পৃথিবী

কিভাবে নাজি জার্মানির হাত থেকে রোমকে মুক্ত করা হয়েছিল?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির প্রধান দুই শক্তি ছিল জার্মানি ও ইতালি। ১৯৪৩ সাল আসতে আসতে ইতালিতে ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান বেনিটো মুসোলিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠা শুরু হয়। ১৯৪৩ সালেই বেনিটো মুসোলিনীকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে গ্রেফতার করা হয়। এইসময়ে মিত্রশক্তিও ইতালির উপকূলে পৌঁছে যায় ইতালি দখলের জন্য। তখন ইতালির নতুন সরকার মিত্রশক্তির পক্ষে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই খবর জানতে পেরে জার্মানির নাজি সেনার প্রধান অ্যাডলফ হিটলার নাজি সেনাকে আদেশ দেয় যে করেই হোক বেনিটো মুসোলিনীকে মুক্ত করে আনতে। হিটলার জানতো মুসোলিনী না থাকলে ইতালি মিত্রশক্তির পক্ষে যোগ দেবে এবং মিত্রশক্তি খুব সহজেই জার্মানি আক্রমন করবে। নাজি সেনা এক দুর্ধর্ষ অপারেশনের মাধ্যমে মুসোলিনীকে মুক্ত করে ফেলে কিন্তু ততদিনে ইতালিতে মুসোলিনীর প্রভাব কমে গিয়েছিল। দক্ষিন ইতালিতে হিটলার মুসোলিনীর নেতৃত্বে একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করেছিল যদি সেই সরকারের আগের মতো ক্ষমতা ছিলনা। মিত্রশক্তি যাতে ইতালি দখল করতে না পারে সেকারনে হিটলার নাজি জার্মান সেনাকে নির্দেশ দেয় ইতালি দখল করতে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির নৌবাহিনীভ চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়ায় মিত্র শক্তির কাছে। আফ্রিকা অভিযান চলাকালীনই মিত্র শক্তি ঠিক করে ইতালিতে একটা সেনা অভিযান হবে যাতে ইতালিকে জার্মানির জোট থেকে বের করা যায়। ইতালি অক্ষ শক্তি থেকে বেরিয়ে গেলেই ভূমধ্যসাগরে ইতালির নৌবাহিনী মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবেনা। যার ফলে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর আধিপত্য পুনরায় ভূমধ্যসাগরে ফিরে আসবে এবং মিশর সহ এশিয়ায় নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখা যাবে। ইতালি অভিযানের শুরু হয় ১৯৪৩ সালের ৯ জুলাই অপারেশন হাস্কির মাধ্যমে। এই অপারেশনে আমেরিকান জেনারেল জর্জ এস প্যাটন এবং ব্রিটিশ জেনারেল বার্নাড মন্টগোমারির নেতৃত্বে আমেরিকার সপ্তম স্থলসেনা এবং ব্রিটেনের অষ্টম স্থলসেনা ইতালির সিসিলি আক্রমন করে। মিত্র শক্তির অভিযানের খবর পেয়েই ইতালির নতুন সরকার ৮ সেপ্টেম্বর ঘোষনা করে তারা মিত্র শক্তির পক্ষে যোগ দেবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল মিত্র শক্তিকে নির্দেশ দিয়েছিল যে ভাবেই হোক ইতালিকে দখল করতেই হবে। সিসিলি দখলের পর ইতালিতে দ্বিমুখী অভিযানের পরিকল্পনা করে মিত্র শক্তি। ঠিক হয় জেনারেল ক্লার্কের নেতৃত্বে আমেরিকার  সেনাবাহিনী ইতালির সালের্নোতে অভিযান শুরু করবে যার নাম দেওয়া হয় অপারেশন অ্যাভালান্স এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনী টরান্টোতে অভিযানে যাবে যার নাম দেওয়া হয় অপারেশন স্ল্যাপস্টিক। জেনারেল ক্লার্ক ভেবেছিল সালের্নোতে তেমন কোন যুদ্ধ হবেনা কারন ইতালি মিত্র শক্তির পক্ষে যোগ দিয়েছে কিন্ত ৯ সেপ্টেম্বর জেনারেল ক্লার্ক যখন তার সেনা নিয়ে সালের্নোতে পৌঁছায় তখন ব্যাপক ফায়ারিং এর স্বীকার হয় তার সেনাবাহিনী কারন সেখানে জার্মান নাজি সেনা ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারি নিয়ে অপেক্ষা করছিলো। তিনদিন ধরে আমেরিকা ও জার্মান সেনার মধ্যে লড়াই হয় সালের্নোতে, চতুর্থ দিনে আমেরিকার যুদ্ধজাহাজ ও মিত্র শক্তির বায়ুসেনার ফায়রিং জার্মান সেনা পীছু হটে। 

ভৌগলিক ভাবে ইতালির অবস্থান এমন যে দেশটির চারদিকে সুউচ্চ পর্বত এবং নদী রয়েছে যা ইতালিকে প্রাকৃতিক ভাবে ঢাল হিসাবে রক্ষা করে, এই প্রাকৃতিক ঢাল জার্মান সেনাবাহিনীকে ব্যাপক সুবিধা দেয়। সালের্নো এবং টরান্টো থেকে মিত্র শক্তি ধীরে ধীরে পশ্চিমে এগোতে শুরু করে তখনই তাদের সামনে একটি বিশাল জার্মান প্রতিরোধ আসে যার নাম ছিল গুস্তাভ লাইন। টাইরেনিয়ান সাগর থেকে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর পর্যন্ত ১৬১ কিলোমিটার লম্বা বিস্তৃত এই গুস্তাভ লাইন ছিল জার্মানির সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ শক্তি। এই গুস্তাভ লাইন জার্মানি এমন ভাবে তৈরি করেছিল যার সামনে ছিল বেশ কীছু নদী, নদী পার হয়ে এলে পার্বত্যভূমি, সবচেয়ে বড় পর্বত ছিল ক্যাসিনো পর্বত, সেখানে জার্মান আর্টিলারি, মেশিনগান সহ জার্মান সেনা রীতিমতো লুকিয়ে ছিল যা নীচে থেকে দেখা যেতনা। মিত্র শক্তি যখনই নদী পেরিয়ে গুস্তাভ লাইনে প্রবেশ করতো পাহাড়ের উপর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালাতে শুরু করে জার্মান নাজি সেনা। যার কারনে প্রথম কয়েক দফায় কয়েক হাজার মিত্র শক্তির সেনা মারা যায়। গুস্তাভ লাইনে যুদ্ধ চলতে চলতে ডিসেম্বর মাস এসে যায়, তীব্র বরফপাতে কিছুই ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিলনা সামনে। মিত্র শক্তির মোনোবল ভেঙে পড়ে। বাধ্য হয়ে উইনস্টন চার্চিল নতুন ভাবে গুস্তাভ লাইন ভাঙার নির্দেশ দেয়। ঠিক হয় টাইরেনিয়ান সাগর হয়ে ঘুরে গিয়ে আনজিও দিয়ে মিত্র শক্তির একটি দল পেছন থেকে গুস্তাভ লাইন আক্রমন করবে অর্থাৎ দুই দিকে দিয়ে গুস্তাভ লাইনকে ঘিরে ফেলে আক্রমন করা হবে। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় অপারেশন শিঙ্গল। এই অপারেশন শিঙ্গলের দায়িত্ব দেওয়া হয় জেনারেল ক্লার্ককে। জার্মানরা জানতেও পারেনি মিত্র শক্তি পিছন দিক দিয়ে ঘুরে এসে আক্রমন করবে। এই মিশনে জেনারেল ক্লার্ককে বলা হয়েছিল আনজিও এর সমুদ্রতীরে পৌঁছেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আক্রমন করতে হবে জার্মান নাজি সেনাকে। কিন্ত জেনারেল ক্লার্ক আনজিও পোঁছে আক্রমন করার বদলে প্রথম কিছুদিন আনজিও এর সমুদ্রতীরে নিজের বেসক্যাম্প তৈরি করে, ততদিনে জার্মানরা বুঝে ফেলে মিত্র শক্তি পিছন দিক দিয়ে আক্রমন করার চেষ্টা করছে। সাথে সাথে জার্মান সেনার একটা বিভাগ গুস্তাভ লাইন থেকে আনজিওর দিকে যাত্রা শুরু করে। তিন থেকে চারদিনের মধ্যে মিত্র শক্তির থেকেও অধিক জার্মান সেনা আনজিওর কাছে চলে আসে এবং ভারী আর্টিলারি, মেশিনগান দিয়ে আক্রমন শুরু করে মিত্র শক্তির উপর। আবারও জেনারেল ক্লার্ক ও তার বাহিনী ফেঁসে যায় জার্মান সেনার সামনে। অন্যদিকে গুস্তাভ লাইনের সামনে মিত্র শক্তি পাহাড়ের একদম উপরে একটি বাড়ি দেখতে পায়। মিত্র শক্তি ভাবে এখান দিয়ে নাজি সেনা গুস্তাভ লাইনে নজরদারি করে। পাহাড়ের মাথায় ওই বাড়ি বোম্বিংএ ধ্বংস করে দেয় মিত্র শক্তির বায়ুসেনা। কিন্ত ওই বাড়িটি ছিল মন্টে ক্যাসিনো যা ইতালির একটি পবিত্র ধর্মীয় স্থান, এখানে কোন জার্মান সেনা ছিলনা৷ মন্টে ক্যাসিনো ধ্বংসের খবর জার্মানরা ফলাও করে প্রচার করে মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে এবং ইতালির সাধারন মানুষের একাংশ ক্ষুব্ধ হয় মিত্র শক্তির উপর। অপারেশন শিঙ্গেল ব্যার্থ হবার পর গুস্তাভ লাইন ভাঙবার জন্য নতুন করে প্রচেষ্টা শুরু করে মিত্র শক্তি। এবার পোল্যান্ড, ব্রাজিল থেকেও সেনা এসে যোগ দেয় গুস্তাভ লাইন ভাঙবার জন্য। অবশেষে ১১ মে, ১৯৪৪ সালে অপারেশন ডায়াডোমের মাধ্যমে গুস্তাভ লাইন ভেঙে দেয় মিত্র শক্তি এবং সেখান দিয়ে মিত্র শক্তির সেনাবাহিনী প্রবেশ করতে শুরু করে। এই খবর পাওয়ার পরই জার্মান কম্যান্ডার অ্যালবার্ট কেসেলরিং আনজিও থেকে জার্মান সেনাকে গুস্তাভ লাইনের দিকে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়। 

জার্মান সেনাবাহিনী আনজিও থেকে ফিরে আসায় জেনারেল ক্লার্ক ও তার সেনাবাহিনীর উপর চাপ কমে যায়। জেনারেল ক্লার্ককে নির্দেশ দেওয়া ছিল গুস্তাভ লাইন ভেঙে গেলে পেছনে থেকে জার্মান সেনাবাহিনীকে ঘিরে ফেলতে। এই পরিকল্পনা তৈরি করেছিল ব্রিটিশ জেনারেল হ্যারল্ড আলেকজান্ডার। জেনারেল ক্লার্ক ছিল আমেরিকান সেভাবে জার্মান সেনাবাহিনীকে ঘিরে ফেললে সম্পূর্ন কৃতিত্ব ব্রিটিশদের হবে। সেকারনে জেনারেল ক্লার্ক এমন কিছু করতে চাইছিলো যাতে আমেরিকানদের কৃতিত্ব বাড়বে। জেনারেল ক্লার্ক রোমকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং আসল পরিকল্পনা থেকে সরে এসে জেনারেল ক্লার্কের নেতৃত্বে আমেরিকান সেনা রোমের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। জার্মান কম্যান্ডার অ্যালবার্ট কেসেলরিং বুঝে যায় রোমকে আর নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব নয় কারন পুরো জার্মান সেনা গুস্তাভ লাইনে ব্যস্ত ছিল। সেকারনে ২ জুন কেসেলরিং রোমকে মুক্ত শহর ঘোষনা করে দেয়। ৩ জুন আমেরিকান সেনা রোমে প্রবেশ করে এবং রোম মিত্র শক্তির নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। রোম অক্ষ শক্তির প্রথম কোন রজধানী শহর যা মিত্র শক্তি মুক্ত করেছিল। তবে রোম মুক্ত করার পরও মিত্র শক্তির ইতালি অভিযান তাড়াতাড়ি শেষ হয়নি, আরও এক বছর ইতালিতে জার্মান নাজি সেনার সাথে যুদ্ধ হয়েছিল মিত্র শক্তির। অ্যালবার্ট কেসেলরিং গুস্তাভ লাইন ভেঙে যাওয়ার পর রোমের আরও উপরে উঠে যায় এবং গথিক লাইন নামে আরেকটি প্রতিরোধ গড়ে তোলে, এখনেও ব্যাপক লড়াই হয় উভয়পক্ষের।

Leave a Reply

Your email address will not be published.