পৃথিবী

আফ্রিকান দেশগুলো ব্রিটেনের থেকে স্বাধীনতা লাভ করতে কি করেছিল?

এশিয়া মহাদেশের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশ হল আফ্রিকা মহাদেশ। ৩০.৩ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিশিষ্ট এই মহাদেশ বিশ্বের ২০ কুড়ি শতাংশ এলাকা জুড়ে অবস্থিত। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী আফ্রিকা মহাদেশের মোট জনসংখ্যা ১.৪ বিলিয়ন যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ। ইউরোপীয়ান দেশগুলো যখন নতুন নতুন ভূখন্ড আবিস্কার ও সেখানে ঔপনিবেশবাদের সূচনা করে তখন প্রথমে এই আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর ও দক্ষিন ভাগকেই খুঁজে পেয়েছিল ইউরোপীয়ানরা,পুরো মহাদেশের অভ্যন্তরে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় লেগে যায় ইউরোপীয়ানদের। তবে এই মহাদেশও একটা সময় ঔপনিবেশবাদের স্বীকার হয়, চামড়ার রঙের কারনে বারবার বৈষম্য, অত্যাচারের স্বীকার হয়েছে এখানকার মানুষ। ক্রীতদাস প্রথা সহ একাধিক নরসংহার হয়েছে এখানকার মানুষদের সাথে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন, ডাচ সহ প্রায় সমস্ত ইউরোপীয়ান শক্তিগুলোই এখানকার মানুষদের শোষন করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ছাড়া বাকী সমস্ত শক্তিশালী দেশগুলোর অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়ে, বিশেষ করে ইউরোপ পুরো বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ব্রিটেন, ফ্রান্স সহ ইউরোপীয়ান সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে, এই কারনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশবাদ শেষ হয়ে যায় এবং ঔপনিবেশিক দেশগুলো স্বাধীনতা লাভ করে। বিশেষ করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ব্রিটেনও বাধ্য হয় তার উপনিবেশগুলোকে স্বাধীনতা দিতে, আফ্রিকান দেশগুলোও ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এইসময়।

১৯৪৫ সালে ব্রিটেনের সাধারন নির্বাচনে উইনস্টন চার্চিলের কনজারভেশন দল পরাজিত এবং লেবার দল ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় এসেই লেবার দল ঠিক করে আফ্রিকাতে তাদের উপনিবেশ দেশগুলোকে স্বাধীনতা দেবে। কারন ১৯৪২ সাল থেকেই আফ্রিকাতে জাতীয়তাবাদ তীব্র আকার ধারন করে। আমেরিকা, ব্রিটেন সহ ইউরোপীয়ান দেশগুলো থেকে আফ্রিকান বুদ্ধিজীবিরা দেশে ফিরে গিয়ে সাধারন মানুষকে জাতীয়তাবাদে উদ্ভুদ্ধ করছিলো। লেবার দল বুঝে যায় এখন স্বাধীনতা দিলে এইসব দেশগুলো ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবং তাদের সাথে ইংল্যান্ডের বানিজ্যিক সম্পর্ক বজায় থাকবে কিন্তু দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে এই দেশগুলো স্বাধীনতান পেলে ভবিষ্যতে সেখানে ব্রিটেনের কোনও প্রভাব থাকবেনা। ইংল্যান্ডে সেসময় নব্য ঔপনিবেশবাদ কথাটি খুব প্রচলিত ছিল যার অর্থ দীর্ঘ সংঘর্ষের আগেই উপনিবেশ গুলোকে স্বাধীনতা দেওয়া যাতে দেশগুলো স্বাধীন হওয়ার পরেও সেখানে ব্রিটিশদের প্রভাব থাকে। আফ্রিকা মহাদেশের স্বাধীনতাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, প্রথম ভাগে রয়েছে পশ্চিম আফ্রিকার গোল্ড কোস্ট, নাইজেরিয়া, সিয়েরা লিওন, গাম্বিয়ার মতোন দেশ, এখানে ব্রিটিশদের সংখ্যা কম ছিল যার জন্য এখানে ব্রিটিশরা তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা দিয়েছিল। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে পূর্ব আফ্রিকার তাঙ্গানিকা, কেনিয়া, উগান্ডার মতোন দেশ, এখানে বিশেষ করে কেনিয়াতে অধিক সংখ্যায় ব্রিটিশরা বসবাস করতো। তৃতীয় ভাগে রয়েছে মধ্য আফ্রিকার নাসাল্যান্ড, উত্তর ও দক্ষিন রোডেসিয়ার মতোন দেশ, দক্ষিন রোডেসিয়াতে সবচেয়ে বেশী ব্রিটিশ লোক বসবাস করতো। পশ্চিম আফ্রিকাতে সাহারা মরুভূমির দক্ষিনে অবস্থিত গোল্ড কোস্ট প্রথম আফ্রিকান দেশ যারা স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৫৭ সালে, এরপর দেশটির নতুন নাম হয় ঘানা। ঘানার পর নাইজেরিয়াকে স্বাধীনতা দেওয়া হয় ১৯৬০ সালে। আফ্রিকা মহাদেশে ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় উপনিবেশ ছিল এই নাইজেরিয়া কিন্তু নাইজেরিয়া তিন ভাগে বিভক্ত ছিল যেখানে আলাদা আলাদা উপজাতি সম্প্রদায় বসবাস করতো। এজন্য নাইজেরিয়ার স্বাধীনতায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে ব্রিটেন, নাইজেরিয়ার জন্য বিশেষ সংবিধানও তৈরি করা হয় কিন্তু যা আশঙ্কা করা হচ্ছিল তাই হয় অর্থাৎ স্বাধীনতার পর নাইজেরিয়াতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পশ্চিম আফ্রিকার বাকী দুই দেশ সিয়েরা লিওনকে ১৯৬১ সালে এবং গাম্বিয়াকে ১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা দেয় ব্রিটিশরা, এভাবে পশ্চিম আফ্রিকা ব্রিটেনের থেকে পূর্ন স্বাধীনতা পায়। পূর্ব আফ্রিকাতে ইউরোপীয়ান ও এশিয়ান লোক বেশী থাকায় ব্রিটেন ভেবেছিল এখানে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রয়োজনই নেই কিন্তু ১৯৫৭ সালে হেরল্ড ম্যাকমিলান যখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি বুঝতে পারেন পূর্ব আফ্রিকাকেও মুক্ত করা প্রয়োজন কারন সেখানে পরিস্থিতি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে। ১৯৬১ সালে পূর্ব আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসাবে তাঙ্গানিকাকে স্বাধীনতা দেশ ব্রিটেন। জাঞ্জিবার দ্বীপকে ১৯৬৩ সালে তাঙ্গানিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর তাঙ্গানিকার নতুন নাম হয় তানজানিয়া। উগান্ডাকে স্বাধীনতা দিতে সমস্যা হয় কারন স্থানীয় উপজাতিদের পারস্পরিক সংঘর্ষ এখানে লেগেই ছিল। তাছাড়া উগান্ডার বুগাডা অঞ্চলের শাসক কাওয়াকা গনতন্ত্র বিরোধী ছিল। যার জন্য ১৯৬২ সালে উগান্ডাকে স্বাধীনতা দেওয়ার সময়ে উগান্ডার নতুন সংবিধানে বুগাডাকে বিশেষ কিছু সুবিধা দেওয়া হয়। পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়াতে সবচেয়ে বেশী সমস্যায় পড়ে ব্রিটিশরা। কেনিয়াতে প্রায় এক কোটি আফ্রিকান মানুষের পাশপাশি ৬৬,০০০ ইউরোপীয়ান, দুই লাখ ভারতীয় এবং ৩৫,০০০ আরব লোক ছিল সেসময়। ইউরোপীয়ানদের কাছে প্রচুর জমি ছিল কেনিয়ার, তারা দীর্ঘদিন সেখানে থাকার ফলে কেনিয়াকেই নিজের দেশ মনে করতো। কেনিয়ার স্থানীয় এক উপজাতি সম্প্রদায়ও কেনিয়াতে তাদের বেশী ক্ষমতা দাবী করছিলো ব্রিটিশদের কাছে। কেনিয়ার আর এক উপজাতি সম্প্রদায় ইউরোপীয়ানদের বিরুদ্ধে সহিংস আক্রমন শুরু করেছিল। ১৯৫২ সালে কেনিয়াতে জরুরী অবস্থা জারি করে ব্রিটেন এবং ১৯৫৪ সালে এনভিল নামে একটি অপারেশন শুরু করে ব্রিটেন কেনিয়াতে যাতে এক লাখ সেনাকে বিদ্রোহ দমন করতে কেনিয়াতে পাঠানো হয় এবং জাতীয়তাবাদী নেতাদের জেলে ভরে দেওয়া হয়। কেনিয়াতে এই সেনা অভিযানের নামে যে অত্যাচার ব্রিটিশরা করেছিল তা দীর্ঘদিন ব্রিটিশরা লুকিয়ে রেখেছিল। ২০০৫ সালে ঐতিহাসিক ডেভিড অ্যান্ডারসন এবং ক্যারোলিন এলকিন্স তাদের বইয়ে জানায় কেনিয়াতে সেনা অভিযানের মাধ্যমে কয়েক হাজার স্থানীয় অধিবাসীকে ফাঁসি দেওয়া হয়, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে কুড়ি হাজার আফ্রিকানের মৃত্যু হয়। প্রায় এক লাখ কেনিয়ার অধিবাসীর ব্রিটিশ ক্যাম্পে অত্যাচারে মৃত্যু হয়। এক ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার পরে স্বীকার করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান নাজি সেনার ক্যাম্পের থেকেও ভয়াবহ ছিল কেনিয়ায় ব্রিটিশ ক্যাম্প। আসলে আফ্রিকা মহাদেশে অনেক উপজাতি সম্প্রদায় রয়েছে যাদের নিজস্ব গোষ্ঠী রয়েছে, ব্রিটিশরা সর্বদা ডিভাইড এন্ড রুল নীতি ব্যবহার করে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল, আফ্রিকাতেও এই একই নীতি প্রয়োগ করেছিল তারা। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত কেনিয়ায় ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ চলেছিল। তবে পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হওয়ায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হেরল্ড ম্যাকমিলান ১৯৬৩ সালে কেনিয়াকে স্বাধীনতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। 

মধ্য আফ্রিকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে সবচেয়ে দেরীতে স্বাধীনতা পায়। মধ্য আফ্রিকার নাসাল্যান্ড, উত্তর ও দক্ষিন রোডেসিয়াতে প্রায় সাড়ে আট কোটি আফ্রিকান জনসংখ্যা ছিল, সেই তুলনায় ইউরোপীয়ানদের সংখ্যা ছিল মাত্র তিন লাখ। কিন্তু ক্ষমতা পুরো ইউরোপীয়ানরাই নিয়ন্ত্রন করতে। জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য এখানকার অধিবাসীদের তেমন শিক্ষাই দেয়নি ইউরোপীয়ানরা। এখানকার ইউরোপীয়ানরা ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে জানিয়েছিল তারা এই তিনটি দেশকে নিয়ে আফ্রিকান ফেডারেশন তৈরি করবে। কিন্তু আফ্রিকার সব দেশেই জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটে ইউরোপ, আমেরিকা থেকে আগত শিক্ষিত আফ্রিকানদের দ্বারা, পশ্চিম ও পূর্ব আফ্রিকার মতোন মধ্য আফ্রিকাতেও জাতীয়তাবাদ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্য আফ্রিকাতে ব্রিটিশ বিরোধী হিংসাত্মক আন্দোলন তীব্র হওয়ায় ১৯৫৯ সালে নাসাল্যান্ড ও দক্ষিন রোডেসিয়াতে জরুরী অবস্থা জারি করে দেওয়া হয় এবং অনেক ব্যক্তিকে জেলে ভরে দেওয়া হয়। ব্রিটেনে সেসময় লেবার দল ক্ষমতায় ছিল যাদের আফ্রিকানদের প্রতি সমর্থন ছিল। যার জন্য নাসাল্যান্ড ও উত্তর রোডেসিয়ার জন্য নতুন সংবিধান তৈরি করা হয় এবং ১৯৬৩ সালে এই দুটি দেশকে স্বাধীনতা দিয়ে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর নাসাল্যান্ড তার নাম পরিবর্তন করে রাখে মালাউই এবং উত্তর রোডেসিয়া তার নাম পরিবর্তন করে রাখে জাম্বিয়া। এরপর পুরো আফ্রিকা মহাদেশে শুধুমাত্র একটি ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল তা হল দক্ষিন রোডেসিয়া। এখানে দুই লাখ ইউরোপীয়ন বাস করতো যারা সরকার গঠন করেছিল। এখানকার সরকারও স্বাধীনতা চাইছিলো কিন্তু ব্রিটেন জানিয়ে দেয় স্বাধীনতা দেবে কিন্ত আফ্রিকানদেরও সরকার গঠনে অর্থাৎ বিধানসভায় আসন দিতে হবে কিন্তু দক্ষিন রোডেসিয়ার সরকার আফ্রিকানদের বিধানসভায় আসন দিতে রাজি ছিলনা। ১৯৬৫ সালের নভেম্বরে দক্ষিন রোডেসিয়া একপ্রকার জোর করেই ব্রিটেন থেকে তাদের স্বাধীনতা ঘোষনা করে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ব্রিটেন দক্ষিন রোডেসিয়ার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, জাতিসংঘও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দক্ষিন রোডেসিয়ার উপর যদিও এসব কিছুই তেমন প্রভাব ফেলেনি দেশটির উপর। কিন্ত সময়ের সাথে ইউরোপীয়ান সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ১৯৮০ সালে দক্ষিন রোডেসিয়া পূর্ন স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর দক্ষিন রোডেসিয়ার নতুন নাম হয় জিম্বাবুয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.