ভারত

তবে কী সত্যিই ভারত ও জাপান যৌথ ভাবে যুদ্ধবিমান তৈরি করবে?

বর্তমানে বিশ্বের সব শক্তিশালী দেশ নিজেদের মধ্যে অলিখিত প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যদি রাশিয়া কোন অস্ত্র তৈরি করে, আমেরিকা তার থেকেও অত্যাধুনিক অস্ত্র তৈরি করছে পাশাপাশি চীন ও সমান তালে তাল মেলাচ্ছে। অর্থাৎ এই যে অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা তা কোনওদিন শেষ হবে না চলতেই থাকবে। এতে বিপুল অর্থ ব্যায় হয়। অনেকে সবচেয়ে ভাল হয় এসব বিপুল অর্থ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরিতে ব্যবহার করলে, কারন মানবসভ্যতার জন্য শান্তি দরকার। দেখুন সবাই শান্তি চায় কিন্তু বাস্তব বড়ই কঠিন। যুদ্ধ ছাড়া কখনও শান্তি আসে না, আজকের দিনে দাড়িয়ে এটাই সবচেয়ে বড় সত্যি। ইউরোপের একটি উন্নত দেশ সুইজারল্যান্ড, যারা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তেমন ভাবে না, এরা নিজেদের উন্নতিতেই জোর দেয়, এবার তাহলে অনেকেই বলবেন আমাদের সুইজারল্যান্ডকে অনুসরন করা দরকার। দেখুন এটা সবচেয়ে বড় ভুল, কারন সুইজারল্যান্ডের অবস্থান ও ভারতের অবস্থানে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ভারতের একদিকে চীন, অন্যদিকে পাকিস্তান, ভারত মহাসাগরের মত বানিজ্য রুট, এর সাথে রয়েছে সন্ত্রাসবাদী দের সাথে লড়াই। সেজন্য ভারতকে বাধ্য হয়ে প্রতিরক্ষা সেক্টরে প্রচুর খরচ করতে হয়। বর্তমানে বিশ্বের পরিস্থিতি এমনই যে অস্ত্র দরকারই। যেমন চীনকে প্রতিরোধ করবার জন্য ভারত ও জাপান উভয়ই তাদের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান তৈরিতে মন দিয়েছে। চীনের কাছে ইতিমধ্যে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান রয়েছে কিন্তু জাপান ও ভারতের কাছে চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান আছে। ভারত আমকা নামে একটি ফাইটার জেট তৈরি করছে যা পঞ্চম প্রজন্মের থেকেও অ্যাডভান্সড ৫.৫ জেনারেশনের হতে চলেছে এবং জাপান মিতসুবিশি এফ এক্স নামে একটি বিমান তৈরি করছে যা ষষ্ঠ প্রজন্মের হতে চলেছে। চীনের বিরুদ্ধে জাপন ও ভারতের জোট গঠন সবচেয়ে বেশী জরুরী। আজ এই দুই প্রজেক্ট এবং উভয় দেশের মধ্যে জোট গঠনের সম্ভাব্য দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। তবে কী সত্যিই ভারত ও জাপান যৌথ ভাবে যুদ্ধ বিমান তৈরি করবে?? এর উত্তর হচ্ছে না। জাপান প্রতিরক্ষা সেক্টরে কেন এত জোর দিয়েছে? আসুন জানা যাক।

সম্প্রতি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং জাপানীজ প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা কোয়াড বৈঠকের শেষে আলোচনা করেন পারস্পরিক সম্পর্ক আরও মজবুত করার মাধ্যমে মিলিটারি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার। যা শুনে বিশ্বের মিডিয়ার একাংশ দাবি করছে ভারত ও জাপান উভয়ই চীনকে কাউন্টার করার জন্য পরবর্তী প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান তৈরি করছে, হয়ত দুই একসাথে একই প্রজেক্টে কাজ করছে। জাপান সম্প্রতি জানিয়েছে তার ১২ টি দেশকে মিসাইল, যুদ্ধবিমান রপ্তানি করবে যাতে চীনের বিরুদ্ধে ডিটারেন্স রাখা যায়। ডিটারেন্স মানে এতটাই শক্তি অর্জন করা যাতে অন্য কেউ আক্রমনের আগে দশ বার ভাবে। সম্প্রতি সবচেয়ে বড় গ্লোবাল টপিক হচ্ছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধে রাশিয়াকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে চীন। রাশিয়ার উপর ইতিমধ্যেই অনেক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে কিন্তু তাও রাশিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় সবচেয়ে বেশী আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তাইওয়ানকে নিয়ে। চীন যদি তাইওয়ানকে আক্রমন করে তাহলে সবচেয়ে বড় অস্বস্তিতে পড়বে জাপান ও আমেরিকা। কারন এশিয়াতে আমেরিকার সবচেয়ে বড় বন্ধু দেশ জাপান এবং এই এলাকা জুড়ে জাপান ও আমেরিকার নেভি মজুত আছে। 

রাশিয়ার মত নিষেধাজ্ঞা চীনকে দেওয়া যাবে না কারন আমেরিকা ও ইউরোপের অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভর করে চিনের উপর, চীন এটা খুব ভাল ভাবেই জানে। চীন ইতিমধ্যে জানিয়েছে তাইওয়ানকে নিয়ে কেউ হস্তক্ষেপ করলে পরমানু যুদ্ধ হতে পারে। চীন ও জাপানের মধ্যে বিতর্কিত একটি দ্বীপ রয়েছে যাকে সেনকাকু দ্বীপ বলা হয়। সম্প্রতি এখানে চীন তাদের উপকূল রক্ষী বাহিনীর চারটি জাহাজ পাঠিয়েছে। যা নিয়ে চীন ও জাপানের মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। দক্ষিন চীন সাগর নিয়ে ইতিমধ্যেই ঝামেলা আছে চীনের সাথে। চীন এখামে স্পার্টলি ও প্যারাসেল দ্বীপকে নিজের বলে দাবি করে এই এলাকার প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম নিজেই নিতে চায় যা নিয়ে বিধোধীতা তৈরি হয়েছে ভিয়েতনাম, ব্রুনেই, ইন্দোনেশিয়ার মত দেশের সাথে। এদের দাবি চীন আন্তর্জাতিক ইইজেড কে মানছে না। ইইজেড বা এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন কোনও দেশের সমুদ্র উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল এলাকা। কোয়াড অর্থাৎ আমেরিকা, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে এই এলাকায় তারা ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে এবং সারভিলেন্সে বিশেষ জোর দেওয়া হবে। পরবর্তী প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান এই সারভিলেন্সের কাজটা সবচেয়ে ভাল করতে পারবে। চীন দক্ষিন চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে তাতে পঞ্চম প্রজন্মের জে-২০ বিমান মোতায়েন রেখেছে। সুতরাং এর কাউন্টারে পঞ্চম প্রজন্মের বিমানই দরকার। এবার মনে হতে পারে ডিফেন্সে এত বিনিয়োগে কী লাভ হবে? দেখুন প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগের তিনটি প্রধান সুবিধা এমআইসি বা মানি, ইনফ্লুয়েন্স, কোঅপারেশন। দেখুন যদি অ্যাডভান্সড অস্ত্র তৈরি করা যায় তহলে ভবিষ্যতে সেগুলে বিক্রি করে অনেক অর্থ পাওয়া যাবে। শক্তিশালী যত হওয়া যাবে আশেপাশের দেশ গুলো সেই দেশের সাথে জোট করতে আসবে, এটা হচ্ছে ইনফ্লুয়েন্স এবং শক্তিশালী হলে আশেপাশের দেশ গুলো নিরাপত্তার জন্য সেই দেশের উপর নির্ভরশীল হবে এবং বিনময়ে সেই দেশটির অর্থনীতি সাহায্য করবে।

চীনের হাতে রয়েছে চেংদু জে-২০ পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান। চেংদু চীনের সিচুয়ান প্রদেশে অবস্থিত এখানেই জে-২০ তৈরি হয়। এর কাউন্টারে ভারত শুরু করেছে আমকা পোগ্রাম। আমকার দুটি ভাগ রয়েছে আমকা মার্ক ১ ও মার্ক ২. মার্ক ১ হচ্ছে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান কিন্তু মার্ক ২ হচ্ছে ৫.৫ জেনারেশন যুদ্ধ বিমান যাতে ষষ্ঠ প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য থাকবে। আমকার ব্যপারে সবাই অনেক কিছু জানেন তাই এর ব্যাপারে ডিটেইলস, টেকনিক্যাল ডিটেইলস বলা হচ্ছেনা। শুধু কিছু প্রাথমিক তথ্য। আমকা স্টেলথ যুদ্ধ বিমান যা রেডারে ডিটেক্ট করা মুশকিল। এী জন্য বিমানের গঠন বিশেষ ভাবে করা হয়েছে এবং বিমানের উপর স্টেলথ কোটিং ব্যবহার করা হয়েছে। আমকা তে ইন্টারন্যাল ওয়েপনস বে রয়েছে। আমকা সুপারক্রুজ করতে পারে। ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস সিনেমা দেখেছেন? দেখবেন রেসে একটা সময় গাড়ির একটি বিশেষ সুইচ টিপে দিলে একসাথে নয়টি সিলিন্ডার খুলে গিয়ে গাড়ি বিশাল গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, সুপারক্রুজ এমনই। ২০৩০ এ আমকা মার্ক ১ সার্ভিসে আসবে এবং ২০৩৪ এ আমকা মার্ক ২ আসবে। প্রাথমিকভাবে ভারত ৪০ টি মার্ক ১ ও ১০০ টি মার্ক ২ ভার্সন ক্রয় করবে। আমলা স্টেলথ ও নন স্টেলথ উভয় ভার্সনেই থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা আমকার মার্ক ২ ভার্সনের কিছু বিমান আনম্যানড বা ড্রোনের মতন হবে। মার্ক ১ এ আমেরিকার জেনারেল ইলেকট্রিকের জিই -৪১৪ ইঞ্জিন ব্যবহার হবে এবং মার্ক ২ তে নতুন ইঞ্জিন ব্যবহৃত হবে৷ এই মহূর্তে বিশ্বে আমেরিকা (এফ-৩৫ ও এফ-২২), রাশিয়া (এসইউ-৫৭) এবং চীনের(জে-২০) কাছে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান আছে, ভারত চতুর্থ দেশ হতে চলেছে। বলা হচ্ছে আমেরিকা তাদের এফ-৩৫ বিমানের কীছু প্রযুক্তি দিয়ে ভারতের আমকা প্রজেক্টে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু আমেরিকা তাদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কাউকে দেয় না। তবে বলা হচ্ছে যেহেতু ভারত ও আমেরিকার শত্রু একটাই দেশ চীন তাই আমেরিকা হয়ত কিছু ব্যাবস্থা করতেও পারে। জাপান ও ভারতের জোট যুদ্ধ বিমান তৈরি করবার জন্য করা সম্ভব না কারন এর পূর্বে জাপান ও ভারতের কোন যৌথ প্রজেক্ট নেই সুতরাং উভয়ের টেকনোলজি আলাদা। ফলে নতুন করে সব সিস্টেম তৈরি করতে হবে যা সম্ভব না। যেমন ভারত তেজস মার্ক ১ তৈরি করছে এর জন্য ভারত নিজস্ব এরো ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করেছে। সুতরাং আমাদের নিজস্ব ইকো সিস্টেম রয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং ও জানিয়েছেন প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ভার স্বনির্ভর হবে।

বাকী সমস্ত দেশ যখন পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান তৈরি করছে জাপান তখন একবারে ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান প্রজেক্ট শুরু করেছে। তবে জাপানই প্রথম নয়, এর আগে আমেরিকাও ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান তৈরি শুরু করেছে। যাই হোক আজ জাপানকে নিয়ে আলোচনা করা হবে। জাপানযে ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান তৈরি করছে তার নাম এফ ৩, জাপানের বিখ্যাত টেকনোলজি জায়েন্ট মিতসুবিশি এই প্রজেক্ট শুরু করেছে, একে এফ-এক্স প্রজেক্ট ও বলা হয়। জাপানের সেল্ফ ডিফেন্স এয়ারফোর্সের জন্য তৈরি এই বিমান ২০৩০ এর মধ্যে মিতসুবিশি এফ-২ কে রিপ্লেস করবে। যদি এই এফ-এক্স পোগ্রামের কথা বলা হয় তাহলে এটি শুরু হয় আমেরিকার কারনে৷ জাপান প্রথমে এফ-২২ রেপ্টর কিনতে কিন্তু ১৯৯৭ সালেই আমেরিকা এফ-২২ রেপ্টর বিক্রি ব্যান করে দিয়েছে সেজন্য জাপান নিজস্ব একটি পরবর্তী প্রজন্মের বিমান তৈরির পরিকল্পনা করে যা তাদের এফ-২ কে রিপ্লেস করবে। ২০০৯ এ জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এব্যাপারে আলোচনা শুরু করে। এফ-এক্স পোগ্রামের ডেভলপমেন্ট শুরু হয় মিতসুবিশির এক্স-২ সিনসিন থেকে। ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল এক্স-২ সিনসিনের প্রথম ফ্লাইট টেস্ট হয়। এফ এক্স পোগ্রামের জন্য জাপান বিশেষ সেন্সর তৈরি করেছে যা তারা এফ-২ ফাইটার জেটের উপর পরীক্ষা করেছে। তবে এই পোগ্রাম জাপান একা শুরু করে নি। ২০১৭ সালে ব্রিটেন জাপানের সাথে চুক্তি করে এই প্রজেক্টের জন্য। ব্রিটেন ও জাপান সম্ভবত ব্রিটেনের ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান টেম্পেস্ট প্রজেক্টেও যুক্ত হবে। ব্রিটেনের পাশাপাশি আমেরিকার বোয়িং তাদের এফ-১৫ এর আপগ্রেডেড ভার্সন, লকহিড মার্টিন এফ-২২ ও এফ-৩৫ এর হাইব্রিড ভার্সন, নর্থ্রুপ গ্রুম্যান তাদের ওয়াইএফ-২৩ এবং বেয়েই সিস্টেম তাদের ইউরোফাইটার টাইফুন ভার্সন অফার করে জাপানকে কিন্তু জাপান না করে দেয়। লকহিড মার্টিনের হাইব্রিড ভার্সন জাপানের একটু পচ্ছন্দ হয়েছিল কিন্তু বিমানটির দাম অত্যাধিক বেশী প্রায় ১৭৭ মিলিয়ন ডলার প্রতি ইউনিট, যার জন্য জাপান না করে দেয়।

২০২০ সালে মিতসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজকে এই বিমান তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই প্রজেক্ট সম্পর্কে যথেষ্ট গোপনীয়তা বজায় রেখেছে জাপান। মোটামুটি ২০২৪ সালে এই বিমানের প্রথম প্রোটোটাইপের ফ্লাইট টেস্ট হবে এবং ২০৩১ সালে এটির সার্ভিসে আসার কথা। জাপানের মোট ৪৮ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে এই প্রজেক্টে।

ভারতের আমকা ও জাপানের এই এফ ৩ ভবিষ্যতে চীনকে যে যথেষ্ট চাপে ফেলবে সে বিষয় কোনও সন্দেহ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published.