট্রপতির অনুমোদন রদ করতে। ফলত, যা হওয়ার তাই হয়। কালিমালিপ্ত হয় থিমাইয়ার নাম।
ইন্দো- চিন যুদ্ধের মাঝেই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে দেখা যায় ফাটল।একের পর এক ষড়যন্ত্রের তত্ব আসছিল সামনে। প্রথমে থিমাইয়া মেননের কাছে একটি চিঠি লিখে লেফটেন্যান্ট জেনারেল, এস.ডি. ভার্মার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তারপর, ভার্মাকে শাস্তিমূলকভাবে সরিয়ে দেওয়ার পরে, থিমাইয়া মেননের কাছে এসে জানান যে ভার্মাকে নিয়ে তার ধারণা ভুল ছিল। ভার্মার একমাত্র অসুবিধা ছিলো যে তিনি খুব একটা বেশি জনপ্রিয় ছিলেন না। মেনন নেহরুর কাছে লেখা চিঠিতে এই গোটা ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন।
এরপরেই পুনরায় কোপ নামে তামিলনাড়ুর ওয়েলিংটনে ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজের কমান্ডার আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা স্যাম মানেকশের ওপরে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আলগা কথা বলা এবং অ্যাংলোফিলিয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। বলা হয় মানেকশ তার অফিসে “ওয়ারেন হেস্টিংস এবং রবার্ট ক্লাইভের প্রতিকৃতি ঝুলিয়ে রেখেছিলেন”। মেননের নির্দেশে তদন্ত শুরু হলে তার ক্যারিয়ারও প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়ে। পরবর্তীকালে যদিও বা তদন্তে তার নাম পরিষ্কার হয়, নাহলে একাত্তরের ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো আজ।
সেই সময়ের সবচেয়ে বড় গল্পগুলির মধ্যে অন্যতম হলো একটি থিমাইয়া-বনাম-নেহরু, সেনা-বনাম-রাজনীতিবিদ লড়াই। বহু দশক ধরে লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে এক প্রকার গল্পকথাতেই রূপান্তরিত হয়েছে এটি। আর নরেন্দ্র মোদি তার শেষ কর্ণাটক প্রচারে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসাবে ঠিক এই গল্পকেই কাজে লাগিয়েছেন যে কিভাবে স্থানীয় নায়ক থিমাইয়াকে নেহরু চূড়ান্ত অপমান করেছিলেন।
রমেশের নথিগুলি বেশ কিছু চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে : প্রথমত, তার মতে, ১৯৫৯ সালে দ্য স্টেটসম্যান এ মহেশ চন্দ্রের লেখা বাইলাইনে থিমায়ার পদত্যাগের যে খবর ছাপানো হয় তা আদলে জেনারেল জে.এন. চৌধুরী (যিনি পরে সিওএএস হয়েছিলেন) এর লেখা ছিলো। তৎকালীন ব্রিটিশ মালিকানাধীন দ্য স্টেটসম্যানের জন্য এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সামরিক সংবাদদাতা হিসাবে বেনামে তিনি লেখালেখি করতেন বলেই রমেশের দাবি। সেই সূত্রেই পদত্যাগের অভ্যন্তরীণ সমস্ত খবর জেনে রিপোর্ট লিখলেও সেই সময়কার ভারতের শীর্ষ স্থানীয় এক জেনারেল হয়ে শীর্ষস্থানীয় কাগজের সামরিক সংবাদদাতা হিসাবে খবর লেখা সম্ভব না হওয়ায় নিজের লেখা খবর তিনি অন্যের নাম দিয়ে স্টেটসম্যান এ ছাপান।
দ্বিতীয়ত, তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার ম্যালকম ম্যাকডোনাল্ডের ব্যক্তিগত আর্কাইভ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নোট উদ্ধার করা গেছে, যেখানে থিমাইয়া মেননের সাথে তার সমস্ত মতবিরোধের কথা, নেহরু, পদত্যাগের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে আরো বেশ কিছু গুরু শ্রেণীবদ্ধ তথ্য তার সাথে ভাগ করে নিয়েছেন। এই নোট থেকেই জানা যায় থিমাইয়ার মতে, মেনন ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানকে ভারতের প্রধান শত্রু হিসাবে দাঁড় করিয়ে চীনের দিক থেকে ভারতের নজর সরিয়ে দিয়েছেন যেখানে হওয়া উচিত ছিল ঠিক উল্টোটা। আর থিমাইয়ার সাথে হওয়া এই যাবতীয় কথোকথনই ম্যাকডোনাল্ড সরাসরি লন্ডনে রিপোর্ট করছিলেন।
এবং তৃতীয়ত, সত্যিই ১৯৬২ সালে নেহেরু এবং মেনন যদি থিমায়ার কথা শুনতেন তবে ওই যুদ্ধে ভারতকে হারতে হয়তো হতো না। তিনি দুর্ধর্ষ কোনো যোদ্ধা ছিলেন বলে নয় বরং যথেষ্ট বিচক্ষণ এক ব্যক্তি ছিলেন বলে। এমনকি অবসর গ্রহণের পাঁচ মাস পরেও তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন – যুদ্ধক্ষেত্রে চীনা সেনাবাহিনীর হাত থেকে ভারতকে রক্ষা করার কোনো উপায় নেই। সেনাবাহিনী নয় বরং দেশেরএটি রাজনীতিবিদ এবং কূটনীতিকদেরই করতে হবে এই সমস্যার সমাধান।
নেহেরুর বিভ্রান্তি ও বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে সব কিছুতেই ষড়যন্ত্রের তত্ব খোঁজা মেনন যে একপ্রকার ভাবে তাকে ভুল পথে চালনা করেছিলো সে নিয়ে এখন আর কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু, ইন্দো- চীন যুদ্ধের দায়িত্ব সেইবসময় পুরোপুরি জেনারেলদের ওপর ছেড়ে দিলে যুদ্ধে ভারত বেশি ভালো ফল করতো