রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ কেন হচ্ছে?
নিউজ ডেস্কঃ – যুদ্ধের আগুনে প্রতিনিয়ত ধ্বংস স্তুপে পরিণত হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘোষণা অনুযায়ী যুদ্ধ শুরু হতেই মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে দুটি দেশ। এই যুদ্ধের জেরে মৃত্যুবরণ করেছে কয়েক হাজার সেনাবাহিনী সহ সাধারণ নাগরিক। কিন্তু কেন এই যুদ্ধ! কেন এই রক্তের খেলা! এর পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি কারণ।
বেশ কয়েক মাস ধরেই রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলছিল ঠান্ডা বিতর্কের লড়াই। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানিয়েছিলেন যে সমস্যায় হয়ে থাকুক না কেন আলোচনার মাধ্যমে সেটা সমাধান করা হবে। দেশের স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখেই পূর্ব পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন পুতিন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলোচনার রাস্তায় না গিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরার হয়েছে। যেমন –
১৯৯১ সালে মস্কো থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পায় ইউক্রেন। সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের নেতা লিওনিড ক্রাভচুক রাশিয়ার শাসন থেকে ইউক্রেনের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। একটি গণভোট এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, ইউক্রেনবাসী এই স্বাধীনতা অনুমোদন করে এবং ক্রাভচুককে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে।
ইউক্রেন স্বাধীনতা লাভের প্রায় দু’বছর পর অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে লিওনিড কুচমা একটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ক্রাভচুককে পরাজিত করেন। পর্যবেক্ষকদের মতে নির্বাচনটি অনেকাংশে অবাধ এবং সুষ্ঠু ছিল। এরপরই কুচমা ১৯৯৯ সালে পুনরায় ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। যদিও সেই নির্বাচন অস্বচ্ছ বলে দাবি করেন একাংশ। তবে ভোটে কারচুপির অভিযোগে ২০০৪ সালে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয় যা ‘অরেঞ্জ রেভলিউশন’ নামে পরিচিত। দীর্ঘ বিক্ষোভের পর পুনরায় ভোট হয় এবং পশ্চিমাপন্থী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ইউশচেঙ্কো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
২০০৫ সাল ইউশচেঙ্কো ইউক্রেনকে ক্রেমলিনের ঝামেলা থেকে সরিয়ে ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এছাড়াও ২০০৮ সাল, ন্যাটো ইউক্রেনকে প্রতিশ্রুতি দেয় যে ইউক্রেন একদিন তাদের জোটে যোগ দেবে৷
২০১৩, ইয়ানুকোভিচের সরকার নভেম্বরে EEU-EEU-র সঙ্গে বাণিজ্য ও সমিতির আলোচনা স্থগিত করে এবং মস্কোর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার সিদ্ধান্ত নেয় যার কারণে কিয়েভে কয়েক মাস গণ বিক্ষোভ হয়৷
২০১৪ সাল, কিয়ভ ময়দান স্কোয়ারের চারপাশে কেন্দ্রীভূত বিক্ষোভগুলি হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। কয়েক ডজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়। ফেব্রুয়ারিতে, ইউক্রেন পার্লামেন্ট ইয়ানুকোভিচকে অপসারণের পক্ষে ভোট দেয়। কিন্তু অপসারণের আগেই ইয়ানুকোভিচ পালিয়ে যান। এরপর কয়েকদিনের মধ্যে, বেশ কিছু সশস্ত্র বিদ্রোহী ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চলে সাংসদ পদ দখল করে এবং রাশিয়ার পতাকা উত্তোলন করে। ১৬ই মার্চের গণভোটের পরে মস্কো এই অঞ্চলটিকে নিজের সঙ্গে সংযুক্ত করে৷ এপ্রিলে, ডনবাসের পূর্বাঞ্চলে রাশিয়াপন্থীরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেয়।
২০২২ সাল পর্যন্ত বারবার যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও বিক্ষিপ্তভাবে চলতে থাকে লড়াই।
২০১৪ মে মাসে, ব্যবসায়ী পেট্রো পোরোশেঙ্কো পশ্চিমাপন্থী এজেন্ডা নিয়ে ইউক্রেনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হন। জুলাই মাসে, একটি ক্ষেপণাস্ত্র আমস্টারডাম থেকে কুয়ালালামপুর যাওয়ার পথে যাত্রীবাহী বিমান এমএইচ১৭ এর উপর ফলে দেয়, এতে ২৯৮ জনের মৃত্যু হয়। যদিও রাশিয়া এই বিষয়ে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে।
২০১৭ সাল, ইউক্রেন এবং ইইউ-এর মধ্যে একটি অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি পণ্য ও পরিষেবার মুক্ত বাণিজ্য এবং ইউক্রেনীয়দের জন্য ইউ-তে ভিসা-মুক্ত ভ্রমণের ঘোষণা করে।
২০১৯ সাল, প্রাক্তন কমিক অভিনেতা ভলোদিমির জেলেনস্কি দুর্নীতির মোকাবেলা এবং পূর্ব ইউক্রেনে যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এপ্রিলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পোরোশেঙ্কোকে পরাজিত করেন৷ তার সার্ভেন্ট অফ পিপল পার্টি জুলাইয়ের সাংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে।
২০২১ জানুয়ারি, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে বাইডেনের কাছে আবেদন জানান।
২০২১ সাল, ফেব্রুয়ারি মাসে জেলেনস্কির সরকার ইউক্রেনের বিরোধী নেতা এবং ক্রেমলিনের সবচেয়ে বিশিষ্ট মিত্র ভিক্টর মেদভেদচুকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে।
২০২১ মে, রাশিয়া ইউক্রেনের সীমানার কাছে সৈন্যদের গণসংযোগ শুরু করে, যা প্রশিক্ষণ অনুশীলনের অংশ বলে দাবি করা হয়।
২০২১, অক্টোবর, ইউক্রেন পূর্ব ইউক্রেনে প্রথমবারের মতো একটি তুর্কি বায়রাক্টার টিবি২ ড্রোন ব্যবহার করে। এটি রাশিয়াকে ক্ষুব্ধ করে৷
২০২১ নভেম্বর, রাশিয়া আবার ইউক্রেন সীমান্তে সৈন্য পাঠাতে শুরু করে।
২০২১, ৭ ডিসেম্বর, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বাইডেন রাশিয়াকে সতর্ক করেন, যাতে তারা ইউক্রেন আক্রমণ না করে।
২০২১, ১৭ ডিসেম্বর, রাশিয়া একটি আইনত বাধ্যতামূলক গ্যারান্টি সহ বিশদ নিরাপত্তা দাবি পেশ করে যে ন্যাটো পূর্ব ইউরোপ এবং ইউক্রেনে যেকোনো সামরিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকবে।
২০২২, ১০ জানুয়ারি, মার্কিন এবং রাশিয়ান কূটনীতিকরা আলোচনার মাধ্যমে ইউক্রেন সমস্যার সমাধান খুঁজতে ব্যার্থ হন৷
২০২২, ১৪ জানুয়ারি, ইউক্রেনের উপর একটি সাইবার আক্রমণ হয়। যার মাধ্যমে ইউক্রেনের সরকারী ওয়েবসাইটগুলিকে আঘাত করে ইউক্রেনবাসীকে ভয় দেখানো হয়।
২০২২, ১৭জানুয়ারি, রাশিয়ান বাহিনী যৌথ মহড়ার জন্য ইউক্রেনের উত্তরে বেলারুশে পৌঁছাতে শুরু করে।
২০২২, ২৪ জানুয়ারি, ন্যাটো তার বাহিনীকে স্ট্যান্ডবাই রাখে এবং আরও জাহাজ ও যুদ্ধবিমান দিয়ে পূর্ব ইউরোপকে শক্তিশালী করে।
২০২২, ২৮ জানুয়ারি, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন যে ন্যাটো কতৃক রাশিয়ার প্রধান নিরাপত্তার দাবিগুলো সমাধান করা হয়নি।
২০২২, ২ফেব্রুয়ারি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানায় যে তারা পোল্যান্ড এবং রোমানিয়াতে ৩০০০ অতিরিক্ত সৈন্য পাঠাবে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো মিত্রদের যে কোনও সঙ্কট থেকে রক্ষা করতে।
২০২২, ২ ফেব্রুয়ারি, ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগদানের অনুমতি না দেওয়ার দাবিতে চিনের সমর্থন জেতেন পুতিন।
২০২২, ৭ ফেব্রুয়ারি, ক্রেমলিনে পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সংকটের কূটনৈতিক সমাধানের জন্য কিছুটা আশার কথা বলেন৷ ম্যাক্রন তারপর কিয়েভ যান এবং জেলেনস্কির সাং-ফ্রয়েড এর প্রশংসা করেন।
২০২২, ৯ ফেব্রুয়ারি, খারাপ পরিস্থির আঁচ করে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে ইউক্রেনে থাকা আমেরিকানদের অবিলম্বে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেন বাইডেন৷ অন্যান্য দেশও তাদের নাগরিকদের ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানায়।
২০২২,১৪ ফেব্রুয়ারি, জেলেনস্কি ইউক্রেনীয়দের পতাকা উত্তোলন ও একসঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। পশ্চিমের কিছু সংবাদমাধ্যম বলছে যে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করতে পারে।
২০২২, ১৫ ফেব্রুয়ারি, রাশিয়া জানিয়েছে যে তাদের কিছু সৈন্য ইউক্রেন সীমান্তে অনুশীলনের পরে ঘাঁটিতে ফিরে আসছে এবং রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের সতর্কবাণী সম্পর্কে পশ্চিমের দেশগুলির সতর্কতাকে হেসে উড়িয়ে দেশ।
২০২২, ১৬ ফেব্রুয়ারি, রাশিয়ার পার্লামেন্ট পুতিনকে পূর্ব ইউক্রেনের রুশ-সমর্থিত দুটি প্রদেশকে স্বাধীন অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বলেছে।
২০২২, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ইউরোপে নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থার মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইকেল কার্পেন্টার বলেছেন রাশিয়ায় সম্ভবত ইউক্রেন সীমান্তে ১৯০০০০ জন সৈন মোতায়েন৷
২০২২, ১৯ ফেব্রুয়ারি, রাশিয়ার কৌশলগত পারমাণবিক বাহিনী পুতিনের তত্ত্বাবধানে অনুশীলন শুরু করে।
২০২২,২১ ফেব্রুয়ারি, ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ম্যাক্রন বলেছেন যে বাইডেন এবং পুতিন ইউক্রেন নিয়ে একটি শীর্ষ সম্মেলনে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছেন৷
২০২২, ২১ ফেব্রুয়ারী, পুতিন পূর্ব ইউক্রেনের দুটি রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্ন অঞ্চলকে স্বাধীন সত্তা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন৷
২০২২, ২২, ফেব্রুয়ারি, পুতিকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করে নেওয়ার আহ্বান দিয়েছিল ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি৷ পুতিনকে ফোনও করেছিলেন ভলোদিমির জেলেনস্কির।
২০২২, ২৩ ফেব্রুয়ারি, সেই ফোনালাপে আলোচনার মাধ্যমে দেশের স্বার্থ ক্ষুন্ন না করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি।
২০২২, ২৪ ফেব্রুয়ারি, কোন আলোচনা সভায় না গিয়ে ইউক্রেন আক্রমণের ঘোষণা করে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পুতিন।